আনুশকা-মৌমিতার মৃত্যু কলাবাগানে ছড়িয়েছে আতঙ্ক
১৩ মার্চ ২০২১ ১৪:০৮
ঢাকা: বিকৃত যৌনাচারে ধর্ষণের ফলে আনুশকা নূর আমিন নিহতের ঘটনায় ফরেনসিক প্রতিবেদন হাতে না পেতেই আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর মৃত্যুতে রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় পরিবার থেকে যাদের দায়ী করা হচ্ছে, তারা মুলত সকলেই ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থী।
কলাবাগান এলাকার আতঙ্কিত পরিবারগুলো বলছে, যারা আনুশকা ও তাজরিয়ান মোস্তফা মৌমিতার মৃত্যুর জন্য দায়ী তারা সকলেই আশেপাশের এলাকাতেই থাকেন। তাদের চলাফেরার গণ্ডিও প্রায় একই। তাদের পড়াশোনা ইংরেজি মাধ্যমের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। একে অপরকে চেনেন তারা।
কলাবাগান থানাধীন ধানমন্ডি ৮ নম্বর সড়কের দুই নম্বর ভবনের চতুর্থ তলায় পরিবারের সঙ্গে থাকতেন তাজরিয়ান মোস্তফা মৌমিতা (২০)। মালয়েশিয়ার এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা করতেন তিনি। বাবা মায়ের সঙ্গে গত বছরের ১৮ জুলাই ঢাকায় এসে সপরিবারে ওই বাসায় ওঠেন। এরপর গত ২৬ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ছাদে ওঠে এবং সন্ধ্যার পর ওই ভবনের পেছনের স্টাফ কোয়ার্টারের সড়ক থেকে মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়।
পরিবারের অভিযোগ, ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে একই ভবনের ষষ্ঠ তলার বাসকারী ফাইয়াজ ও তার বন্ধুরা মিলে মৌমিতাকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে।
একই ভবনের পঞ্চম তলার বাসিন্দা সানজিদা আফরিন ঐশি সারাবাংলাকে বলেন, ‘কিছুদিন আগে লেক সার্কাস রোডে আনুশকাকে ধর্ষণের পর হত্যা করলো তারই বন্ধুরা। আজ আমাদের ভবনে মৌমিতাকে ধর্ষণ চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে ফেলে হত্যা করা হলো। না জানি কবে আমাদের ঘরে এরকম ঘটনা ঘটে। ছেলে-মেয়ে বড় হয়েছে। তাদেরও বন্ধু বান্ধব রয়েছে। সতর্ক রয়েছি তবুও আতঙ্কে আছি। মেয়েদের প্রতি বিশেষ নজর রাখছি। কার সঙ্গে কথা বলছে, কোথায় যাচ্ছে, কার সঙ্গে মিশছে, ফোনে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কী ধরনের কাজ করছে সবকিছুই বাধ্য হয়ে নজরে রাখছি। এরপরও সারাটি সময় আতঙ্কে থাকছি।’
একই ভবনের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা তাবাসসুম রহমান বলেন, ‘কিছুদিন হয়েছে মৌমিতার সঙ্গে লিফটে পরিচয় হয়েছে। অনেক ভালো ছিল মৌমিতা। কি থেকে কী হয়ে গেল বুঝতে পারছি না। আতঙ্ক রয়েছে সবাই।’
পুলিশ আদনান নামে একজনকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু আদনান তো এই ভবনে থাকেন না। ফাইয়াজের বন্ধু সে। এর আগে ওদের বন্ধু দিহানের হাতে আনুশকা মারা গেছে। দুটি ঘটনায় পুলিশ এখনো কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি। সেজন্য আমরা যারা ছেলে মেয়ের মা তারা সবাই আতঙ্কে আছি। আমাদের পরিচিত জন যার সাথেই কথা হচ্ছে তাদের সবাই একটা কথা বলছেন, ছেলে-মেয়ের দিকে বিশেষ নজর রাখতে। তারা কোথায় কী করছে, কার সঙ্গে মিশছে তা নজরদারি করতে। আমিও তাই করছি। অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক কাজ করছে।
গ্রীন রোডের ২৮/১ ভবনের চতুর্থ তলায় থাকেন এনবিআর এ কর্মরত রোকেয়া ছিদ্দিক (ছদ্ম নাম)। তার দুই মেয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশুনা করেন। আধুনিক জীবন যাপন করেন। আর এতেই নাকি তাদের আরও বেশি আতঙ্কিত করে তুলেছে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘সাধারণ শিক্ষার্থীদের চেয়ে ইংলিশ মিডিয়ামের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি অ্যাডভান্স ও আধুনিক। আনুশকা, দিহান, মৌমিতা, ফাইজার ও আদনানরাও ইংলিশ মাধ্যমে পড়াশোনা করা। আর তাদের বেলাতেই সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ঘটনাই ঘটেছে। আমরা রীতিমত আতঙ্কে আছি। এই সময়ে এসে তাদের সেই আধুনিক মানসিকতা থেকে সরানো বা শিক্ষার মাধ্যম পরিবর্তন করাও সম্ভব নয়। যার ফলে অনেকটা আতঙ্ক নিয়েই দিন পার করছি।’
তাদের মতো কলাবাগান এলাকার আরও অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, ছেলে মেয়েদের নিয়ে পরিবারগুলো বেশ আতঙ্কে রয়েছে। করোনার কারনে এমনিতেই ঘরবন্দী সবাই। তার ওপর মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ অন্যান্য ডিভাইজগুলোতে নজরদারি করা অনেকের মনে অপরাধবোধ কাজ করলেও কিছুই করার থাকছে না অভিভাবকদের।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কলাবাগান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) পরিতোষ রায় বলেন, ‘আতঙ্কের কিছু নেই। তবে ছেলে মেয়েদের প্রতি খেয়াল রাখলে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। আনুশকা হত্যার ঘটনায় ফরেনসিক প্রতিবেদন হাতে পেলেই আদালতে চার্জ দেওয়া হবে। অন্যদিকে মৌমিতার মৃত্যুর ঘটনায় আদনানকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। মৌমিতার পরিবার যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন সেগুলোও তদন্তের আওতায় এনে কাজ করা হচ্ছে। জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মাহফুজা খানম বলেন, ‘সমাজে যা কিছু ঘটে তার একটা প্রতিচ্ছবির ছাপ অন্যান্য পরিবারগুলোতে কিছুদিন আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এতে আতঙ্কের কিছু নেই বলে মনে করি। তবে সচেতন থাকা সবার জন্যই ভালো। সচেতন থাকলে বিপদ এলেও প্রতিরোধ করার মানসিকতা তৈরি হয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কলাবাগান এলাকায় পরপর দুটি ঘটনা সেখানে বাস করা অন্যান্য পরিবারগুলোর অভিভাবকদের কিছুটা মানসিক চাপ তৈরি করেছে। এটি সাময়িক বলে মনে করি।’
সারাবাংলা/ইউজে/একে