“আমার কমিউনিটি, আমার দায়িত্ব”
২১ মার্চ ২০১৮ ১৯:৫০
“আমার কমিউনিটি, আমার দায়িত্ব” এবারের ৫ম জাতীয় ও ১৩তম বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস-২০১৮ এর প্রতিপাদ্য বিষয়। দিবস উদযাপনকে কেন্দ্র করে আজকের আমার এই লেখা।
গর্ভে আসার পর থেকেই একটি সুস্থ, সুন্দর শিশুর স্বপ্ন দেখেন মা। লালন করেন অনেক স্বপ্ন। কিন্তু একটি বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু যাকে আমাদের সমাজ ‘প্রতিবন্ধী’ আখ্যায়িত করে- সেই শিশুর জন্মের সঙ্গে সঙ্গে মা-বাবা, পুরো পরিবারের স্বপ্নময় জীবনে ছন্দ পতন হয়। একটি পরিবারে বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশু থাকলে- শিশুটির মা-বাবা এবং অন্য সদস্যদের যে শারীরিক-মানসিক কষ্ট হয়, তা সুস্থ সন্তানের পরিবারের পক্ষে ধারণা করাও কঠিন। প্রতিটি প্রতিবন্ধিতা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে স্বতন্ত্র, প্রতিটির ভিন্ন নাম আছে- এই ধারণাও খুব কম মানুষের আছে।
বাংলাদেশে অটিজম ও এনডিডি শব্দ দু’টি বহুল আলোচিত এবং পরিচিত। আরও একবার বলে রাখা ভালো, এনডিডিতে মূলত চার ধরনের প্রতিবন্ধিতা অন্তর্ভুক্ত। সেগুলো হলো ডাউন সিনড্রোম, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা। যদিও অনেকে যে কোনো প্রতিবন্ধিতাই ‘অটিজম’ বিবেচনা করেন, অটিজমকে অন্যান্য প্রতিবন্ধিতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। ফলে অন্যান্য এনডিডি বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন শিশু বা ব্যক্তি’র আত্মপরিচয়ের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করছে বলে মনে হয়।
অনেক সময় বিভিন্ন গণমাধ্যম এবং প্রতিবন্ধিতা বিষয়ক ওয়েব পোর্টালও একই ধরনের বিভ্রান্তি দেখা যায়। তাই অটিজম ও অন্যান্য নিউরো ডিভালাপমেন্টাল ডিসঅর্ডার (এনডিডি) বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন প্রতিবন্ধিতা সম্পর্কে সবাইকে সঠিক ধারণা দেওয়া জরুরি।
ডাউন সিনড্রোম: ডাউন সিনড্রোম বংশানুগতিক কোনো সমস্যা না। ২১তম ক্রোমসোম জোড়ায় একটি অতিরিক্ত ক্রোমসোমের উপস্থিতির কারণে বুদ্ধিভিত্তিক কাজ করতে, পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। এছাড়াও মাংসপেশির শিথিলতা, কম উচ্চতা, চ্যাপ্টা নাক, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা, বয়স উপযোগী কাজে সীমাবদ্ধতা দেখা যায়।
সেরিব্রাল পালসি: সেরিব্রাল পালসি এক ধরনের শারীরিক প্রতিবন্ধিতা। মাথার মাঝখানের অংশ (গুরু মস্তিষ্কের মোটর অঞ্চল) অর্থাৎ যে অংশটি শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়ার জন্য দায়ী, সেখানে কোনো পক্ষাঘাত হলে ব্যক্তি সেরিব্রাল পালসি-এ আক্রান্ত হন। দেখা যায়, শরীরিক প্রতিবন্ধীদের মধ্যে প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ শিশুই সেরিব্রাল পলসি-এ আক্রান্ত।
অটিজম: মস্তিষ্কের বিন্যাসগত বা পরিব্যাপক বিকাশগত সমস্যা অটিজম। এর লক্ষণ শিশুর জন্মের তিন বছরের মধ্যে প্রকাশ পায়। অটিজমকে বিশেষজ্ঞরা স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার আখ্যায়িত করছেন। যার ফলে সামান্য থেকে গুরুতর সমস্যাগ্রস্ত শিশুরা এর আওতায় চলে আসছে। অটিজমের সঠিক কোনো কারণ কিংবা বিশেষ কারণগুলো এখন পর্যন্ত চিহ্নিত করা যায়নি। তবে এটা নিশ্চিত, শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণ অটিজমের জন্য দায়ী না। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের অস্বাভাবিক গঠন ও কার্যকারিতা অটিজমের জন্য দায়ী। আবার শরীরে নিউরো কেমিক্যাল ক্রিয়ার অসমতাও অটিজমের কারণ হতে পারে। তবে বাবা-মায়ের কোনোভাবেই মনে করা ঠিক না, তাদের সময় না দেওয়া বা যত্নের ঘাটতির কারণে শিশু অটিজমে আক্রান্ত হয়েছে।
বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা: সহজ করে বলতে গেলে গড় বুদ্ধির চেয়ে সুস্পষ্টভাবে কম বুদ্ধি মনে হয়। এই অবস্থা বাড়ন্ত বয়সে প্রকাশ পায়। শিশুর বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা বা মনো-সামাজিক প্রতিবন্ধিতা হলো একটি বিকাশজনিত সমস্যা।
বয়স উপযোগী কাজে সীমাবদ্ধতা;
কার্যকারণ বিশ্লেষণ, শিক্ষণ বা সমস্যা সমাধানে সীমাবদ্ধতা;
দৈনন্দিন কাজের দক্ষতায় সীমাবদ্ধতা, (যোগাযোগ, নিজের যত্ন নেওয়া);
বুদ্ধাঙ্ক স্বাভাবিক মাত্রা অপেক্ষা কম;
এখানে মনে রাখতে হবে ডাউন সিনড্রোম, অটিজম, সেরিব্রাল পালসি এবং বুদ্ধি প্রতিবন্ধিতা হলো জীবনব্যাপী নিউরো-ডিভালাপমেন্টাল ডিসঅর্ডার। যার কোনো যাদুকরী চিকিৎসা বা রাতারাতি সমাধান নেই। সঠিক প্রশিক্ষণ, স্কুল এবং বাসার কাজের সমন্বয়ই পারে একজন শিশুকে তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, এই সব সন্তানদের যত দ্রুত সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা যাবে তত দ্রুত তারা তাদের সবল দিককে কাজে লাগিয়ে দুর্বল দিকগুলো কাটিয়ে সমাজে আর দশজন মানুষের মতো গড়ে উঠতে পারবে। আসুন তাদের দূরে ঠেলে না দিয়ে আমাদের ভালবাসা, সহমর্মিতা দিয়ে একীভূত সমাজে সম্মানজনক অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করি।
লেখক: মারুফা হোসেন, পরিচালক, তরী ফাউন্ডেশন ও স্কুল ফর গিফটেড চিলড্রেন (এসজিসি)