পিকনিকে ১৪ শতাংশ ও মার্কেটে ৪২ শতাংশ বেড়েছে জনসমাগম
১৫ মার্চ ২০২১ ২৩:৫৮
ঢাকা: দেশের বিভিন্ন পিকনিক ও বিনোদন স্পটে জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহের তুলনায় জনসমাগম বেড়েছে ১৪ শতাংশ। একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে বিভিন্ন সুপার মার্কেট ও ফার্মেসিতে জনসমাগম বেড়েছে ৪২ শতাংশ। এছাড়া বিভিন্ন পার্কে ১৪ শতাংশ, কর্মক্ষেত্রে ১০ শতাংশ ও আবাসিক এলাকায় ৪ শতাংশ জনসমাগম বেড়েছে এই সময়ে। আর বিভিন্ন গণপরিবহনে জনসমাগম বেড়েছে ২৬ শতাংশ।
গুগল কমিউনিটি মোবিলিটি ডাটার সবশেষ তথ্য বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২৬ জানুয়ারির ডাটাকে বেজলাইন ধরে ৯ মার্চ পর্যন্ত এ পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে বর্তমানে স্বাস্থ্যবিধি অবজ্ঞা করে বিভিন্ন পিকনিক স্পটে ও জনসমাগমপূর্ণ এলাকায় ভিড় করার কারণেই বাড়ছে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ। এমন অবস্থায় যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানা হয়, তবে পরিস্থিতি হতে পারে ভয়াবহ।
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের হাতে থাকে স্মার্টফোনের জিপিএস প্রযুক্তির ওপরে নির্ভর করে তৈরি করা হয় গুগলের এই কমিউনিটি মোবাইল ডাটা। এক্ষেত্রে মানুষ যখন তার হাতে থাকা স্মার্টফোন নিয়ে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরতে থাকেন, তখন সেটির তথ্য আপডেট করা হয়। জিপিএস ও সেলুলার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে তাদের ব্যবহারকারীদের গতিবিধির রেকর্ডের তথ্য পর্যালোচনা করে এই কমিউনিটি মোবাইল ডাটা তৈরি করা হয়। কোভিড-১৯ সংক্রমণ শুরু হওয়ার
পর বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মোবিলিটির এই ডাটা তৈরি করে গুগল।
বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ বাড়ছে, সেটির পেছনে রয়েছে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা। বিশেষ করে গত কয়েক মাসে মানুষজন অনেকটা স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরে আসছিলেন। সেটিও সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার কারণ। গুগলের এই মোবালিটি ডাটাও বলছে, বিভিন্ন স্থানে মানুষের চলাচল আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে গেছে।
এদিকে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, মার্চের প্রথম ১৪ দিনের সংক্রমণ পুরো ফেব্রুয়ারি মাসের আক্রান্তের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। অন্যদিকে, আজ সোমবার (১৫ মার্চ) দেশে প্রায় তিন মাস পর ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ এক হাজার ৭৭৩ জনের শরীরে করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এদিন নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে শনাক্তের হার ছিল ৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ, যা গত ১৯ ডিসেম্বরের পর সর্বোচ্চ। শুধু তাই নয়, এদিন ৭ জানুয়ারির পরে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সংখ্যক মৃত্যুও হয়েছে।
গুগলের এই তথ্য ও করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির মধ্যে সম্পর্ক কতটুকু— জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, এই তথ্য দিয়ে আসলে সার্বিক পরিস্থিতি বোঝা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ এখানে কেবল জিপিএসের তথ্য দেওয়া হয়েছে। তারপরও এই পরিসংখ্যানকে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ এটাও বাস্তবতাটাকেই তুলে ধরছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন পিকনিক স্পটে যে পরিমাণ ভিড় বেড়েছে, তাতে সবার স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। আর এক্ষেত্রে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকি এড়ানোটাও কষ্টসাধ্য। একইসঙ্গে মানুষ তো পিকনিক স্পটে যাওয়ার জন্য গাড়ি ব্যবহার করছে। বিভিন্ন শপিং মলেও ভিড় বেড়েছে। কিন্তু কমেছে মাস্ক ব্যবহারের পরিমাণ। জনসমাগমে মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরির কারণে কোভিড-১৯ সংক্রমণের ঝুঁকিও বাড়ছে। আর এগুলোর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক সময়ের কোভিড-১৯ শনাক্তের তথ্যে।
