হুতি বিদ্রোহীদের কবল থেকে মুক্তির পর দেশে বন্দি অনটনের জালে
১৪ মার্চ ২০২১ ১৮:৫৯
মীরসরাই থেকে ফিরে: ওমানের মাছিরা দ্বীপ। সেখান থেকে ২০ নাবিকের যাত্রা লোহিত সাগরে। এর মধ্যে পাঁচ জন বাংলাদেশি। তিন জাহাজের গন্তব্য সৌদি আরবের ইয়াম্বো বন্দর। পথে ইয়েমেন উপকূলে প্রচণ্ড ঝড়। ডুবে যায় একটি জাহাজ। বাকি দুইটি জাহাজে উঠে রক্ষা পান ওই জাহাজে থাকা নাবিকরা। কিন্তু বিপদ সেখানেই শেষ নয়। সম্মুখীন হন আরও বড় বিপদের। ইয়েমেনের মীনা সেলিম বন্দরে তথ্য পাঠিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তারপরই দেশটির হুতি বিদ্রোহীদের কবলে পড়েন। বন্দি থাকতে হয় প্রায় সাড়ে ৯ মাস। হুতি বিদ্রোহীদের বন্দিশালায় সইতে হয় চরম নির্যাতন। শেষ পর্যন্ত ২৮৮ দিন পর মুক্তি মেলে। নিঃস্ব হয়ে এ বছরের শুরুতে দেশে ফেরেন ওই পাঁচ বাংলাদেশি।
না, ভাগ্য বদলানোর খোঁজে প্রবাস জীবন বেছে নেওয়া ওই পাঁচ বাংলাদেশির দুর্দশার শেষ হয়নি এতেও। হুতি বিদ্রোহীদের বন্দিশালা থেকে মুক্ত হলেও স্বদেশে ফিরে এখন তারা বন্দি হয়ে পড়েছেন অভাবের জালে। শূন্য হাতে ফিরেছেন, পাসপোর্ট ফেরত দেয়নি হুতিরা। আর কখনো বিদেশে যেতে পারবেন কি না, জানেন না সেটিও। দেশেও আয়-রোজগার নেই। জেঁকে বসেছে অভাব-অনটন, চোখের সামনে শুধু হতাশা। ওমানের মালিকের কাছে আটকে আছে কয়েক মাসের পাওনা। সেই পাওনা পেতে এবং কাজের খোঁজে এখন সরকারি দফতরে-দফতরে ঘুরছেন তারা।
পাঁচ বাংলাদেশি হলেন— চট্টগ্রামের মীরসরাই উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলাউদ্দিন (৩৫), মোহাম্মদ রহিম উদ্দিন (২৯), মোহাম্মদ ইউছুফ (৩২) ও মো. আলমগীর হোসেন (৩২) এবং রাউজান উপজেলার আবু তৈয়ব (৪০)।
শনিবার (১৩ মার্চ) মীরসরাইয়ের ইছাখালী ইউনিয়নের পশ্চিম ইছাখালী গ্রামে আলাউদ্দিনের বাড়িতে তার সঙ্গে কথা হয় সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের। আলাউদ্দিনের সঙ্গে ছিলেন রহিম উদ্দিন আর মোহাম্মদ ইউছুফও। তারা তুলে ধরলেন তাদের অভাব আর দুর্দশার কথা।
ওমান থেকে সৌদিআরব যাত্রাপথে ঝড়ের কবলে
পাঁচ বাংলাদেশিই ওমানের একই কোম্পানিতে চাকরি করতেন। আইল্যান্ড ব্রিজ অ্যান্ড ট্রান্সপোর্ট কনস্ট্রাকশন নামে একটি কোম্পানি, যেটি আরব সাগরের মাছিরা দ্বীপে জাহাজ জাতীয় ফেরির মাধ্যমে লোকজন ও যানবাহন পারাপার করত। ২০০৮ সালের মার্চে যাওয়া আলাউদ্দিন ছিলেন জাহাজের ক্যাপ্টেনের সহকারী। ২০ বছর আগে যাওয়া আবু তৈয়ব এবং ২০১০ সালে যাওয়া আলমগীর ছিলেন ইঞ্জিন মেকানিক। ২০১২ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি যান রহিম। তিনি জাহাজে সুপারভাইজারের কাজ করতেন। একই বছরের ১ জানুয়ারি যাওয়া ইউছুফ লস্করের কাজ করতেন।
আলাউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আইল্যান্ড ব্রিজ থেকে সৌদি আরবের একটি কোম্পানি তিনটি জাহাজ ভাড়া করে। আমাদের ২০ জনকে দ্বিগুণ বেতনে সেখানে নিয়োগ দেন মালিক। তিনটি জাহাজ নিয়ে আমরা ২০২০ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি সৌদি আরবের ইয়াম্বো পোর্টের উদ্দেশে যাত্রা করি।’
তিনটি জাহাজ হচ্ছে— ডানা সিক্স, আল রাইয়া ও ফরিদা। তিনটি জাহাজে ভাগ হয়ে ২০ জন নাবিক ছিলেন। এদের মধ্যে পাঁচ জন বাংলাদেশি, ১৪ জন ভারতীয় এবং একজন মিশরের নাগরিক। সৌদি আরব যাত্রাপথে ডানা সিক্স ও ফরিদা জাহাজে ছিলেন ছয় জন করে, আল রাইয়াতে ছিলেন আট জন।
আলাউদ্দিন জানান, লোহিত সাগরে ইয়েমেন উপকূল অতিক্রমের সময় ১২ ফেব্রুয়ারি প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে ডানা সিক্স জাহাজটি ডুবে যায়। ওই জাহাজে বাংলাদেশি নাবিকদের মধ্যে আলাউদ্দিন ও আলমগীর ছিলেন। ডানা সিক্স থেকে ফরিদা ও আল রাইয়াকে তথ্য পাঠানো হয়— ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জাহাজটি ডুবে যাচ্ছে। তখন ওই জাহাজ দু’টি এসে ডানা সিক্সের নাবিকদের রক্ষা করে। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ের কারণে উত্তাল সমুদ্রে জাহাজ চালানো সম্ভব হচ্ছিল না বলে জানান আলাউদ্দিন।
ঝড়ের কবল থেকে মুক্ত হয়ে হুতি বিদ্রোহীদের কবলে
রহিম উদ্দিন জানান, দুই দিন সাগরে ভেসে থাকার পর ১৪ ফেব্রুয়ারি ইয়েমেনের উপকূলের কাছাকাছি মীনা সেলিম বন্দরে তথ্য পাঠানো হয়— তারা বিপদে পড়েছেন, তাদের যেন সহযোগিতা করা হয়। মীনা সেলিম বন্দর থেকে ক্লিয়ারেন্স দেওয়া হয় তাদের জেটিতে প্রবেশের জন্য। কিন্তু সেখানে ঢুকতে গিয়ে তাদের পড়তে হয় আরও বড় বিপদে।
উল্লেখ্য, ইয়েমেনে এক দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। দেশটির সরকার বিরোধী শিয়া সম্প্রদায়ের একটি গোষ্ঠী, যারা ‘হুতি বিদ্রোহী‘ হিসেবে পরিচিত, তারা ২০১৪ সালে রাজধানী সানার নিয়ন্ত্রণ নেন। তারা ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট মনসুর হাদির বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
রহিম সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইয়েমেনের মীনা সেলিম বন্দর যে হুতি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে, সেটা তো আর আমরা জানি না। আমাদের তখন যে অবস্থা, যেকোনোভাবে ঝড়ের ওই বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই রক্ষা মিললেও পড়লাম আরও বড় বিপদে। আমাদের জাহাজ দু’টি বন্দর সীমানায় প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে চার দিক থেকে ছোট ছোট স্পিডবোটে এসে জাহাজগুলোকে ঘিরে ফেলে। স্পিডবোটে সব সশস্ত্র জঙ্গি। জাহাজ লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে থাকে। আমরা সবাই আতঙ্কে আল্লাহর নাম নিতে থাকি। গুলি করতে করতে তারা জাহাজে ওঠে। তারপর জাহাজগুলোকে বন্দরের ভেতরে নিয়ে যায়।’
