সক্রিয় হওয়ার চেষ্টায় নিষিদ্ধ হিযবুত তাহরীর, টার্গেট শিক্ষার্থীরা
১১ মার্চ ২০২১ ০০:৪৪
ঢাকা: হঠাৎ করে সক্রিয় হয়ে উঠেছে হিযবুত তাহরীর। নিষিদ্ধ ঘোষিত এই সংগঠনটি রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় পোস্টারিং করেছে। খিলাফত রাষ্ট্র ধ্বংসের একশ বছর শিরোনামের এই পোস্টারে ‘বিশ্বের একশ শহর থেকে মুসলিম উম্মাহর প্রতি খিলাফত প্রতিষ্ঠা’র আহ্বান জানানো হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের টার্গেট করে মোবাইলে পাঠানো হয়েছে এসএমএস। এর বাইরেও ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল খুলে প্রচারণা চালাচ্ছে সংগঠনটি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, খিলাফতের ডাক দেওয়া পোস্টার দেশের মানুষকে যতটা না প্রভাবিত করবে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে পারে শিক্ষার্থীদের পাঠানো দাওয়াতি মেসেজ। শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেউ কেউ তাদের ফাঁদে পা দিতে পারে— এমন আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে নিরাপত্তা বাহিনী বলছে, তারা এসব কার্যক্রমকে নজরদারির মধ্যেই রেখেছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও চলমান রয়েছে।
বুধবার (১০ মার্চ) রাজধানীর সেগুনবাগিচা, সায়েন্স ল্যাব, ধানমন্ডি, জিগাতলা, শঙ্কর, মোহাম্মদপুর, মতিঝিল, লালবাগ, আজিমপুর, শাহবাগ, কাটাবন এলাকার বিভিন্ন দেয়ালে হিযবুত তাহরীরের এসব পোস্টার দেখা যায়। অনেককেই পোস্টার পড়তে দেখা গেছে। তাদের কেউ কেউ বলছেন, এটি কোনো জঙ্গি সংগঠনের কাজ। কেউ বলছেন, দেশের মানুষকে এত সহজে কেউ ভুল পথে পরিচালিত করতে পারবে না। সচেতন নাগরিকদের অনেকেই বিস্ময় প্রকাশ করে বলছেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার চোখ ফাঁকি দিয়ে নিষিদ্ধ একটি সংগঠন কিভাবে এত পোস্টার দিয়ে ছেয়ে দিয়েছে রাজধানীকে!
জানা গেছে, রাতে যখন সড়কগুলো যখন প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে, ঠিক তখনই কে বা কারা এসব পোস্টার লাগিয়েছে। এমনকি রমনা থানার বিপরীত পাশের দেয়ালেও দেখা গেছে এই পোস্টার।
পোস্টার লাগানোর বিষয়ে জানতে চাইলে রমনা থানার একজন পরিদর্শক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, রাতের বেলা সচরাচর স্কুল-কলেজে ভর্তি, কোচিং সেন্টার ও ওয়াজ মাহফিলের পোস্টার লাগানো হয়ে থাকে। মঙ্গলবার (৯ মার্চ) রাতে সুযোগ বুঝে কে বা কারা হিযবুত তাহরীরের পোস্টার লাগিয়েছে। তাদের পরিচয় জানা যায়নি। তবে এখন থেকে আমরা সজাগ রয়েছি।
কেবল রাজধানী ঢাকা নয়, এর আগে ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহে সিলেট মহানগরীতেও হিযবুত তাহরীরের এসব পোস্টার দেখা গেছে। ওই পোস্টারগুলোতেও খিলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দেওয়া হয়।
এমন সময়ে রাজধানী ঢাকায় হিযবুত তাহরীরের এসব পোস্টার লাগানো হয়েছে, যখন করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখেও সাড়ম্বরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের আয়োজন চলছে। একইসঙ্গে চলছে মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি। এসব আয়োজনে বিদেশি রাষ্ট্রনেতাদেরও বাংলাদেশে আসার কথা রয়েছে।
কেবল পোস্টারিং নয়, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও সক্রিয় হয়ে উঠেছে হিযবুত তাহরীর। গত ১৩ ফেব্রুয়ারি খিলাফতের আহ্বান জানিয়ে ফেসবুকে একটি পেজ খোলা হয়েছে। একদিন পর ১৫ ফেব্রুয়ারি একই নামে খোলা হয়েছে একটি ইউটিউব চ্যানেল। এর মধ্যে ইউটিউব চ্যানেলটিতে পাঁচটি ভিডিও দেখা গেছে। চ্যানেলটির সাবস্ক্রাইবার মাত্র ১৩ জন হলেও পাঁচটি ভিডিও’র মধ্যে একটি ভিডিও’র ভিউ (দর্শক) ছিল সাত হাজার তিনশ।
অন্যদিকে, ফেসবুক পেজটিতে এরই মধ্যে যুক্ত হয়েছেন ৭৪৬ জন অনুসারী। পেজটিতে রয়েছে শতাধিক পোস্ট, যার মধ্যে রয়েছে অনেকগুলো ভিডিও। এসব পোস্টে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি চলমান রাষ্ট্রব্যবস্থার সমালোচনাও করা হয়েছে। আর এই ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের লিংকগুলোই এসএমএস করে পাঠানো হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের।
হিযবুত তাহরীরের পাঠানো মেসেজ পেয়েছেন— এমন তথ্য জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। তাদের অন্তত ১০ জনের মোবাইল ফোনে আসা এসএমএসের স্ক্রিনশট সংরক্ষিত রয়েছে। এসব শিক্ষার্থীরা এই বার্তাকে ‘উগ্রবাদী’ তৎপরতা হিসেবে বিবেচনা করছেন। তারা বলছেন, একটি নিষিদ্ধ সংগঠন যেভাবে প্রচারণা চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আরও সক্রিয় তৎপরতা প্রয়োজন। খিলাফতের নাম করে পাঠানো এসব বার্তায় কেউ কেউ উদ্বুদ্ধ হতেই পারে— এমন ধারণাকেও উড়িয়ে দিতে পারছেন না তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, কোভিড-১৯-এর কারণে জঙ্গি সংগঠনগুলো অনলাইন প্রচারণা বাড়িয়েছে। কেউ ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। সবাই ঘরের মধ্যে সময় পার করছে। আমার ধারণা, এই সুযোগটাকে কাজে লাগিয়েছে হিযবুত তাহরীর। এজন্য তারা মেসেজ দিয়ে দাওয়াত দিচ্ছে। আবার তারা সুযোগ বুঝে পোস্টারিংও করেছে।
এ বিষয়ে নিরাপত্তা বাহিনীকে আরও সক্রিয় হওয়ার তাগাদা দিয়েছেন সাখাওয়াত হোসেন। তিনি বলেন, এর থেকে পরিত্রাণ পেতে সব গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সক্রিয় হতে হবে। এদের সোর্সিংটা খুঁজে বের করতে হবে। কারা পোস্টারিং করছে, চেষ্টা করলে তাদের হয়তো ধরাও সম্ভব।
পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা সারাবাংলাকে জানান, হিযবুত তাহরীরের কার্যক্রমের ওপর নজরদারি চলছে। এসএমএস পাঠানো বা পোস্টারিংয়ের সঙ্গে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতেও কাজ চলছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, দেশে জঙ্গি তৎপরতা ও উগ্র ইসলামি সংগঠন হিসেবে এরই মধ্যে আট জঙ্গি সংগঠনকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০০৯ সালের ২২ অক্টোবর হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। তবে নিষিদ্ধ হলেও হিযবুত তাহরীরের তৎপরতা বন্ধ ছিল— এমনটি বলা যায় না। কেননা, নিষিদ্ধ হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত মাঝে মাঝেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হিযবুত তাহরীরের সদস্যরা গ্রেফতার হয়েছেন।
সবশেষ গত বৃহস্পতিবারও রাজধানীর সূত্রাপুর এলাকা থেকে এই সংগঠনের তিন সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এছাড়া ২০১৮ সালের ২৬ নভেম্বর রাজধানীতে মিছিল করতে দেখা যায় হিযবুত তাহরীরকে। ২০১৯ সালের মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনের আগেও হিযবুত তাহরীরের বেশকিছু পোস্টার দেখা যায় ঢাবি এলাকায়।
জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, হিযবুত তাহরীর একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। তাদের ওপর আমাদের নজরদারি রয়েছে। এদের অনেককেই ধরা হয়েছে। কিন্তু এরা অহিংস (নন-ভায়োলেন্ট) হওয়ায় আদালত থেকে জামিন পেয়েছে। এরকম অনেকেই জামিন পেয়ে পরে আবারও একই ধরনের কাজ করেছে। কিছুদিন আগেও সূত্রাপুর ও মোহাম্মদপুর থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এটি চলমান প্রক্রিয়া।
তিনি আরও বলেন, তাদের ওপর আগেও নজরদারি ছিল, এখনো আছে। এর আগেও বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ ও অ্যাকাউন্ট ডাউন (বন্ধ) করা হয়েছে। ওয়েবসাইট বন্ধ করা হয়েছে। যেহেতু তারা নিষিদ্ধ সংগঠন, তাই তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তাদের ওপর নজরদারি অব্যাহত রয়েছে।
হিযবুত তাহরীরের সবশেষ এসব তৎপরতা নিয়ে জানতে চাইলে সাইফুল ইসলাম বলেন, বিদেশে থেকেও অনেকে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যক্রমে জড়িত আছে। পোস্টারিংয়ের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা তাদের ধরতে কাজ করছি। আর কোনো সংরক্ষিত ডাটাবেজ থেকে নম্বর নিয়েই তারা শিক্ষার্থীদের মেসেজ পাঠাচ্ছে। এই বিষয়টিও আমরা দেখছি। তারা আমাদের নজরদারির মধ্যেই আছে।
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর