৭ মার্চের সঠিক ভাষণ: ১ বছরেও হাইকোর্টে জমা পড়েনি প্রতিবেদন
৭ মার্চ ২০২১ ১৯:১২
ঢাকা: ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ‘সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ’ ভাষণ খুঁজে পেতে গত বছরের ৬ অক্টোবর সাত সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছিল তথ্য মন্ত্রণালয়। হাইকোর্টে দায়ের করা এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ কমিটি করা হয়।
কমিটির সদস্য সচিব, প্রেস ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক জাফর ওয়াজেদ নেতৃত্বে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তথ্য মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিলেও তা সেখানে পড়ে আছে। ফলে দেড় মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা এক বছরেও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিবের টেবিল থেকে জমা পড়েনি হাইকোর্টে। ফলে বঙ্গবন্ধুর সঠিক ভাষণ সংক্রান্ত মামলাটির কোনো সুরাহা হচ্ছে না।
সঠিক ভাষণ খুঁজতে কমিটি: বঙ্গবন্ধুর সঠিক ভাষণ খুঁজে বের করতে গঠিত কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের (ডিএফপি) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক, বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান, বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ড. মুনতাসীর মামুন এবং বাংলাদেশ বেতারের সাবেক উপ-মহাপরিচালক আশফাকুর রহমান খান।
আদালতের রিট আবেদনের নির্দেশনা অনুযায়ী কমিটিকে প্রয়োজনীয় দলিলপত্রাদি, তৎকালীন প্রকাশিত ও প্রচারিত পত্রিকা এবং অডিও ভিজ্যুয়াল ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানের দেওয়া প্রকৃত ঐতিহাসিক ভাষণটি নিশ্চিত করতে বলা হয়।
এ বিষয়ে কমিটির সদস্য সচিব জাফর ওয়াজেদ সারাবাংলাকে বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতর (ডিএফপি) ও বাংলাদেশ বেতার থেকে আমরা বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি সংগ্রহ করি। বিভিন্ন মাধ্যম থেকে সংগ্রহ করে মোট ২২ মিনিট ১৮ সেকেন্ডের ভাষণ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে স্লোগান ছিল চার মিনিটের। স্লোগান বাদ দিয়ে আমরা ১৮ মিনিট ২২ সেকেন্ডের ভাষণ পেয়েছি। কমিটির সিদ্ধান্ত মতে সেটিই এখন পর্যন্ত পূর্ণাঙ্গ ভাষণ। এটি আমরা তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিবের কাছে জমা দিয়েছি।’
কাজটি করতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আগে তো ক্যাসেটে একটি রেকর্ডিং ১২ মিনিটের বেশি করা যেত না। রেকর্ডিং থেকে ক্যাসেট বদল করার সময়েও ভাষণের কিছু কিছু অংশ আসেনি। এ ছাড়া পারিপার্শ্বিক শব্দের কারণে ভাষণের কোথাও কোথাও বুঝতে অসুবিধা হয়েছে। এত সীমাবদ্ধতার পরও আমরা শেষ পর্যন্ত কাজটি করতে পেরেছি।’
কমিটির দেওয়া পূর্ণাঙ্গ ভাষণটি এখন থেকে রিপ্লেস হবে কি না বা এ সংক্রান্ত কোনো সুপারিশ কমিটির ছিল কি না জানতে চাইলে জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘আমরা এরকম কোনো সুপারিশ করিনি। কেননা এই বিষয়টি আমাদের কার্যপরিধির মধ্যে ছিল না। আমরা শুধু মূল ভাষণটি নিয়ে কাজ করেছি। ভাষণটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী হবে সেটি মন্ত্রণালয় কিংবা উচ্চ আদালতের এখতিয়ার।’
জাফর ওয়াজেদ বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্ভুল ভাষণের বিষয়ে যিনি হাইকোর্টে রিট করেছিল তাকে কমিটির পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। তার কারণে ৫০ বছর পরে হলেও আমরা মূল ভাষণটি নিয়ে কাজ করতে পেরেছি।’
যা বললেন রিট সংশ্লিষ্টরা: হাইকোর্টে এতদিনেও কেন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সংক্রান্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি জানতে চাইলে তথ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জাহানারা পারভীন বলেন, ‘আমি টেলিফোনে এ সব বিষয়ে কথা বলতে চাই না। আমাদের পিআরও আছেন তার সঙ্গে কথা বলেন।’
রিটের পক্ষের আইনজীবী আব্দুল আলীম মিয়া জুয়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণ অসম্পূর্ণ এবং ভুলভাবে উপস্থাপনের বিষয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ছয় সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। তবে এক বছর হয়ে গেলেও হাইকোর্টে প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি।’
আইনজীবী বলেন, ‘সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনের জন্য এ মূহূর্তে এ বিষয়ে আমি কোনো কিছু করতে পারছি না। তবে আমারা খুব দ্রুতই এ বিষয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।’
রিটকারীর আরেক আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর সঠিক ভাষণ খুঁজে পাওয়া ও সর্বস্তরে তার প্রচারের দায়িত্বটি দেশপ্রেমিক নাগরিক হিসেবে এটি আমাদের নৈতিক দায়িত্ব হওয়া উচিত। নৈতিক দায়িত্বের প্রশ্নে আদালতই কেন চাপ দেবে? বিষয়টি নিয়ে স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে আসা দরকার। আশা করি তথ্য মন্ত্রণালয় তাদের প্রতিবেদনটি খুব শিগগিরই আদালতে জমা দেবে।’
রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা এ এম আমিন উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি এই মুহূর্তে কিছু বলতে পারব না। সে সময় আমি দায়িত্বে ছিলাম না। এ সংক্রান্ত ফাইল আমার হাতে আসার পর বিস্তারিত বলতে পারব।’
যেভাবে ধরা পড়ল ভাষণের ভুল: সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কিছু শব্দ চয়ন, বাক্য ও বাক্যের গঠন ভুলভাবে উপস্থাপনসহ কিছু শব্দ বাদ দেওয়ায় কর্তৃপক্ষের ব্যর্থতা চ্যালেঞ্জ করে গত ৫ মার্চ হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী কাশেদ আলী। রিটের পক্ষের আইনজীবী ছিলেন সুবীর নন্দী দাস।
রিট করার প্রেক্ষাপট উল্লেখ করে কাশেদ আলী সারাবাংলাকে বলেন, ‘২০১৭ সালের ৭ ডিসেম্বর তারিখে বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণ ইউনেস্কো- মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্টার’ এ অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাষণটি বিশ্ব প্রামাণ্যের স্বীকৃতি লাভ করার অসামান্য অর্জনকে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপন করার লক্ষ্যে কাশেদ আলী বিশেষ আলোচনা সভার আমন্ত্রণ পান।
জিরাবো ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজের অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট কর্নেল লুৎফর রহমান বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চ ভাষণ বিষয়ে বক্তৃতার প্রস্তাব দিলে তিনি ভাষণটি নিয়ে গবেষণা করেন। এ ছাড়া ২০১৮ সালে ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত পাঠ্যপুস্তকের ভুলভ্রান্তি নিয়ে একটি সংবাদ পাঠ করে পাঠ্যপুস্তকেও ভাষণের ভুল দেখতে পান।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ভুলভাবে প্রচার করা হচ্ছে জানিয়ে কাশেদ আলী ২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সচিব-১ মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার কাছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন। এতে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে রিট করেন।
সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখতে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সংবিধানের পঞ্চম তফসিলে থাকা ভাষণের সঙ্গে এ সংক্রান্ত সব অডিও-ভিডিও পর্যালোচনা করে একটি প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করতে বলা হয়েছিল।
একইসঙ্গে সংবিধানে বঙ্গবন্ধুর সঠিক ভাষণ অন্তর্ভুক্তিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১০ মার্চ বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মো. ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ এসব আদেশ দেন।
আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন প্রয়াত অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অমিত দাস গুপ্ত।
রিটে আইন মন্ত্রণালয় সচিব এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের পরিচালকসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়। রিটে আইন মন্ত্রণালয় সচিব এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদফতরের পরিচালকসহ চারজনকে বিবাদী করা হয়।
ভাষণে যে সব ভুল: রিটকারীর আইনজীবী সুবীর নন্দী বলেন, ‘৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, রিকশা, ঘোড়া গাড়ি চলবে, রেল চলবে। কিন্তু সংবিধানে দেওয়া হয়েছে রিকশা, গরুর গাড়ি, রেল চলবে। এখানে ঘোড়ার গাড়ির জায়গায় গরুর গাড়ি লেখা হয়েছে।
এ ছাড়া ভাষণের ৮ মিনিট ৩১ সেকেন্ডে বলা হয়েছে, জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর, কিন্তু সংবিধানের লেখা হয়েছে জনগণের প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর।
ভাষণের ১২ মিনিট ১১ সেকেন্ডে বলা হয়েছে, শোনেন মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে। অথচ লেখা হয়েছে শুনুন মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে। এমন করে ৫০টিরও অধিক জায়গায় ভুল লেখা হয়েছে।
আইনজীবী সুবীর নন্দী দাস জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণটি ছিল ১৮ মিনিট ৩৯ সেকেন্ডের। কিন্তু বিভিন্ন পত্রিকা-বইয়ের লেখকরা যে অংশটুকু লিপিবদ্ধ করেছেন সেটা হলো ১১ মিনিটের মতো। এমনকি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ ২০১১ সালে সংবিধানে যে সংশোধনী বা সংযোজন করে (পঞ্চদশ সংশোধন, ২০১১ সনের ১৪ নং আইনের ৫৫ ধারা), সেখানে সংবিধানের পঁচাত্তর পৃষ্ঠায় গেলে দেখা যাবে পঞ্চম তফসিলে (১৫০ (২) অনুচ্ছেদ) ভাষণটি আছে। এই পঞ্চম তফসিলটাই হলো ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জাতির জনকের দেওয়া ঐতিহাসিক ভাষণ। সংবিধানেও ভাষণের পুরোটা লিপিবদ্ধ নেই।
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ভুল না সঠিক সেটি ইস্যু নয় আমার কাছে। প্রসঙ্গটি হচ্ছে তার ভাষণের স্প্রিট। আমরা যে ভাষণটি শুনে আসছি এতদিন, যে ভাষণ ইউনেস্কো স্বীকৃতি দিয়েছে সেটিই প্রকৃত ভাষণ বলে মনে করি।’
প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন: সারাবাংলার স্টাফ রিপোর্টার কামরুল ইসলাম ফকির।
সারাবাংলা/একে