চ্যালেঞ্জ নিয়ে এগিয়ে যাওয়া দুই নারী পুলিশ কর্মকর্তার গল্প
৮ মার্চ ২০২১ ১৮:৩৪
ঢাকা: বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও নারীরা চ্যালেঞ্জিং পেশাকে ভয় পেতেন। তবে এখন অবস্থান পাল্টে যেতে শুরু করেছে। এগিয়ে আসেন নারীরা।কর্মক্ষেত্রে নারীরা আজ প্রতিষ্ঠিত।
নারী দিবস উপলক্ষে পুলিশে নারীর নানান চ্যালেঞ্জ ও এগিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়ে আজকের আয়োজন। বলছি দুজন নারী পুলিশ কর্মকর্তার নানা প্রতিকুলতা মাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়ার গল্প।
একজন হলেন নৌ পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফরিদা পারভীন, অন্যজন হলেন ডিএমপির মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার মাহমুদা আফরোজ লাকী।
নারী দিবস উপলক্ষে ফরিদা পারভীনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। আলাপচারিতায় উঠে আসে তার জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের কথা। বাবা মায়ের তিন সন্তানই মেয়ে জন্মানোয় শুরুতেই ধাক্কা আসে। এরপরেও সমাজের বেড়াজাল ভেঙে তিন বোনই পড়ালেখা শেষ করে সাবলম্বী হন।
জামালপুর জেলার সরিষাবাড়ি থানায় ফরিদার জন্ম। বাবার চাকরির সূত্রে বড় হয়েছেন টাঙ্গাইল সদরে। বাবা মো. আব্দুর রাজ্জাক পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির প্রকৌশলী এবং মা নিলুফা ইয়াসমিন একজন সাধারণ গৃহিণী। তারা তিন বোন। সমাজের প্রচলিত রীতি না মেনে মেয়েদের লেখাপড়া করে বড় করেন বাবা মা। মেয়েদের মানুষের মতো মানুষ করাই ছিল তাদের ব্রত। টাঙ্গাইলে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ইডেন কলেজ কর্তৃপক্ষ তাকে ভালো ফলাফলের জন্য পুরস্কৃত করে।
ফরিদা ছোটবেলা থেকেই বই পড়তে ভালোবাসতেন। তিনি বিশ্বাস করেন পুরুষশাসিত সমাজে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও পারে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে। সেই বিশ্বাসের ধারাবাহিকতায় ৩১তম বিসিএসের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশ পুলিশে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে নৌ পুলিশ ঢাকায় কর্মরত রয়েছেন।
ফরিদা পুলিশের মতো ব্যস্ত পেশায় থেকেও পরিবার এবং সমাজকে সময় দেন। দাফতরিক কাজের পাশাপাশি নৌ পুলিশের লিগ্যাল, মিডিয়া এবং ট্রেনিংয়ের দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি নৌ পুলিশের বিভিন্ন অভিযানে অংশ নেন। এ সম্পর্কে সিনিয়র কর্তকর্তারা জানান, ফরিদা কোনো কোনো ক্ষেত্রে একজন পুরুষ অফিসারের চেয়েও বেশি কাজ করে থাকেন।
ফরিদাকে একজন যোদ্ধা নারী বললে কম বলা হবে না কারণ তিনি খুব অল্প সময়ে চাকরি ক্ষেত্রে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি নানা সমস্যায় জর্জরিত একজন নারী। বিয়ের পৌনে চার বছরের মাথায় তার স্বামীকে হারান। সে সময় তার দেড় বছরের একটি কন্যা সন্তান ছিল। অন্যদিকে সাড়ে চার মাসের অনাগত সন্তানকে শরীরে ধারন করে ওই কঠিন সময়েও নিজেকে ধীরে ধীরে প্রমাণ করেছেন। বর্তমানে তার তিন বছরের কন্যা রাইম ও এক বছরের পুত্র সন্তান রোরিকে নিয়ে সাহসিকতা ও ধৈর্যের সঙ্গে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন।
ইউনিফর্মে মোড়ানো ফরিদা দেশের সেবায় নিজেকে সদা প্রস্তুত রাখেন। দেশের কল্যাণে মধ্য নদীতে স্পিড বোট নিয়ে ছুটে যান অবৈধ কারেন্ট জাল উদ্ধার করতে। মৎস্য সম্পদ রক্ষায় দুধের বাচ্চা রেখে রাত জেগে নদীতে নদীতে পুরুষ অফিসারদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমানভাবে অভিযানে অংশ নেন।
পুলিশের আরেক এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সম্পন্ন করে যোগ দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জে সহকারী জজ হিসেবে। তিনি ছিলেন দেশের প্রথম নারী জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু তাতে মন ভরেনি তার, সবসময় চ্যালেঞ্জ নিতে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। চ্যালেঞ্জিং কিছু করা এবং সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করার অদম্য ইচ্ছা থেকেই যোগ দেন বাংলাদেশ পুলিশে।
২০১০ সালে বিসিএস করে এএসপি হিসেবে যোগ দেন পুলিশে। সারদা পুলিশ একাডেমিতে ট্রেনিংয়ে নারী-পুরুষ মিলিয়ে সকল ব্যাচমেটদের মধ্যে প্রথম হয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন নিজের সক্ষমতা। এরপর সফলতার সঙ্গে দায়িত্বপালন করেছেন ডিএমপি সদর দফতর ও মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশে। পেয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ পদক পিপিএম। বর্তমানে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন ডিএমপি মিরপুর বিভাগের দারুস সালাম জোনের অতিরিক্ত উপ কমিশনার হিসেবে।
রাজধানীর সর্বপ্রথম করোনার হটস্পট হিসেবে চিহ্নিত হওয়া টোলারবাগ ছিলো এডিসি লাকীর দায়িত্বাধীন আওতাধীন। প্রথম থেকেই করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় তার নেওয়া নানা উদ্যোগ সর্বস্তরে প্রশংসা পেয়েছিল।
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে এডিসি মাহমুদা আফরোজ লাকী বলেন, ‘৮ মার্চ নারীদের জন্য নতুন করে শপথ গ্রহণের-নতুন কর্মপরিকল্পনা সাজানোর দিন।’
নিজে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেন তাই প্রত্যেকটা নারীকেই চ্যালেঞ্জ গ্রহণের আহ্বান তার। একজন ছেলে হিসেবে যা করতে পারে, তার সবই মেয়েরাও করতে পারে।
ফরিদা পারভীনের মতো লাকীরাও ছিলেন তিন বোন। ফরিদার মতো তারও কোনো ভাই নেই। তবে এ নিয়ে বাবা মা কখনোই দুঃখ না করলেও আত্মীয় স্বজন অনেক কথা শোনাত। বিয়ে হলে চলে যাবে। সব সম্পত্তি অন্য ছেলে পাবে। আত্মীয়-স্বজনদের এই বিষয়টা ছোট বেলা থেকেই মনের মধ্যে কষ্ট দিতো। একটা জেদ থেকেই ভেবেছি, এমন কিছু করবো যাতে কেউ কখনো বাবার নাম ধরে বলতে না পারে, যে তার কোন ছেলে নেই।
জেদ থেকেই নিজের পায়ে দাঁড়ানো। আইন বিষয়ক পড়াশোনা শেষ করে আমি সহকারী জজ হিসেবে যোগদান করেছিলাম নারায়নগঞ্জে। আমিই প্রথম নারী জুডিস্যিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট। কিন্তু তারপরেও মন মানেনি। মনে হয়েছে, আরো কিছু করা দরকার, যেটা আরও বেশি চ্যালেঞ্জিং। যাতে সবাই ভাবতে পারে ছেলে হয়নি, কিন্তু ছেলের চেয়ে বেশি কিছু। মনের সেই জেদটাই এতোদূর নিয়ে এসেছে। আমার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখ থেক মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতাম। সেসব গল্প শুনে মুক্তিযুদ্ধে যেতে না পারার আক্ষেপ কাজ করতো। সবসময় মনে হয়েছে দেশের জন্য কিছু করতে হবে, মানুষের জন্য কিছু করতে হবে। যেখান থেকে সরাসরি মানুষের জন্য কিছু করা যায়, মানুষের পাশে দাঁড়ানো যায়।
পুলিশে নারী কম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ পুলিশে মাত্র সাড়ে সাত শতাংশ নারী। এটা কমপক্ষে ১০ শতাংশ হওয়া উচিৎ। জনসংখ্যার হিসেবে আমাদের নারী-পুরুষের সংখ্যা প্রায় সমান এবং সমস্যাও কিন্তু সমান। নারী-পুরুষ মিলেই সমাজ, সমাজ মানেই দুই ধরনের সমস্যাই আমাদের দেখতে হচ্ছে। এ জন্যই আমার মনে হয় এখনো আমাদের ঘাটতিটা পূরণে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোটার মাধ্যমে নারী অংশটা পুরণ হওয়া দরকার। এরপর কোটা না থাকলেও সমস্যা নেই বলে মনে করি।’
পুলিশে চ্যালেঞ্জের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু একজন অফিসারই নই, একাধারে একজন মা ও একজন স্ত্রী। আমাকে কিন্তু অফিসের কাজের পাশাপাশি আমার পরিবার-সন্তানকে সময় দিতে হয়। পুলিশে আমাদের কাজটা কিন্তু ২৪ ঘণ্টার, রাত ২ টার সময়ও কোনো দরকারে আমাকে বেরিয়ে যেতে হচ্ছে। আবার প্রয়োজনে গভীর রাত পর্যন্ত আমাকে বাইরে থাকতে হচ্ছে। একটা মেয়ের জন্য এই চ্যালেঞ্জটা নিতেই হয়।’
কিন্তু আমি দেখেছি একজন নারী কসাই, একজন নারী ভ্যান চালাচ্ছেন, রিকশা চালাচ্ছেন। তারা তাদের সংসারকে-পরিবারকে বাঁচানোর জন্য যে যুদ্ধ করছে, আমাকে সেটি করতে হচ্ছে না। আমি তাদেরকে দেখে অনুপ্রাণিত হই। আমি এভাবে দেখি, তারা যেহেতু এসব পারছে তাহলে আমরা মেয়েরা কেন পারব না?
আমি ৮ মার্চকে ভিন্নভাবে দেখি। আমি নতুন কিছু টার্গেট করব, আগামী ৮ মার্চ আসার আগে সে সব পূরণ করব। আগামী ৮ মার্চে পেছনে তাকিয়ে দেখবো কতটুকু করতে পেরেছি, এ থেকে আমাদের কী কী ভুল ছিল, কী কী করার ছিল, নতুন ৮ মার্চ আমরা নতুন আরেকটা টার্গেট নেব। আমার মনে হয় এভাবে করে এগিয়ে যাওয়ার জন্যই এই ৮ মার্চ।
কিছু প্রতিবন্ধকতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘সারাদিন এমন কোথাও দাঁড়িয়ে ডিউটি করতে হয় যেখানে কোন পাবলিক টয়লেট নেই, এটা মেয়েদের জন্য খুবই দুঃখজনক। বাড়ির মেয়েটা পুরুষের মতো পোষাক পরে পুরুষের মতো ডিউটি করবে, এটাকে অনেকে নিতে পারেন না। যার ফলে পরিবার থেকেও অনেক সময় মেয়েদেরকে এই পেশায় আসতে দিতে চায় না।’
নারীদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রথমে বলবো- হতাশ হওয়া যাবে না। আজকে আমাকেও এ পর্যায়ে আসতে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। চলতে গেলে পথে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত অনেক প্রতিবন্ধকতা আসবে। কিন্তু সবসময় মনে রাখতে হবে আমি এগিয়ে যেতে চাই, এরজন্য আমাকে পরিশ্রম করতে হবে, আমাকে মেধা খরচ করতে হবে। এটা করতে পারলে অবশ্যই সে এগিয়ে যাবে। আরেকটা বিষয় কেউ যদি সততা নিয়ে কাজ করে, আমার বিশ্বাস প্রকৃতির কাছ থেকে সেটার প্রতিদান সে পাবেই। বর্তমান সময়ে একটা অস্থিরতা দেখি সবার মধ্যে। অল্প সময়ের মধ্যে উপরে উঠতে হবে, সেলিব্রেটি হতে হবে, ভালো বেতনে চাকরি পেতে হবে এমন প্রবণতা। এ জায়গাটা থেকে একটু সরে গিয়ে সবাইকে একটু স্থির হতে হবে। নিজের ভেতরে চিন্তার গভীরতা আনতে হবে।’
পুলিশ সদর দফতর থেকে জানা যায়, পুলিশে বর্তমানে নারী সদস্য সংখ্যা ১৫ হাজার ১৬৩ জন। এর মধ্যে ডিআইজি পদ মর্যাদার দুইজন, অতিরিক্ত ডিআইজি তিনজন, পুলিশ সুপার পদ মর্যাদার ৭১ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মর্যাদার ১১০ জন, সহকারী পুলিশ সুপার মর্যাদার ৯৯ জন, পুলিশ পরিদর্শক ১০৯ জন, সাব ইনস্পেক্টর ৭৯৭ জন, সার্জেট ৫৮ জন, এএসআই এক হাজার ১০৯ জন, নায়েক ২১১ জন এবং কনস্টেবল ১২ হাজার ৫৯৪ জন।