ডা. আলমগীর আরও বলেন, দেশে অনেকেই বলছে— কোনো ভ্যারিয়েন্টের কারণে সংক্রমণ বাড়ছে। কিন্তু যদি কেউ স্বাস্থ্যবিধি না মেনে পিকনিকে মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরি করে, তবে সংক্রমণ ছড়ানোর জন্য নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রয়োজন নেই। এমনিতেই বিপদ চলে আসবে। তাই এখনই সময় আমাদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে মাস্ক পরা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সবাইকে হাত ধোঁয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে ও জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।
মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে উদাসীনতার কারণে সংক্রমণের হার বাড়ছে বলে মনে করেন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।
সারাবাংলাকে ডা. নজরুল বলেন, ‘ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হলেও মাস্ক পরার প্রবণতা ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। অসুস্থ বোধ করলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাও জরুরি, যেন প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যায়। কিন্তু আমরা লক্ষ করে দেখলাম, মাস্ক পরা বিষয়ে এক ধরনের উদাসীনতা তৈরি হয়েছে। মানুষ এখন রিল্যাক্স হয়ে যাচ্ছে। কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন পিকনিক স্পটে প্রচুর ভিড়। এমনকি সেখানে নাকি মানুষ থাকার জন্য হোটেলও পাচ্ছে না বলে গণমাধ্যমে সংবাদ এসেছে। এক্ষেত্রে সংক্রমণ তো বাড়বেই। কারণ জনসমাগম এড়িয়ে চলাটাও তো একটা স্বাস্থ্যবিধি।’
তিনি বলেন, ‘দেশে বিভিন্ন স্থানে দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক কর্মসূচি। এসব স্থানেও প্রচুর মানুষ কিন্তু ভিড় করছে এবং একে অন্যের সংস্পর্শে আসছে। এগুলো কিন্তু ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। দেশে যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু গবেষণা না করে সংক্রমণ বাড়ার জন্য অবশ্য এখনই নতুন ভ্যারিয়েন্টকে দায়ী করা যাবে না। তবে স্বাস্থ্যবিধি না মানার যে প্রবণতা আমরা দেখছি, তাতে নতুন ভ্যারিয়েন্টের প্রয়োজন নেই— এমনিতেই সংক্রমণের হার বেড়ে যাবে।’
ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হওয়ার পর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ নিয়ে অসচেতনতা দেখা যাচ্ছে বলে মনে করছেন আইইডিসিআর পরিচালক ডা. তাহমিনা শিরিন। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভ্যাকসিন দিলেই কেউ কোভিড-১৯ সংক্রমিত হবেন না, এই ভাবনাটাই তো ভুল। কারণ সবে প্রথম ডোজ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে অ্যান্টিবডি তৈরি হতেও তো সময় লাগে। এছাড়াও দ্বিতীয় ডোজ নেওয়ার আগে নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়াও সম্ভব না। আর তাই ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকবেই।’
তিনি বলেন, ‘সংক্রমণ যদি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় তবে অবশ্যই সবাইকে মাস্ক পরতে হবে। একইসঙ্গে সবাইকে হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখতে হবে। প্রয়োজন ছাড়া জনসমাগমে না যাওয়াই ভালো। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি বিভিন্ন পিকনিক স্পট ভিড় বাড়ছে। এগুলো বিপদজনক হতে পারে যেকোনো সময়েই। আর তাই স্বাস্থ্যবিধি মানার কোনো বিকল্প নেই।’
এর আগে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশিদ আলম গণমাধ্যমকে বলেন, গত দু’মাসে আমরা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলাম। কিন্তু এখন আমরা কোনো স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছি না। এখন যারা নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই তরুণ। স্বাস্থ্যবিধি অবহেলা করতে থাকলে সামনেই দেশের বিপদ রয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়ে এরই মধ্যেই স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দিয়েছে।
তবে এসব বিষয়ে সরকার সতর্ক রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। তিনি বলেন, দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ঘটনায় সরকার সতর্ক রয়েছে। তবে মানুষের স্বাস্থ্যবিধি না মানাই এর মূল কারণ। মানুষের মধ্যে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস কাজ করছে, এটি উদ্বেগজনক। এই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস ও স্বাস্থ্যবিধি না মানায় বাড়ছে করোনা।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর