ইউপিতে নৌকা পাবেন যোগ্য ও ত্যাগীরা, ‘মাইম্যান’দের সুযোগ নেই
১৩ মার্চ ২০২১ ০৯:২০
ঢাকা: আসছে এপ্রিলের ১১ ধাপে দেশে ২০ জেলার ৩৭১ ইউনিয়ন পরিষদে প্রথম ধাপের ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ভোট হবে। এরই মধ্যে এর জন্য মনোনয়ন ফরম বিক্রির কার্যক্রম শেষ হয়েছে। নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন, তথা নৌকা প্রতীক পেতে এরই মধ্যে আগ্রহীরা তোড়জোর শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ বলছে, মনোনয়নপ্রত্যাশী যতই থাকুক না কেন, মনোনয়নের শিঁকে ছিঁড়বে শেষ পর্যন্ত যোগ্য এবং দলের দুঃসময়-দুর্দিনের পরীক্ষিত ও ত্যাগীদের।
দলের হাইকমান্ড বলছে, স্থানীয় রাজনীতির ‘আমলনামা’য় যোগ্য এবং ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারাই এগিয়ে আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গুড বুকে। এই ‘আমলনামা’র ওপর ভিত্তি করেই নির্ধারিত হবে ইউপি নির্বাচনের মনোনয়ন। এ ক্ষেত্রে করোনাকালে ত্রাণ আত্মসাৎসহ বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িতদের কপাল পুড়বে নিশ্চিতভাবেই। একইসঙ্গে পৌর নির্বাচনের মতোই এই নির্বাচনেও কঠোরতা থাকবে অতীতের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ ও সাংগঠনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া নেতাদের বিরুদ্ধে। এছাড়া স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ জনপ্রতিনিধিরা নিজেদের অনুসারীদের নাম প্রস্তাব করলেও এসব ‘মাইম্যান’দের কপালে মনোনয়ন জুটবে না।
এর আগে, ১১ এপ্রিলের প্রথম ধাপের ইউপি নির্বাচন সামনে রেখে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে একটি চিঠি পাঠিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এতে দলের গঠনতন্ত্রের অনুচ্ছেদ ২৮(৩)(ঙ) অনুযায়ী আগ্রহী প্রার্থীদের প্যানেল তৈরির জন্য সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ বর্ধিত সভা আয়োজন ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে প্রার্থীদের একটি প্যানেল সুপারিশের জন্য কেন্দ্রে পাঠানোর আহ্বান করা হয়েছিল। জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সইয়ে নির্বাচন কমিশনের তফসিল অনুযায়ী ওই প্যানেল ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয়ে জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কেন্দ্রের এই নির্দেশনা অনেক এলাকাতেই মানা হয়নি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাসহ কিছু কিছু সংসদ সদস্য কোনো প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে না গিয়ে নিজেদের অনুসারীদের নাম প্যানেল আকারে পাঠিয়েছেন কেন্দ্রে। অনেক সংসদ সদস্য আবার জেলা বা উপজেলা আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে পৃথকভাবে নিজের অনুসারীদের নাম পাঠিয়েছেন কেন্দ্রে। এতে, যারা দুঃসময়ে দল করেছেন, কিংবা ত্যাগী ও জনগণের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি রয়েছে যাদের, তারা বাদ পড়েছেন। অনেক স্থানে বর্তমান চেয়ারম্যানদের নাম বাদ দিয়ে কেন্দ্রে তালিকা পাঠানো হয়েছে।
সূত্র বলছে, গাজীপুর জেলার দুই উপজেলায় স্থানীয় সংসদ সদস্যের হস্তক্ষেপে বর্তমান জনপ্রিয় ও পরীক্ষিত চেয়ারম্যানদের নাম বাদ দেওয়া হয়েছে তালিকা থেকে। পরবর্তী সময়ে জেলা আওয়ামী লীগের হস্তক্ষেপে ওইসব চেয়ারম্যান প্রার্থীদের নাম কেন্দ্রে পাঠিয়ে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমাদানের ব্যবস্থা করা হয়।
নেতাদের অভিযোগ, স্থানীয় সংসদ সদস্য বা নেতারা যাদের প্রার্থী হিসেবে চাইছেন, তাদের ‘নানা’ প্রক্রিয়ায় প্রার্থী করে কেন্দ্রে নাম পাঠানো হচ্ছে। আবার কাউকে মৌখিকভাবে ‘বিদ্রোহী’ হিসেবে চিহ্নিত করে দলীয় মনোনয়ন ফরম গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করার অনৈতিক পথও বেছে নিয়েছেন কেউ কেউ।
তবে কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, তৃণমূলের এই ‘মাইম্যান’ অশুভ প্রবণতা থামাতে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তির হাতেই নৌকা উপহার দেবেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে এর আগে যারা ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হয়েছিলেন, তারা মনোনয়ন পাবেন না। এরকম ‘বিদ্রোহী’দের তালিকাও জমা হয়েছে কেন্দ্রে। এরকম প্রার্থীর নামের তালিকা সারাবাংলার হাতে এসেছে।
আজ শনিবার (১৩ মার্চ) দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় দলের সংসদীয় বোর্ড ও স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধি মনোনয়ন বোর্ডের যৌথসভা রয়েছে। কেন্দ্রীয় একাধিক নেতারা সারাবাংলাকে বলেছেন, সার্বিক বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই প্রার্থিতা চূড়ান্ত করা হবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর আরেক সদস্য ও মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য আব্দুর রহমান সারাবাংলাকে বলেন, দলের প্রতি আনুগত্য আছে এবং মানুষের কাছে যাদের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে— তাদেরই দল থেকে মূল্যায়ন করা হবে। নৌকা প্রতীক তাদেরই দেওয়া হবে, যারা দলের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতাকর্মী। যোগ্যতার বিচারে মনোনয়ন নির্ধারিত হবে। এ ক্ষেত্রে অন্যায্য কোনো সুপারিশ গ্রহণযোগ্য হবে না।
এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক সারাবাংলাকে বলেন, একটি শুভ দিক বিবেচনা করেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয় প্রতীকে করার সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দলীয় প্রতীকে নির্বাচন করতে তৃণমূল থেকে যোগ্য প্রার্থীদের প্যানেল চাওয়া হলেও অনেকেই ঔদ্ধত্য দেখিয়েছেন। কেন্দ্রের নির্দেশ অমান্য করে ‘মাইম্যান’ তৈরির জন্য নিজেদের পছন্দের লোকজনদের নাম পাঠিয়েছেন। তারা কেউ কেউ একজনের নাম পাঠাচ্ছেন। এই একজনের নাম পাঠানো— এটি একটি অশুভ ইঙ্গিত। দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যারা দীর্ঘদিন ধরে ত্যাগ স্বীকার করছেন, তাদের তাহলে কী হবে?
নানক বলেন, যদি তৃণমূল থেকে পাঁচ জন, সাত জন বা ১০ জনের নাম কেন্দ্রে পাঠানো হতো, অন্তত ত্যাগী নেতারা এটুকু বুঝতেন যে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা তাদের যোগ্য মনে করেন। মনোনয়ন বোর্ড তো একজনের বেশি মনোনয়ন দিতে পারবে না। ফলে কেন্দ্রে পাঠানো নামের তালিকায় থাকলেও মনোনয়ন বোর্ড থেকে বাদ পড়লেও তারা ওটুকু তৃপ্ত পেতেন যে তারা অন্তত যোগ্য।
জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, অনেক আত্মত্যাগী মানুষ আছেন, যাদের নাম পাঠানো হয়নি। তবে জেলা-উপজেলা পর্যায় থেকে নাম পাঠানো হয়নি— এমন পুরনো ও ত্যাগী অনেককে ঢাকা থেকে মনোনয়ন ফরম দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে নাম না আসায় যেহেতু তারা বঞ্চিত হয়েছেন, তাই তাদের ঢাকা থেকে ফরম কেনার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে।
দলের সভাপতিমণ্ডলীর এই সদস্য আরও বলেন, আামি বলতে পারি— এ বিষয়গুলো নেত্রী শেখ হাসিনার নলেজে আছে। তিনি গুরুত্ব দিয়ে বিষয়গুলো বিবেচনা করছেন। গত পৌরসভা নির্বাচনেও এরকম অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাদের তিনি মনোনয়ন দিয়েছেন। এই নির্বাচনেও আমরা বিষয়গুলো বিবেচনা করছি। আমি অন্তত ব্যক্তিগতভাবে এই বিষয়গুলো নেত্রীর সামনে তুলে ধরব।
সারাবাংলা/এনআর/টিআর