৭ই মার্চ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিয়েছি
৭ মার্চ ২০২১ ১০:০৮
৭ই মার্চের মহাকাব্যিক ভাষণ শুনতে সেদিন যারা রেসকোর্স ময়দানে গিয়েছিলেন, যাদের স্থান হয়েছিল মূল মঞ্চে, অথবা যারা মঞ্চের খুব কাছে বসে শুনেছিলেন বাংলার রাখাল রাজা, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই অমর ‘কবিতাখানি’, তাদের অনেকেই পরবর্তী সময় বাংলাদেশের রাজনীতে কিংবদন্তি হয়ে ওঠেন। এমপি-মন্ত্রী তো বটেই, দেশের বড় বড় রাজনৈতিক দলের প্রভাবশালী নেতা, নীতিনির্ধারক, দলীয় প্রধান তথা জাতীয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। এদের কেউ আওয়ামী লীগ, কেউ বিএনপি, কেউ গণফোরাম, কেউ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), কেউ জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব দিয়েছেন, দিচ্ছেন অথবা বড় পদে আছেন।
এদেরই একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্বাস। সেদিনের সেই ২০ বছর বয়সী টগবগে যুবক এখন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য। দায়িত্ব পালন করেছেন ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে। মন্ত্রীও হয়েছেন একবার। ঢাকা-৬ আসনে নির্বাচিত সংসদ সদস্যও ছিলেন তিনি।
আজকের বিএনপি নেতা মির্জা আব্বাস ১৯৭১ সালের ৭ মর্চের ঐতিহাসিক ভাষণের দিন কেথায় ছিলেন? প্রশ্নটি করতেই মুঠোফোনের ওপ্রান্ত থেকে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বসেন একাত্তরের এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্মৃতি হাতরে বলতে থাকেন— ‘সে তো অনেক কথা। ৭ই মার্চের ভাষণ তো একদিনে আসেনি। এর আগে ৬৬’র ছয় দফা আছে, ৬৯-এর ১১ দফা আছে। বলতে পার- পাকিস্তানবিরোধী সব আন্দোলন সংগ্রামের সঙ্গেই ছিলাম। কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে না থেকেও বাংলাদেশ ইস্যুতে যতো আন্দোলন-সংগ্রাম, তার সব ক’টাতেই অংশ নিয়েছি।
সেদিনও অর্থাৎ ৭ই মার্চের ভাষণের দিনও মঞ্চের সামনে প্রথম যে বাঁশের ব্যারিকেড বা নিরাপত্তা বেষ্টনী— সেখানে বসেই ভাষণ শুনেছি। বয়স কম ছিল। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান দিয়েছি, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা-মেঘনা-যমুনা, বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’— বলছিলেন মির্জা আব্বাস।
ওইদিন আপনার ডানে, বামে, সামনে পেছনে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে আপনার মতো আর কেউ কি আছেন?— যারা পরবর্তী সময় একেকজন ‘মির্জা আব্বাস’ হয়ে উঠেছেন?— প্রশ্নটা শুনে কিছুটা বিব্রত হলেন তিনি। বিনয়ের সঙ্গে বললেন- না, আমি আর কী হয়েছি! সেদিনের আ স ম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, নূরে আলম সিদ্দিকী, তোফায়েল আহমেদ তখনই অনেক বড় নেতা। এরা বোধ হয় মঞ্চের আশ-পাশেই ছিলেন। আর মঞ্চে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে যারা ছিলেন, তারা তো আরও বড়! তাজউদ্দিন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের মতো নেতারা। আরও অনেকেই ছিলেন।
সেদিনের অনুভূতিটা কেমন?— প্রশ্নটি করার পর কিছু সময়ের জন্য মুঠোফোনের ওপ্রান্তে পিনপতন নীরবতা। তারপর বলতে শুরু করলেন মির্জা আব্বাস। ‘আমার সারাটা জীবন গেছে আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। তখন এত কিছু হিসেব করে রাজনীতি করিনি। মার্চের আগে থেকেই বুঝতে পারছিলাম পাকিস্তানের সঙ্গে আর থাকা হবে না। আমাদের এখন যুদ্ধ করতে হবে। ৭ই মার্চের ভাষণের পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। অর্থাৎ যুদ্ধই একমাত্র মুক্তির পথ। সুতরাং বুঝতেই পারছ, ৭ই মার্চের ভাষণ এবং সেদিনের সেই জনসভায় আমরা যারা উপস্থিত ছিলাম, তাদের অনুভূতিটা কেমন হতে পারে।’
‘যাই হোক, তখন সারাদেশে মানুষের সংখ্যা ছিল সাত কোটি। এদের মধ্যে ঢাকা শহরে বাস করত ২০ বা ২৫ লাখ মানুষ। সেদিক থেকে বিচার করলে ৭ই মার্চের ভাষণ শুনতে ঢাকার প্রায় সব মানুষই চলে এসেছিল। স্বাধীনতার আগে একসঙ্গে এত মানুষ আমরা দেখিনি। মানুষের এমন স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণের কারণেই স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব হয়েছিল। নির্দিষ্ট কোনো দলের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ নয়, বরং দেশকে স্বাধীন করার জন্য সবাই একিত্রত হয়েছিল’— বলেন মির্জা আব্বাস।
যুদ্ধে গেলেন কবে? সহযোদ্ধা হিসেবে কাদের পেয়েছিলেন? ফোনের ওপ্রান্ত থেকে উত্তর এল— জুলাইয়ে। সহযোদ্ধা হিসেবে যারা ছিলেন তাদের মধ্যে আমার বন্ধু প্রয়াত সাদেক হোসেন খোকা অন্যতম। আমি ক্র্যাক প্লাটুনে যুদ্ধ করতাম। আমার সরাসরি কমান্ডার ছিলেন গোলাম দস্তগীর গাজী, বীরপ্রতীক। আজকে যিনি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী।
ঢাকার অদূরে ত্রিমোহনীতে একটা সম্মুখ যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধে গোলাম দস্তগীর গাজী আমাদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। সেটি ছিল ভয়াবহ যুদ্ধ। সেই ত্রিমোহনী বোধ হয় এখন গাজী সাহেবের নির্বাচনি এলাকা। যুদ্ধের আরও অনেক স্মৃতি আছে। একদিন বাসায় এসো যুদ্ধের গল্প শোনাব। সেইসঙ্গে ৭ই মার্চের ভাষণ নিয়েও কথা বলা যাবে। কোনোরকম প্রিপারেশন ছাড়া এতদিন আগের কথা হুবহু বলা মুশকিল। ভালো থেকো।
অতঃপর ৭ই মার্চের ঐতিকহাসিক ভাষণ মঞ্চের সামনে বসে শোনা এবং পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়া একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মির্জা আব্বাসকে ধন্যবাদ জানানোর মধ্য দিয়ে শেষ হয় সারাবাংলার মুঠোফোন আলাপ।
সারাবাংলা/এজেড/পিটিএম
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মির্জা আব্বাস রেসকোর্স ময়দান