আলাউদ্দিন বলেন, ‘১০০ জনেরও বেশি সশস্ত্র লোক ছিল। আমাদের মাথায় অস্ত্র ধরে জাহাজগুলোকে জেটিতে নিয়ে যাওয়া হয়। তখন জানতে পারি, তারা ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহী। সশস্ত্র পাহারায় আমাদের কয়েকদিন ধরে নোঙর করা জাহাজের ভেতরেই রাখা হয়। আমাদের পাসপোর্ট ও মোবাইলসহ সব ডক্যুমেন্ট কেড়ে নেয়। জাহাজে আমাদের খাবার ছিল। আমরা সেগুলো খেয়ে দিন পার করি আর আল্লাহকে বলি— আমাদের বিপদ থেকে উদ্ধার করো। কেউ কিছু বুঝতে পারছিলাম না, আসলে কী হচ্ছে বা হতে যাচ্ছে।’
বন্দিশালায় ২৮৮ দিনের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা
১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে নাবিকরা হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যান। মুক্তি মেলে ২৮ নভেম্বর। ১০ মাসে ২৮৮ দিন তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। বেঁচে ফেরার নিশ্চয়তা ছিল না কারও মধ্যে।
ইউছুফ সারাবাংলাকে বলেন, ’১৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আমাদের জাহাজ থেকে নামিয়ে দু’টি মাইক্রোবাসে তোলে। প্রায় সাত ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমাদের সানা শহরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে হুতি বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণাধীন একটি টর্চার ক্যাম্প আছে। সেটি একটি আবাসিক হোটেল। সেই হোটেলের আন্ডারগ্রাউন্ডে একটি ছোট্ট রুমে আমাদের ২০ জনকে একসঙ্গে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে হুতিরাই পুলিশ, তারাই সরকার, তারাই বিচারক— সব কিছু। মাথার ওপর সবসময় অস্ত্র তাক করা থাকত। আমাদের পাহারায় থাকত ১২-১৪ বছরের ছেলে, সবার হাতে ভারি ভারি অস্ত্র। সানা শহরে গৃহযুদ্ধ চলছে। সারাক্ষণ গোলাগুলি, বোমার শব্দ। বিল্ডিং কাঁপত। সারাক্ষণ মনে হতো ভূমিকম্প হচ্ছে। ভয়ে তটস্থ থাকতাম।’
রহিম উদ্দিন বলেন, ‘হোটেলটাকে হুতিরা জেলখানা হিসেবে ব্যবহার করত। একটা ছোট রুম, একটা বাথরুম। সেখানে গাদাগাদি করে থাকতাম। ২৪ ঘণ্টায় একবেলা ভাত দিত। শুধু ডাল আর প্লাস্টিকের দানার মতো চীনের চাল। মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ নেই, দেশে স্বজনদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই, মাথার ওপর অস্ত্র, হুমকি-ধমকি। চিন্তা করে দেখেন আমাদের অবস্থাটা কী!’
ইউছুফ বলেন, ‘প্রতিদিন ডাল দিয়ে ভাত তো খাওয়া যায় না। মাসখানেক পর থেকে আর খেতে পারছিলাম না। আমরা অনেকেই খেতাম না। ক্ষুধা নিয়ে পড়ে থাকতাম। একদিন শরীর বেশি দুর্বল হয়ে যাওয়ায় আমি বাথরুমে পড়ে যাই। অনেক অনুরোধ করার পর আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায় হুতি বিদ্রোহীরা। সেখানে পরীক্ষার কথা বলে আমার শরীর থেকে এক ব্যাগ রক্ত নিয়ে নেয়। আরেক ব্যাগ নেওয়ার সময় ভারতীয় এক সহকর্মী ধরে ফেলেন। তারপর আর নেয়নি। রক্ত নেওয়ার পর আমি আরও দুর্বল এবং অসুস্থ হয়ে যাই।’
রহিম বলেন, ‘ইউছুফের অবস্থা দেখে আমারও শরীর খারাপ হতে শুরু করে। আমিও একদিন অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাই। কিন্তু ইউছুফের মতো আমার শরীর থেকেও রক্ত নিয়ে নেবে— এই ভয়ে আমাকে কেউ হসপিটালে নিয়ে যায়নি। আমিও যেতে আগ্রহী ছিলাম না। আমরা যে সুস্থ শরীরে আমাদের স্বজনদের কাছে ফিরতে পারব— এটা তখন আর ভাবতেই পারিনি। বারবার মনে হতো, এই বুঝি আমাদের গুলি করে মেরে ফেলছে!’
আলাউদ্দিন বলেন, ‘হুতি বিদ্রোহীরা কী চায়, তারা কেন আমাদের আটকে রেখেছে— কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। আমাদের তারা কিছুই বলত না। তাদের ভাষা আরবি। আমরা আরবি বুঝতাম। সেজন্য কথাবার্তায় সমস্যা হতো না। জানতে চাইলে মারধর করত। মাথায় অস্ত্র ধরে বলত, তোদের এখানে মেরে লাশ ফেলে রাখলে কেউ জানতেও পারবে না। তিন মাস পর তারা আমাদের মালিকের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলার সুযোগ দেয়। তখন জানতে পারি যে হুতি বিদ্রোহীরা মালিকের কাছে টাকা চেয়েছে। মালিক আমাদের বলেন— তোমরা চিন্তা করো না, তোমাদের ছাড়িয়ে নেওয়ার জন্য আমি চেষ্টা করছি। এই প্রথম আমরা কিছুটা আশ্বাস পাই।’
‘ছয় মাস পর থেকে সপ্তাহে একদিন আধা ঘণ্টার জন্য আমাদের মোবাইল ফোনগুলো ফেরত দিত। তখন আমরা দেশে ফোন করতাম। কিন্তু আমরা যে বন্দি, সেটা কখনো কাউকে বলিনি। বৃদ্ধ মা, স্ত্রী, ভাইয়েরা সবাই টেনশন করবে— এই চিন্তা থেকে কিছু বলতাম না। যতই কষ্ট হোক, বলতাম ভালো আছি। আগস্টে কোরবানির ঈদের পরদিন আমাদের মোবাইলগুলো দিয়ে দেয়। সেদিন আমরা মালিককে ফোন করি। তিনি ওই সময় বলেন— আমি অনেক চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারছি না। তোমরা তোমাদের দূতাবাস ও সরকারকে বলো ছাড়িয়ে নিতে। ইয়েমেনে বাংলাদেশের কোনো দূতাবাস নেই, ভারতের আছে। আমরা তখন ওমান দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করি।’
বন্দিশালা থেকে মুক্তির আকুতি
মোাবাইল ফেরত পাওয়ার পর বন্দি দশা থেকে মুক্তির জোর চেষ্টা শুরু করেন নাবিকরা। বাংলাদেশি নাবিকরা ওমানে দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে প্রথমে ব্যর্থ হন। তারা প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংগঠন এনআরবি সিআইপি অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ওমানপ্রবাসী মোহাম্মদ ইয়াছিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। বন্দিশালায় থাকা আবু তৈয়বের ভাই আলমগীর মোহাম্মদও ওমানে থাকেন। তার মাধ্যমে ইয়াছিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এরপরই মূলত বন্দিশালা থেকে মুক্তির পথ সুগম হয়। ইয়াছিন চৌধুরী ওমান দূতাবাসকে বিষয়টি জানান। আলমগীরকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের নম্বর দেন।
আলাউদ্দিন বলেন, ‘হোটেলের ওয়াইফাই ব্যবহার করে আমরা ইয়াছিন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করতাম। আমি পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে মেসেজ দিই। কয়েকবার এসএমএস দিই। তিনি সিন করতেন কিন্তু জবাব দিতেন না। তবে আমরা বুঝতে পারতাম, আমাদের বিষয়টি তিনি জানেন এবং এ ব্যাপারে কাজ করছেন। তবে যেদিন মুক্তি পাই, তার দুই দিন আগে প্রতিমন্ত্রী আমাকে এসএমএস দেন— তোমরা টেনশন কোরো না, কালকেই রিলিজ হয়ে যাবে। এই এসএমএস পাবার পর আমরা প্রাণ ফিরে পাই। মুক্তির আগ পর্যন্ত একেকটি মুহূর্ত মনে হচ্ছিল একেকটি বছর।’
রহিম উদ্দিন বলেন, ‘বিভিন্নভাবে খবর পেয়ে ব্র্যাকের অফিসাররাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। শরীফুল হাসান সাহেব খুব হেল্প করেছেন। উনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছেন। আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরা জানতে পেরেছি, আমাদের মালিক দুই দফায় ১০ হাজার মার্কিন ডলার করে ২০ হাজার ডলার ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের দেওয়ার পর আমাদের মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তবে এটা আমরা শুনেছি, সত্যি কি না জানি না।’
মুক্তির দেড়মাস পর স্বদেশে
২৮ নভেম্বর মুক্তি দেওয়া হয় ২০ নাবিককে। বাংলাদেশি পাঁচ জনকেও ইয়েমেনে ভারতীয় দূতাবাসের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তাদের ইয়েমেনের রাজধানী এডেনে নিয়ে যাওয়া হয় এবং একটি হোটেলে রাখা হয়। ৭ ডিসেম্বর ভারতীয়রা চলে যান। বাংলাদেশিদের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) কাছে হস্তান্তর করা হয়। আইএমও তাদের আরেকটি হোটেলে রাখে। তখন কুয়েতের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে আইএমও এবং পাঁচ নাবিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। কুয়েতের দূতাবাস থেকে দৈনিক খরচের জন্য ৪০০ মার্কিন ডলার পাঠানো হয়। আইএমও টিকেট করে দেয়। ১০ জানুয়ারি তারা ঢাকায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছান।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম হেড শরীফুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘ইয়েমেনে আটকে পড়া বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয়ের কাজটা করেছি। আমরা যখন বিষয়টি জানতে পারি, তখনই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট সরকারি দফতরে যোগাযোগ করি। তারা যেন বন্দিদের মুক্তি করে ফিরিয়ে আনার যথাযথ উদ্যোগ নেয় এবং বন্দি অবস্থায় যারা ছিলেন তাদের সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ করিয়ে দেওয়া— এই কাজগুলো আমরা করেছি। ফিরিয়ে আনার পর বিমানবন্দর থেকে বাড়িতে পৌঁছানো পর্যন্ত তাদের আমরা সহযোগিতা দিয়েছি।’
এখন বন্দি অভাবের জালে
ইয়েমেন থেকে বাংলাদেশিরা ফিরেছেন একেবারে নিঃস্ব হয়ে। তারা জানিয়েছেন, বিমানবন্দরে ব্র্যাকের পক্ষ থেকে তাদের এক হাজার করে টাকা দেওয়া হয়। সেই টাকায় গাড়ি ভাড়া দিয়ে তারা বাড়িতে যান। বন্দি অবস্থায় ১০ মাসসহ আলাউদ্দিন ও ইউছুফের মোট ১৩ মাস এবং রহিমের ১৫ মাসের বেতন পাওনা আছে ওমানের মালিকের কাছে। পাওনা ফেরত চাওয়ায় মালিক এখন যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছেন। পাওনা ফেরত পেতে তারা এখন ধরনা দিচ্ছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসে।
আলাউদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘হুতিদের কাছে আটকে থাকার সময় ১১ মাস ধরে আমরা পরিবারকে এক টাকাও দিতে পারিনি। এরপর নিঃস্ব হয়ে বাড়ি ফিরেছি। এসে দেখি, আমার পাঁচ বছরের মেয়ে গুরুতর অসুস্থ। ডাক্তার বলেছেন, তার একটি কিডনি শুকিয়ে গেছে, আরেকটি কিডনিতে পানি ও চর্বি জমেছে। সঞ্চয় যা ছিল তা দিয়ে পরিবার একবছর কোনোমতে সামাল দিয়েছে। এখন আমার একটাকাও সঞ্চয় নাই। আয়-রোজগারও নাই। সংসার চলে না। মেয়ের চিকিৎসা করব কিভাবে?’
মোহাম্মদ ইউছুপ বলেন, ‘আমরা হাতের কাজ জানি না। যখন হাতের কাজ শেখার বয়স, তখন তো আমরা বিদেশে চলে যাই। লেখাপড়াও বেশি করিনি। আমাদের বকেয়া বেতনটা যদি পেতাম, অন্তত দোকান খুলে হলেও আয়-রোজগার করতাম। এখন আমাদের সংসার চলবে কিভাবে? সরকারের কাছে আমাদের আবেদন, দূতাবাসের মাধ্যমে ওমানের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করে আমাদের বেতনটা যেন ফেরত এনে দেয়।’
রহিম উদ্দিন বলেন, ‘আমরা আবার বিদেশে যেতে পারব, তার কোনো গ্যারান্টি নেই। আমাদের পাসপোর্ট হুতিরা ফেরত দেয়নি। ওমানের মালিক যোগাযোগই বন্ধ করে দিয়েছে, আর নেবে না। দেশে ফিরে আমরা আরও অসহায় হয়ে পড়েছি। গত দুই মাসে কোনো সরকারি সংস্থা আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি, কেউ খবরও নেয়নি। বিদেশে বসে অনেক কথা শুনতাম। প্রবাসীরা সূর্যসন্তান, রেমিট্যান্স যোদ্ধা— অনেক কথা। দেশে ফিরে দেখি সব উল্টো।’
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম হেড শরীফুল হাসান বলেন, ‘তাদের সঙ্গে যে ঘটনাটা ঘটেছে, খুবই দুঃখজনক। ওমানে তাদের বৈধ ভিসা ছিল, আয়ও ভালো ছিল। কিন্তু এক ঝড়ের কবলে পড়ে তাদের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেল। এরপর ইয়েমেনে গেল, বিদ্রোহীরা তাদের কয়েক মাস আটকে রাখল। এখন তারা সত্যিই বিপদে পড়েছে। তবে তারা যাতে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, সেই চেষ্টা আমাদের আছে।’
তিনি বলেন, ‘তাদের আমরা কাউন্সেলিং করেছি। ছোটখাটো ব্যবসা বা দোকান যদি দিতে পারে কিংবা কোনো প্রশিক্ষণ— সেই সহায়তা আমরা করার চেষ্টা করছি। আমরা তাদের পাশে আছি এবং সাধ্যমতো তাদের পাশে থাকব।’
জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলা জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর উপপরিচালক মোহাম্মদ জহিরুল আলম মজুমদার সারাবাংলাকে বলেন, ‘ওমানে কোম্পানির কাছে বকেয়া পাওনা ফেরত আনা অথবা বিশেষ পুর্নবাসনের জন্য পাঁচ জন আবেদন করেছেন। প্রায় ১১ মাস তারা ইয়েমেনে বিদ্রোহীদের কাছে জিম্মি ছিলেন। তারা অনেকটা ট্রমাটাইজড। স্বাভাবিকভাবেই তাদের জীবনটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে। কারণ তাদের ভালো আয়-রোজগার ছিল। হঠাৎ তারা বেকার-নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমরা আমাদের প্রধান কার্যালয়কে বিষয়টি অবহিত করেছি। দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। আর তাদের আপাতত পুনর্বাসনের জন্য চট্টগ্রাম চেম্বারের সহযোগিতা চেয়ে চিঠি দিয়েছি।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর