হাওর রক্ষা বাঁধ নির্মাণে হরিলুট, ক্ষুব্ধ কৃষকরা
৬ মার্চ ২০২১ ১২:২৪
ঢাকা: সুনামগঞ্জের ৫২ টি বড় হাওরের ফসল অকাল বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য এবার ৮১১ টি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসির) মাধ্যমে ৮১১ টি বাঁধের কাজ হচ্ছে। এরমধ্যে ১৩০ টির মতো বড় ভাঙন রয়েছে। ১৫ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ করার কথা ছিল। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ায় ৭ মার্চ পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে। তাতেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভাঙনে কাজ শেষ হয়নি। কোথাও কোথাও দুয়েক দিন হয় বাঁধের কাজ শুরু হয়েছে। ফলে হাওররক্ষা বাঁধের কাজ নিয়ে ক্ষোভ ও বিরক্ত প্রকাশ করেছেন সুনামগঞ্জের হাওরের কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, ২০১৭ সালে অনিয়ম লুটপাটের জন্য হাওরের ফসল তলিয়ে গিয়েছিল পরে সেই লুটপাটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেন হাওর নেতারা। তাতে আমাদের কৃষকদের ফসল ফিরে না পেলেও কৃষকদেরকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি)’র মাধ্যমে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য নয়া নীতিমালা চালু হয়েছিল, সেটি এখন প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু অসৎ সরকারি কর্মকর্তা-রাজনীতিবিদ ও বাঁধ ব্যবসায়ীর জন্য এই প্রক্রিয়া সমালোচিত হচ্ছে।
অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প, বাঁধের উপর সামান্য পরিমাণে মাটি দিয়ে বড় অংকের বিল উত্তোলন, আবার কোথাও কোথাও বাঁধ নির্মাণ না করে পানির জন্য অপেক্ষা করার মতো দুর্নীতি এখন হাওরজুড়ে। কৃষকদের সম্পৃক্ত না করে বাঁধের কাজের দায়িত্ব দেওয়া অন্যদের, আবার কোথাও কোথাও কাগজে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটিতে কৃষকের নাম দিয়ে বাঁধের ব্যবসা করছে একই শ্রেণির লোকজন। এ কারণে হাওররক্ষা বাঁধ এখন কৃষকদের বায়ুচাপের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সুনামগঞ্জ জেলার শাল্লা ও নেত্রকোণার কালিয়াজুরি উপজেলার বড় হাওর কালিয়াকোঠার ফসল রক্ষা জন্য হাওয়ার খালের বড় ভাঙনে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কাজ হয়েছে ২০ থেকে ৩০ ভাগ।
হাওরপাড়ের কাশিপুর গ্রামের আব্বাছ মিয়া বলেন, ‘হাওরে বাঁধের কাজ যেভাবে করা হচ্ছে সম্পূর্ণ মার্চ মাস কাজ করলেও বাঁধের কাজ শেষ হবে না। কাজের ধরন দেখে বুঝা যাচ্ছে, তারা (পিআইসি’র লোকজন) পানির অপেক্ষা করছে।’
শাল্লা উপজেলার কৃষক নেতা তরুণ কান্তি দাস বলেন, ‘বাঁধের কাজে কৃষক নেই বললেই চলে, কোথাও কোথাও কৃষকের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। বাঁধের পরিমাণ বাড়ানো হয়েছে ব্যবসার জন্য। বাঁধ দিলে হাওরের পরিবেশগত প্রতিক্রিয়া কী হবে তাও যাচাই করা হয়নি। বাঁধ নির্মাণে দলীয়করণ হচ্ছে। পুরাতন বাঁধকে নতুন করা হচ্ছে, এক্ষত্রে টাকা লুটপাটের ধান্দাই বেশি। উপজেলার হাওয়ার খালের বড় ভাঙনে কাজ শেষ হতে আরও এক মাস সময় লাগবে। উপজেলার দাড়াইন নদীতে গোলা এসেছে, কালনীতে একই অবস্থা। এখনো বৃষ্টি হয়নি। বৃষ্টি হলে দেখতে দেখতে পিয়াইন ও সুরমা নদী পানিতে টই টুম্বুর হয়ে বাঁধে ধাক্কা দেবে। লাখো কৃষকের কপাল ভাঙবে। এই চিন্তা করছেন না সংশ্লিষ্টরা। ২০১৭ সালে আন্দোলন সংগ্রাম করে আমরা বাঁধের কাজে জমি মালিকদের সম্পৃক্ত করার নীতিমালা কার্যকর করেছিলাম। এটি এখন কেবল কাগজেই আছে। নানা কৌশলে এখানে মধ্যস্বত্বভোগীরা ভাগ বসিয়েছে।’
এই উপজেলার একজন জ্যেষ্ঠ সরকার দলীয় রাজনীতিবিদ বললেন, আমি জেলা প্রশাসক ও পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলীকে বলেছি, উপজেলার ৬২, ৬৩, ৬৪ ও ৬৫ নম্বর পিআইসিকে প্রায় ৬৩ লাখ টাকা দেওয়া হয়েছে। আমি বলেছি, ৭ লাখ টাকা দেন, বাঁধ না করতে পারলে দায় আমার।
এই রাজনীতিকের দাবি উপজেলার ১৬৫টি প্রকল্পের বেশিরভাগই সাবেক জেলা প্রশাসকদের সময়কালে করা হয়েছে। ১০০টি প্রকল্পে এক হাজার সিএফটি’র বেশি মাটি লাগছে না। অথচ প্রাক্কলনে লাখ লাখ মাটি ধরা আছে। আবার কোথাও কোথাও বড় ভাঙনে এখনো কাজ শেষ করা হয়নি।
শাল্লা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলামিন চৌধুরী বলেন, ‘এক হাজার মাটি দিয়ে বাঁধ করা যাবে না কোনটিই। বলা যায়, কিছু বাঁধে অতিরিক্ত মাটি ধরে প্রাক্কলন হয়েছে, কোনটাতে প্রয়োজনের চেয়ে কম মাটি ধরে প্রাক্কলন হয়েছে। জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সব কয়টি বাঁধের প্রাক্কলন আবার যাচাই করার জন্য নিয়েছেন। উপজেলার হাওয়ার খালের মতো ঝুঁকিপূর্ণ ভাঙনে যে কাজ কম হয়েছে, এর ছবি তুলে আমি সংশ্লিষ্ট সবাইকে পাঠিয়েছি, আমি বলেছি এভাবে বাঁধের কাজ চললে হাওরের সর্বনাশ হয়ে যাবে।’
কেবল শাল্লা উপজেলায় এমন চিত্র নয়। সুনামগঞ্জ জেলাজুড়ে বাঁধ নির্মাণে অনিয়ম-অবহেলা এবং লুটপাটে ক্ষুব্ধ কৃষকরা। বাঁধের অনিয়মের আলোচনা ধর্মপাশা, দোয়ারা বাজার, দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় বেশি। হাওর প্রকল্প নিয়ে এত অনিয়ম হওয়ায় জেলাজুড়েই সমালোচনা চলছে।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সবিবুর রহমান বলেন, ‘কিছু প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি কাজ বাস্তবায়ন করতে অপারগতা প্রকাশ করায় নতুন প্রকল্প কমিটি করা হয়েছে। ওখানে কাজ শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। হাওরের সকল বড় ভাঙনে ডিজাইন লেবেল পর্যন্ত মাটি ফেলার কাজ শেষ পর্যায়ে জানি আমি, কোন ভাঙনে কাজ কম হয়ে থাকলে দ্রুত ডিজাইন লেবেল পর্যন্ত কাজ করা হবে। অপ্রয়োজনীয় কাজ হয়নি কোথাও। আশা করি, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ শেষ হবে।’
সারাবাংলা/একে