হালদায় সিসি ক্যামেরা
১৩ মার্চ ২০২১ ২২:২০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: দেশের একমাত্র প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজননক্ষেত্র হালদা নদীতে চোরা শিকার ও হত্যার হাত থেকে মা মাছ ও বিপন্নপ্রায় ডলফিন বাঁচাতে লাগানো হয়েছে উচ্চক্ষমতার ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা। নৌ পুলিশের পক্ষ থেকে এসব ক্যামেরা লাগানোর পাশাপাশি হালদা পাড়ে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী ফাঁড়ি।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় দেশে প্রথমবারের মতো কোনো নদীকে সিসি ক্যামেরার আওতায় এনে মনিটরিং করা হচ্ছে। হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সোচ্চার সংগঠকরা পুলিশের এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। পুলিশ আন্তরিকভাবে কাজ করলে হালদায় মা মাছ ও ডলফিনের সুরক্ষা মিলবে বলে মনে করছেন তারা।
নৌপুলিশের সদরঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এ বি এম মিজানুর রহমান সারাবাংলাকে জানিয়েছেন, ছয়টি উচ্চক্ষমতার ক্যামেরা হালদা পাড়ের মদুনাঘাট থেকে আমতুয়া পর্যন্ত এলাকায় লাগানো হয়েছে। এর ফলে নদীর প্রায় ছয় কিলোমিটার এলাকা সাবক্ষণিক নজরদারির আওতায় আসবে। এছাড়া নদীপাড়ের হাটহাজারী উপজেলার উত্তর মাদার্শা ইউনিয়নের রামদাশ মুন্সির হাটে স্থাপন করা হয়েছে অস্থায়ী নৌপুলিশ ফাঁড়ি। এই ফাঁড়িতে কর্মরত আছেন আট জন পুলিশ সদস্য। নগরীর সদরঘাট নৌ থানার আওতায় এই ফাঁড়ির কার্যক্রম চলবে।
সদরঘাট নৌ থানা থেকে সিসি ক্যামেরায় হালদা নদী সার্বক্ষণিকভাবে মনিটরিং করা হবে জানিয়ে ওসি মিজানুর বলেন, ‘নৌপুলিশের বিভাগীয় কার্যালয় ও ঢাকায় ডিআইজির কার্যালয় থেকেও মনিটরিং করা হবে।’
এর আগে, গত বৃহস্পতিবার (১১ মার্চ) সিসি ক্যামেরায় অবৈধ জাল পাতার দৃশ্য দেখে অভিযানে চালিয়ে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে ৭ হাজার মিটার অবৈধ ঘের জাল জব্দ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ওসি।
পাবর্ত্য জেলা খাগড়াছড়ি থেকে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটে এসে কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিলিত হওয়া হালদা নদীর দৈর্ঘ্য ১০৬ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ১৩৪ মিটার। এটি পৃথিবীর একমাত্র জোয়ার-ভাটার নদী যেখানে রুই জাতীয় মাছ ডিম ছাড়ে এবং নিষিক্ত ডিম সংগ্রহ করা হয়।
প্রতিবছর এপ্রিলের শেষ অথবা মে মাসে অমাবস্যা বা পূর্ণিমার তিথিতে ভারী বজ্রসহ বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢল নামলে এবং নদীর তাপমাত্রা ও লবণাক্ততা অনুকূলে থাকলে রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালাবাউশ জাতীয় মা মাছ ডিম ছাড়ে। স্থানীয় মৎস্যজীবীরা সেই ডিম সংগ্রহ করে রেণু ফুটিয়ে পোনা উৎপাদন করেন। ডিম সংগ্রহ নিয়ে প্রতিবছর হালদা পাড়ে উৎসবের আমেজ তৈরি হয়।
তবে শিল্প-কারখানার বর্জ্য, বালু উত্তোলনকারী ও চোরা শিকারীদের উৎপাতে দখল-দূষণে হালদা নদীর বিপন্ন দশার খবর বারবার আসে গণমাধ্যমে। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে গত সাড়ে তিন বছরে হালদা নদীতে অন্তত ২৫টি মৃত ডলফিন পাওয়া গেছে। এর মধ্যে কয়েকটির ধরণ দেখে হত্যার তথ্য দিয়েছিলেন প্রাণী বিশেষজ্ঞরা। এছাড়া চোরা শিকারীদের উৎপাত ও ড্রেজারের আঘাতে মা মাছের অবাধ বিচরণও হুমকির মুখে পড়ার তথ্য আসে গণমাধ্যমে। গত দুই বছর ধরে হালদায় প্রশাসনের বেশ কয়েকটি অভিযান, বিভিন্ন সংগঠনের তৎপরতায় হালদা রক্ষার পক্ষে মতামত জোরালো হয়।
সিসি ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে হালদা নদীর জীববৈচিত্র্য রক্ষায় আরেক ধাপ অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে করছেন হালদা রিভার রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক মনজুরুল কিবরিয়া।
তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। মা মাছ রক্ষায় নদীতে ক্যামেরা লাগানোর ইতিহাস বাংলাদেশে আগে নেই। যে ক্যামেরাগুলো লাগানো হয়েছে, তাতে প্রায় ৫-৬ কিলোমিটার এলাকা নজরদারির আওতায় আসবে। আমাদের দাবি ছিল পুরো হালদা নদীকে অর্থাৎ যেখানে মা মাছের বিচরণ আছে, ডলফিনের উপস্থিতি আছে— পুরো এলাকায় যেন ক্যামেরা লাগানো হয়। নৌপুলিশ কিছু লাগিয়েছে। বাকি এলাকায় দু’টি এনজিও ক্যামেরা স্থাপন করবে বলে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। আমি মনে করি এ ধরনের উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আমরা হালদা নদীর মা মাছসহ জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে পারব।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর