ভালো নেই বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মকর্তারা
১৪ মার্চ ২০২১ ১৪:৫৮
ঢাকা: গেল বছরের মার্চ মাসে দেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় সারাদেশ। বন্ধ হয়ে যায় দেশের সব শ্রেণির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। শুরুতে কয়েকমাস পুরোপুরি বন্ধ থাকলেও জুন-জুলাই থেকেই অনলাইনে শুরু হয় শ্রেণি শিক্ষা কার্যক্রম। তবে ক্লাস পরীক্ষা নিয়মিত হলেও অনিয়মিত হয়ে পরে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের বেতন ও ভাতা। যা এখনও পর্যন্ত অনিয়মিতই!
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠানের এমপিও নেই, করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর এমন বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই নিয়মিত বেতন হয়নি। গেল বছরে দুটি ঈদের একটিতেও শিক্ষক-কর্মচারিরা পাননি বোনাস। কিন্তু এই সময়ে অনলাইনে নিয়মিত ক্লাস নিতে হয়েছে তাদেরকে।
রাজধানীর বেশ কয়েকটি বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলছেন সারাবাংলার এই প্রতিবেদক। তাদের প্রায় সবাই অভিযোগ করেছেন, করোনার সময়ে অভিভাবকরা ঠিক মতো বেতন দেয়নি এই ‘অজুহাতে’ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে অনিয়মিতভাবে বেতন পরিশোধ করেছে। এই সময়ে দুটি ঈদে তাদের কেউই ঠিক মতো বোনাস পাননি। বেতন অনিয়মিত হয়ে যাওয়ায় স্ত্রী, সন্তান ও পরিবার নিয়ে তারা পড়েছেন বিপাকে।
প্রভাষক রাফাত রায়হান নিজের প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, বেশ ক’মাসের বেতন পাওনা রয়েছে। এই টাকাটা উদ্ধার করার জন্য এখনও চাকরিটা করছি। এভাবে চলতে থাকলে শিক্ষকতা পেশার প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা ও সম্মান শেষ হয়ে যাবে।
তিনি জানান, তাদের প্রতিষ্ঠানে ভার্চুয়ালি ক্লাস-পরীক্ষা সবই হচ্ছে নিয়মিত, কেবল তাদের বেতনটা হচ্ছে না।
মাহফুজ চৌধুরী নামে আরেক শিক্ষক বলেন, ‘সরকারি চাকরি ব্যবস্থা করতে পারিনি বলেই বেসরকারিতে এসেছিলাম। করোনার সময় মানুষের সবেচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন ছিল সেটি হলো টাকা। এমন না যে প্রতিষ্ঠানগুলোর টাকা নেই! আছে, তাও দেবে না। কেন? অভিভাবকরা নাকি বেতন দেয়নি। এ মাসে চাকরিরটা ছেড়ে দিয়েছি, ইউরোপ চলে যাব। সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করব।’
আরেক শিক্ষক সাগর সরকার বলেন, ‘আমাকে এখনো ঋণ করে চলতে হচ্ছে। শুরুতে ঋন পাওয়া সহজ হলেও এখন সেটিও কঠিন হয়ে পড়েছে। কারণ আগের ঋণ ঠিক মতো পরিশোধ করতে পারিনি। করব কীভাবে বলুন? আমাদের বেতন ঠিক মতো হচ্ছে? পকেটে টাকা না থাকলে পরিবারে শান্তি থাকে? পরিবারে শান্তি না থাকলে ঠিক ভাবে পড়ানো যায়? এই সমীকরণ কলেজের মালিক বুঝবে না।’
এই প্রতিবেদনে এমন আরও অনেক মন্তব্য লেখা যাবে যার মূল বক্তব্য এই বক্তব্যগুলোর কাছাকাছিই। কেউ নিজের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করতে চান না, তবে তারা চান সরকার যেন এই বিষয়গুলো খতিয়ে দেখেন। এসব শিক্ষকরা বলছেন, আইন ও নিয়মের প্রয়োগ থাকলে মহামারির সময়ে তাদেরকে পরিবার নিয়ে এতোটা কষ্ট পোহাতে হতো না।
তবে এমপিও পাওয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক করোনার সময়ে ঈদ বোনাস না পেলেও বেতন পেয়েছেন ‘প্রায়’ নিয়মিতভাবেই। এমপিওর আওতায় শিক্ষকরা রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে মূল বেতনের শতভাগ অর্থ পেয়েছেন। পেয়েছেন ভাড়া বাসা ও চিকিৎসা ভাতাও। অপর দিকে সরকারি শিক্ষকরা অবশ্য সবই পেয়েছেন নিয়মিত।
এ বিষয়ে শিক্ষক নেতা নজরুল ইসলাম রনির সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এই অভিযোগগুলো তারা নিয়মিত পাচ্ছেন। এ বিষয়ে তারা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) কাছে অভিযোগ জানালেও তারা কোনো প্রতিকার পাননি।
তিনি আরও জানান, ৩৭ হাজারেরও বেশি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করোনা মহামারির সময়ে বেতন অনিয়মিতভাবে হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানে দুই লাখেরও বেশি নন-এমপিও শিক্ষক রয়েছে। বর্তামানে তাদের প্রায় সবাই এমন করুণ পরিস্থিতির মধ্যে রয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এ সব প্রতিষ্ঠান কিন্তু নিয়মিত মুনাফা করেছে। এই টাকা গেল কোথায়? কোন খাতে ব্যায় হয়েছে? এরা অভিভাবকদের বেতনের ওপর নির্ভর করে চলে না। তাহলে মহামারির এই দুঃসময়ে কেন শিক্ষকদের সঙ্গে এই আচরণ? আমাদেরকে এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।’
আরেক শিক্ষক নেতা নেকবর হোসেন বলেন, ‘শিক্ষকদেরকে বাঁচতে হয় মর্যাদা নিয়ে, এজন্য অনেক শিক্ষক কোন উচ্চবাচ্য করেন না। বেতনের জন্য রাস্তায় নেমে আন্দোলন করেন না। সংশ্লিষ্ট সবাইকে বুঝতে হবে এটি। অথচ বেসরকারি শিক্ষকরা ভালো নেই এটা দেখেও সবাই না দেখার ভান করে আছে।’
কেবল স্কুল-কলেজ নয় গেলেএক বছরে অনিয়মিত বেতনের ফাঁরায় পড়ে আছেন কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষক-কর্মচারিরাও। দেশে চালু থাকা প্রায় ৬০ হাজার কিন্ডারগার্ডেন স্কুলের প্রায় ৮ লাখেরও বেশি শিক্ষক এ সংকটে রয়েছেন।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক আলমগীর মোহাম্মদ মনসুরুল আলম বলেন, যারা কিন্ডার গার্ডেন খোলেন তারা ভালো অংকের মুনাফাও করেন। তারা কেন শিক্ষকদের বেতন দিতে পারবে না! নিবন্ধিত কিন্ডারগার্ডেনের শিক্ষকদের কাছ থেকে অভিযোগ পেলে আমরা অবশ্যই বিষয়টি তদন্ত করে দেখব। সেই সঙ্গে শিক্ষকদের নিয়মিত বেতন দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব।’
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক বলেন, করোনার সময় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই নিয়মিত টিউশন ফি আদায় করেছে। অনেক অভিভাবক এ নিয়ে আমাদের কাছে অভিযোগও করেছে। টিউশন ফি আদায় করে শিক্ষকদের বেতন বকেয়া রাখা হবে কেন?
তিনি বলেন, ‘শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকদেরকে কেবল মুনাফার চিন্তা করলে হবে না। যেসব প্রতিষ্ঠান শিক্ষকদের সঙ্গে এমন আচরণ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
সারাবাংলা/টিএস/একে