বছরজুড়ে করোনার ‘তাণ্ডব’, ভ্যাকসিন জাগাচ্ছে ‘আশা’
৮ মার্চ ২০২১ ২৩:১৬
ঢাকা: বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯)। একবছর আগের ঠিক এই দিনে বিশ্বের ১০৪তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ইতালি ফেরত দু’জন ও তাদের সংস্পর্শে আসা একজন বাংলাদেশি নাগরিকের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার কথা সেদিন জানায় জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর)।
গোটা বিশ্বের জন্য তখনই আতঙ্কে পরিণত হওয়া করোনাভাইরাস একই রকমভাবে আতঙ্ক ছড়ায় বাংলাদেশেও। ক্রমেই বাড়তে থাকে সংক্রমণ। গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া ছাড়াও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেও সেই সংক্রমণের হার কমানো যায়নি প্রথম কয়েক মাসে। এর মধ্যেই করোনা চিকিৎসা নিয়ে অব্যবস্থাপনা, চিকিৎসকদের জন্য পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে না পারা, কোয়ারেনটাইন ও আইসোলেনের অপ্রতুল ব্যবস্থা আর করোনা পরীক্ষা নিয়ে জালিয়াতির খবর দেশব্যাপী আসে আলোচনায়। নতুন করোনা সংক্রমণ আর করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর মধ্যে এই অব্যবস্থাপনাই শেষ পর্যন্ত আতঙ্ক ছড়িয়েছে মানুষের মাঝে।
দেখতে দেখতে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে ৩৬৫ দিন। এই একবছরের প্রথমার্ধের পর থেকেই অবশ্য করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি সত্ত্বেও ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে উঠতে থাকে দৈনন্দিন কার্যক্রম। সংক্রমণের মাত্রাও কমতে থাকে। এর মধ্যে আশার আলো জোগায় ভ্যাকসিন। শেষ পর্যন্ত বছর পূর্ণ হওয়ার এই সময়ে এসে এখন করোনা সংক্রমণের হার অনেকটাই কম। করোনা সংক্রমণের ‘বর্ষপূর্তি’র একমাস আগেই দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম। স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সরকারের নীতিনির্ধারক ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনা মোকাবিলায় বছরব্যাপী গৃহীত কার্যক্রমের নানা ধরনের সীমাবদ্ধতা, সমন্বয়হীনতা ও অব্যবস্থাপনা থাকলেও শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ‘পারফরম্যান্স’কে মন্দ বলার সুযোগ নেই।
প্রথম নমুনা পরীক্ষা
দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ শনাক্ত করতে প্রথম নমুনা পরীক্ষা করা হয় ২১ জানুয়ারি। চীনের চীনের উহান থেকে আসা একই পরিবারের দুই সদস্য বিমানবন্দরে অবতরণের পর তাদের একজনের শরীরের তাপমাত্রা ১০১ ডিগ্রি ফারেনহাইট পাওয়া যায়। পরে প্যান-করোনা পদ্ধতিতে তাদের দু’জনের নমুনা পরীক্ষা করে আইইডিসিআর। সেটিই ছিল দেশে প্রথম করোনা পরীক্ষা। ২২ জানুয়ারি তাদের নমুনা পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসে। প্যান-করোনা পদ্ধতিতে সময় বেশি লাগে বলে পরে আর আরটি-পিসিআর পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা শুরু হয় দেশে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের সংবাদ সম্মেলন
দেশে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) পরিস্থিতির তথ্য সবাইকে জানাতে ২৩ জানুয়ারি প্রথম সংবাদ সম্মেলন করে স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন অধিদফতরের কমিউনিকেবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) শাখার সাবেক পরিচালক ও অধিদফতরের ওই সময়কার অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. সানিয়া তাহমিনা।
সমন্বয়হীনতা
চীনে নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পরে সেখানে থাকা বাংলাদেশের নাগরিকদের দেশে ফেরত আনা বিষয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। ২৮ জানুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘চীনের কর্তৃপক্ষ ১৪ দিনের আগে তাদের ছাড়তে রাজি হয়নি। সুতরাং ৬ ফেব্রুয়ারির আগে চীনের উহানে আটকে পড়া কোনো বাংলাদেশি ফিরতে পারবে না।’ ওইদিনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়, নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে জরুরি সভা করে।
৩০ জানুয়ারি জানানো হয়, চীনের উহান অঞ্চল থেকে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ৩১ জানুয়ারি জানানো হয়, ১ ফেব্রুয়ারি চীনের হুবেই শহর থেকে দেশে আনা হচ্ছে ৩৬১ জন বাংলাদেশিকে। দেশে আসার পরে ১৪ দিন নিবিড় পর্যবেক্ষণের জন্য তাদের আশাকোনার হজ ক্যাম্পে স্থাপিত ‘আইসোলেশন ইউনিটে’ রাখা হবে।
পরে ১ ফেব্রুযারি বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিয়ে আসা সেই ফ্লাইটের আগে ২৬ জন চীনা নাগরিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করেন। শরীরে জ্বর বা অন্যান্য কোনো উপসর্গ না থাকায় হেলথ ডিক্লেয়ারেশন কার্ড দেওয়া হয়নি তাদের। একইসঙ্গে তাদের আশকোনায় না পাঠানোর সিদ্ধান্তও হয়। ওই দিন বিশেষ বিমানে করে ৩১২ জন বাংলাদেশি ফিরে আসেন। তাদের কোয়ারেনটাইনের জন্য আশকোনাতে পাঠানো হয়।
এদিকে, ১৩ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘চীন থেকে বাংলাদেশি আর কাউকে দেশে আনা হবে কি না, এর সিদ্ধান্ত পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের, এটি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিষয় নয়।’
১৪ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো থেকে যারাই আসছেন, তাদের সবাইকে কোয়ারেনটাইনে থাকতে হবে। কিন্তু ওই দিন ইতালি থেকে আসা ১৪২ জন যাত্রীর কোয়ারেনটাইন নিয়ে সমন্বয়হীনতা দেখা দেয়। যাত্রীরা অব্যবস্থাপনার অভিযোগ তুলে কোয়ারেনটাইন পালন করতে অপারগতা প্রকাশ করেন। করোনামুক্ত সনদ থাকায় কোয়ারেনটাইন প্রয়োজন নেই জানিয়ে পরে আবার তাদের কোয়ারেনটাইনে পাঠানো হয়।’
১৭ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বে ১৭০টি দেশ করোনাভাইরাস আক্রান্ত। এই দেশগুলো থেকে আগতদের অনেকে বিমানবন্দরে প্রাথমিক চিকিৎসা না নিয়ে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে।’
প্রথম সংক্রমণ
২১ জানুয়ারি দেশে নমুনা পরীক্ষা শুরু হলেও প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। ওই দিন সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশে তিন জনের শরীরে এই ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। তিন জনের মধ্যে দু’জন ইতালি থেকে ফিরেছেন, আরেকজন তাদেরই একজন পরিবারের সদস্য।
বৈশ্বিক মহামারি ঘোষণা
বিশ্বের ১১০টি দেশে এক লাখ ১৮ হাজার কোভিড-১৯ সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হওয়ার পর ১১ মার্চ করোনাভাইরাসকে বৈশ্বিক মহামারি (প্যানডেমিক) ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। ওই দিনই দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিন জনের মধ্যে দু’জনের নমুনা পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল পাওয়া যায়।
করোনা প্রতিরোধে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে প্রথম টাকা বরাদ্দ
৫ মার্চ করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বরাদ্দ চেয়ে অর্থ বিভাগকে চিঠি দেয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের চাহিদা ছিল ১০০ কোটি টাকা। ১১ মার্চ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে ৫০ কোটি টাকা অর্থ বরাদ্দ দেয় অর্থ বিভাগ। বলা হয়, এ টাকা কোভিড-১৯ ছাড়া অন্য কোনো খাতে ব্যয় করা যাবে না।
করোনায় প্রথম মৃত্যু
করেনা সংক্রমণ নিয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুর তথ্য জানানো হয় ১৮ মার্চের স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে। ওই ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, যে ব্যক্তি মারা গেছেন তিনি সত্তরোর্ধ্ব। তার শ্বাসকষ্ট (সিওপিডি) ছাড়াও হৃদরোগ ও কিডনিজনিত সমস্যা ছিল। তিনি স্থানীয়ভাবে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
প্রথম ‘লকডাউন’
১৯ মার্চ স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানান, জেলা হিসেবে মাদারীপুর ও জেলাটির শিবচর উপজেলা করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিতে বেশি রয়েছে। প্রয়োজনে শিবচর ও মাদারীপুর ‘লকডাউন’ করা হতে পারে।
কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ঘোষণা
২৫ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ব্রিফিংয়ে জানানো হয়, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি কমিউনিটি ট্রান্সমিশন পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়েনি। তবে সীমিত আকারে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হয়ে থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পরে ১ এপ্রিল দেশে সামান্য মাত্রায় করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন হশুরু হয়েছে বলে জানান জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইপিএইচ) ভাইরোলজিস্ট খন্দকার মাহবুবা জামিল। আর ১৩ এপ্রিল স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানান, দেশে কমিউনিটি পর্যায়ে করোনাভাইরাসের ট্রান্সমিশন শুরু হয়েছে।
মুজিববর্ষের আয়োজনের পরিবর্তন
পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজন করার কথা ছিল মুজিববর্ষ। নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৭ মার্চ পর্যন্ত উদযাপন করার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছিল। পরে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হওয়ায় দেশে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটি জানায়, ব্যাপক প্রস্তুতি থাকলেও দেশের করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখার নিমিত্তে সীমিত আকারে কর্মসূচি পালন করা হবে।
সাধারণ ছুটি ঘোষণা
২৩ মার্চ সচিবালয়ে জরুরি এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম সাধারণ ছুটির ঘোষণা দেন। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে ওই সময় ২৬ মার্চ থেকে ৪ এপ্রিল পর্যন্ত ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়। সাধারণ ছুটির আওতায় সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের অফিস বন্ধ থাকলেও কাঁচাবাজার, খাবার ও ওষুধের দোকান, হাসপাতাল এবং জরুরি সেবা এই সাধারণ ছুটির আওতার বাইরে থাকবে বলে জানানো হয়।
প্রথম হটস্পট নারায়ণগঞ্জ
৯ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে দেশের বিভিন্ন জেলায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় এই জেলাকে করোনাভাইরাসের ‘হটস্পট’ হিসেবে চিহ্নিত করে আইইডিসিআর। ওই দিন ব্রিফিংয়ে অধ্যাপক ডা. মীরজাদি সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, দেশের বিভিন্ন জেলায় বিভিন্ন জেলায় এখন কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। এর অর্থ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। আমরা এখন লক্ষ করছি, বিভিন্ন জেলায় নতুনভাবে যাদের মাঝে সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে, তাদের অনেকেই ক্লাস্টারভুক্ত এলাকা থেকে গিয়েছেন। অনেকগুলো জেলায় যখন রোগীর সঙ্গে কথা হয়েছে, তখন তারা বলেছেন যে নারায়ণগঞ্জ থেকে গেছেন। তাই নারায়ণগঞ্জ জেলাকে করোনাভাইরাসের জন্য হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জকে অন্য সব জেলা থেকে আলাদা করা হয়েছে।
প্রথম চিকিৎসকের মৃত্যু
দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরুর পরে ৫ এপ্রিল সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক (মেডিসিন) ডা. মঈন উদ্দিনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ৭ এপ্রিল তার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে প্রথমে তাকে সিলেটে শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ৮ এপ্রিল সেখান থেকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ১৫ এপ্রিল সকাল পৌনে ৮টার দিকে সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়।
সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা
১৬ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদফতরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় সারাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করেছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। এ অবস্থায় জনগণকে ঘরে থাকা নিশ্চিত ও এক এলাকা থেকে অন্য এলাকায় যানচলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে এবং সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত ঘরের বাইরে বের না হতে নির্দেশ দেওয়া হয়। সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইনের ১১ (১) ধারার ক্ষমতাবলে গোটা বাংলাদেশকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা ঘোষণা করা হয়।
প্রথম বেসরকারি কোভিড-১৯ পিসিআর ল্যাব গাজী গ্রুপের
দেশে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য বেসরকারিভাবে আরটি-পিসিআর ল্যাব স্থাপন করেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী বীরপ্রতীক। নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে অবস্থিত ইউএস-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওই ল্যাব স্থাপন করা হয়। ২৯ এপ্রিল ল্যাবের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতীক)। ভার্চুয়াল সভা সঞ্চালনা করেন গাজী গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক গাজী গোলাম মর্তুজা। দেশের জন্য এগিয়ে এসে বেসরকারিভাবে ল্যাব স্থাপনের জন্য এদিন গাজী গ্রুপকে ধন্যবাদ জানান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পরে দেশের বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকেই করোনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়।
পরামর্শক কমিটি গঠন
গত ১৯ এপ্রিল ১৭ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককে নিয়ে গঠন করা হয় জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি। কমিটিতে সভাপতি করা হয় বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। সদস্য সচিব করা হয় আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরাকে।
জিনোম সিকুয়েন্স
দেশে প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১১ মে জিআইএসএইড-এর কাছে জিনোম সিকুয়েন্স জমা দেয় চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশন (সিএইচআরএফ)। পরে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ (বিসিএসআইআর), চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু), চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানই করোনা নমুনার জিনোম সিকুয়েন্স করেছে।
গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন তৈরির ঘোষণা
করোনাভাইরাস ঠেকাতে ভ্যাকসিন তৈরির জন্য যখন সারাবিশ্ব উঠেপড়ে লেগেছিল, তখন ১ জুলাই বাংলাদেশেই করোনার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের দাবি জানিয়ে গণমাধ্যমে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠায় গ্লোব বায়োটেক। পরদিন ২ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটি জানায়, প্রথম অ্যানিমেল ট্রায়ালে তাদের ভ্যাকসিন সফল হয়েছে। পরে দ্বিতীয় অ্যানিমেল ট্রায়ালে সাফল্য দাবি করে হিউম্যান তথা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার ঘোষণা দেয় গ্লোব। তবে এখন পর্যন্ত ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি তারা সম্পন্ন করতে পারেনি। তাদের আগের দুই পরীক্ষার ফলও কোনো স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশ পায়নি।
শুরু অনলাইন ক্লাস, বাতিল এইচএসসি পরীক্ষা
কোভিড-১৯ সংক্রমণের কারণে দেশে স্কুল কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে গত বছরের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট (জেএসসি) থেকে শুরু করে এইচএসসি পরীক্ষা পর্যন্ত সব পাবলিক পরীক্ষাই বাতিল ঘোষণা করা হয়। পরে জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষার ফলের ওপর ভিত্তি করে এইচএসসি পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, বন্ধের একবছর দুই সপ্তাহ পর আগামী ৩০ মার্চ খুলবে দেশের সব স্কুল-কলেজ।
অ্যান্টিজেন পরীক্ষা
করোনা পরীক্ষার আওতা ও গতি বাড়াতে শুরু থেকেই আরটি-পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি করোনা পরীক্ষার বিকল্প পদ্ধতি চালুর তাগাদা দিয়ে আসছিলেন বিশেষজ্ঞরা। শেষ পর্যন্ত গত ৫ ডিসেম্বর থেকে দেশের ১০টি জেলা শহরে র্যাপিড অ্যান্টিবডি পরীক্ষা শুরু করা হয়। বর্তমানে ৪০টি ল্যাবে র্যাপিড অ্যান্টিজেন পদ্ধতিতে করোনা পরীক্ষা চলছে। যদিও এই পদ্ধতিতে এখন পর্যন্ত তেমন সাড়া মেলেনি।
‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ প্রচারণা
দেশে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়ে কঠোর হতে থাকে সরকার। এর মধ্যে মাস্ক ছাড়া কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানে সার্ভিস না দেওয়ার সিদ্ধান্তের বিষয়ে জানানো হয়। পরে ‘নো মাস্ক, নো সার্ভিস’ ক্যাম্পেইন শুরু করা হয়। মহামারির মধ্যে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক করার জন্য ভ্রাম্যমাণ আদালত নামায় সরকার। একইসঙ্গে সবার মাস্ক পরা নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
গণপরিবহন চলাচল
দেশে ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি কার্যকর করা হয়। এরপর দফায় দফায় বাড়তে থাকে সাধারণ ছুটির মেয়াদ। সাধারণ ছুটির আওতায় গণপরিবহন চলাচলও বন্ধ ছিল। ৬৬ দিন পর ৩০ মে দেশে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেয় সরকার। মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে বন্ধ ছিল অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ফ্লাইটও। পরে ১ জুন থেকে শুরু হয় অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট চলাচল। ১৬ জুন চালু হয় আন্তর্জাতিক ফ্লাইট।
স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি
বছরজুড়ে স্বাস্থ্য খাতের নানা দুর্নীতি ছিল অন্যতম আলোচিত বিষয়। শুরুতেই আলোচনায় আসে চিকিৎসকদের পিপিই সংকটের বিষয়টি। নিম্ন মানের পিপিই নিয়ে আলোচনায় আসে কেন্দ্রীয় ঔষধাগার (সিএমএসডি)। এছাড়াও নমুনা পরীক্ষায় অনিয়ম, ভুল রিপোর্ট ও জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে জেকেজি হেলথকেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতালের বিরুদ্ধে। পরে এই দুই প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তারা গ্রেফতার হন। তারা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছেন।
এদিকে, করোনা মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্যানডেমিক প্রিপেয়ার্ডনেস (ইআরপিপি)’ প্রকল্পের আওতায় বাজারদরের তুলনায় দ্বিগুণ-তিন গুণ দামে সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ, নিম্ন মানের পণ্য সরবরাহ, সঠিক সময়ে পণ্য সরবরাহ না করা, চুক্তির তুলনায় কম পরিমাণ পণ্য সরবরাহের মতো নানা ধরনের অভিযোগ উঠতে থাকে। এসব বিষয় নিয়ে গণমাধ্যমগুলোতে খবর প্রকাশ হলে অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে বেশকিছু প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব তদন্তের কোনো ফল দৃশ্যমান হয়নি।
ভ্যাকসিন পেতে সমঝোতা চুক্তি সই
৫ নভেম্বর সচিবালয়ে করোনাভাইরাস মোকাবিলায় যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ও সুইডেনের ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি অ্যাস্ট্রেজেনেকার তৈরি তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পেতে একটি সমঝোতা স্মারক (এমইউ) সই করে বাংলাদেশ সরকার। অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রেজেনেকার প্যাটেন্টে ভারতের সিরাম ইনস্টিটিউটের তৈরি ‘কোভিশিল্ড’ ব্র্যান্ডের এই ভ্যাকসিন আনতে সিরামের সঙ্গে সরকার ও দেশীয় ওষুধ উৎপাদনকারী বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালসের ত্রিপাক্ষিক চুক্তি হয়। জানানো হয়, মাসে ৫০ লাখ ডোজ করে ছয় মাসে দেশে আসবে তিন কোটি ভ্যাকসিন।
ভ্যাকসিন এলো দেশে
সিরামের কাছ থেকে তিন কোটি ডোজ কিনে আগাম অর্থ পরিশোধ করলেও ভারতের উপহার দেওয়া ভ্যাকসিন প্রথম এসে পৌঁছায় দেশে। ২০ জানুয়ারি ‘কোভিশিল্ড’ ব্র্যান্ডের ২০ লাখ চার হাজার ডোজ ভ্যাকসিন পৌঁছায় দেশে। পরে ২৫ জানুয়ারি সরকারের কেনা ভ্যাকসিনের মধ্যে প্রথম ধাপে ৫০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন দেশে আনা হয়। পরে আরও ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিনও দেশে এসেছে।
ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু
২৭ জানুয়ারি দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই দিন গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কুর্মিটোলা হাসপাতালে এ কার্যক্রম উদ্বোধন করেন তিনি। এর মাধ্যমে দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে করোনা ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু হয়। এদিন প্রাথমিকভাবে ২৬ জনকে ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ২৮ জানুয়ারি দেশে আরও ৫৪১ জনকে ভ্যাকসিন প্রয়োগ করা হয়। পরে ৭ ফেব্রুয়ারি দেশে জাতীয় পর্যায়ে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম শুরু করা হয়।
বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া ভাইরাসটি বাংলাদেশে সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর থেকে নানামুখী চালিয়ে গেলেও এক বছর সময়ে স্বস্তি হয়ে এসেছে সংক্রমণের মাত্রা কমে আসা। একইসঙ্গে ভ্যাকসিন প্রয়োগ কর্মসূচি মানুষের মাঝে মৃত্যুঝুঁকি কমাবে বলেও আশা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এ পরিস্থিতিতেও কেউ ‘রিল্যাক্স’ হতে রাজি নন। তারা বলছেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগ কার্যক্রম চললেও সবাইকেই মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সারাবাংলা/এসবি/একে/টিআর