প্যানেল মেয়র হতে টাকা আইফোন নিয়ে ধরনা
১৬ মার্চ ২০২১ ২২:১৫
চট্টগ্রাম ব্যুরো: চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ ‘দলাদলি’ সিটি করপোরেশনের প্যানেল মেয়র নির্বাচনেও গড়িয়েছে। শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী কাউন্সিলররা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। প্যানেল মেয়র পদে জিততে কোমর বেঁধে নেমেছেন অন্তত ১৪ জন কাউন্সিলর। এক গ্রুপ আরেক গ্রুপ থেকে ভোট টানতে চালাচ্ছে জোর তৎপরতা।
জানা গেছে, প্যানেল মেয়র পদে জেতার তৎপরতা শুধু ভোট প্রার্থনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। চলছে উপহারের নামে উপঢৌকন বিনিময়ও। এরকম উপঢৌকনের মধ্যে শাড়ি, পাঞ্জাবি, আইফোন যেমন আছে; নগদ টাকা বিতরণ হচ্ছে বলেও অভিযোগ পাওয়া গেছে।
এরপর আছে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর আশীর্বাদ পাওয়ার প্রতিযোগিতাও। ২০১৫ সালের নির্বাচনে প্যানেল মেয়রের তিনটি পদে ওই সময়কার মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারীরাই জিতেছিলেন। সে কারণে এবার কাউন্সিলররা ভাবছেন, শেষ পর্যন্ত মেয়র রেজাউল করিমের সমর্থন যার প্রতি থাকবে, তার জিতে আসা সহজ হবে। এজন্য মেয়রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা প্রমাণেরও জোর তৎপরতা আছে প্যানেল মেয়র পদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের রাজনীতি তিন ধারায় বিভক্ত। সাবেক মেয়র প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীরা আছেন। মহিউদ্দিনের মৃত্যুর পর উপমন্ত্রী নওফেলের নেতৃত্ব মেনে রাজনীতি করছেন তারা। নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী একটি বলয় আছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনের নেতৃত্বাধীন একটি বলয়ও আছে, যার বড় অংশ ‘নওফেল গ্রুপের’ সঙ্গে আছে।
গত ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে বিজয়ী মোট ৫৪ কাউন্সিলরের সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থিত। এদের মধ্যে অন্তত ৪০ জন নওফেলের ও ১০ জন আ জ ম নাছিরের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। বাকিরা স্থানীয় সাংসদের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯-এর ২০ ধারা ১ উপধারা অনুযায়ী, সিটি করপোরেশনের প্রথম সভার এক মাসের মধ্যে কাউন্সিলররা তিন সদস্যের একটি প্যানেল মেয়র নির্বাচন করবেন। এই প্যানেলের সদস্যরা জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে মেয়রের অনুপস্থিতিতে দায়িত্ব পালন করবেন। প্যানেল মেয়র তিন পদের মধ্যে দু’টিতে সাধারণ কাউন্সিলর এবং একটিতে সংরক্ষিত ওয়ার্ডের নারী কাউন্সিলর নির্বাচিত হবেন। তবে প্রত্যেক পদে ৫৪ কাউন্সিলরেরই ভোট দেওয়ার সুযোগ আছে।
আগামী বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের তিন প্যানেল মেয়র পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
এবার প্যানেল মেয়র পদে সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে ৫৪ কাউন্সিলরের মধ্যে ১৪ জনের নাম শোনা যাচ্ছে। এরা হলেন— সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু, জহরলাল হাজারী, মো. গিয়াস উদ্দিন, চৌধুরী হাসান মাহমুদ হাসনী, নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, আব্দুস সবুর লিটন, জিয়াউল হক সুমন ও শৈবাল দাশ সুমন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলরদের মধ্যে জোবাইরা নার্গিস খান, নীলু নাগ, লুৎফুন্নেছা দোভাষ বেবি, ফেরদৌস বেগম মুন্নি, আফরোজা কালাম ও জেসমিন পারভীন।
দৃশ্যমান প্রচার-প্রচারণায় এগিয়ে আছেন জহরলাল হাজারী, গিয়াস উদ্দিন, আব্দুস সবুর লিটন, নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু, নীলু নাগসহ আরও কয়েকজন।
কাউন্সিলরদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সম্ভাব্য প্রত্যেক প্রার্থীই কাউন্সিলরদের বাসায়-বাসায় যাচ্ছেন, দেখা-সাক্ষাৎ করছেন। গ্রুপে-গ্রুপে ভাগ হয়ে বৈঠক করছেন। এমনকি সম্প্রতি কক্সবাজারে গিয়েও কয়েকজন কাউন্সিলর একটি হোটেলে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং কর্মকৌশল নির্ধারণ করেছেন বলে জানা গেছে। এছাড়া প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কাউন্সিলরদের জন্য পাঞ্জাবি, স্ত্রীর জন্য শাড়ি, গলার চেইন, আইফোন, কোটপিন উপঢৌকন হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। অন্তত দু’জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে টাকা বিতরণের অভিযোগ পাওয়া গেছে, যাদের একজন ৫০ হাজার করে এবং আরেকজন এক লাখ ৩০ হাজার টাকা করে বিতরণ করছেন।
জানতে চাইলে ২৪ নম্বর উত্তর আগ্রাবাদ ওয়ার্ডের কাউন্সিলর নাজমুল হক ডিউক সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্যানেল মেয়র পদ— এটি কোনো রাজনৈতিক পদ না। এই পদে নির্বাচিত হওয়ার জন্য নির্দিষ্ট কোনো যোগ্যতাও নির্ধারণ করা নেই। কাউন্সিলররাই নির্বাচন করবেন এবং নির্বাচিত করবেন। জনপ্রিয়তায় একমাত্র মাপকাঠি। স্বাভাবিকভাবে জনপ্রিয় হওয়ার জন্য চেষ্টা সবার থাকবে। আমার কাছে প্রার্থীরা ভোট চেয়েছেন। তবে আমাকে কেউ টাকা-মোবাইল অফার করেননি। দু’জন দু’টি পাঞ্জাবি, একজন একটি কোটপিন উপহার দিয়েছেন। কিন্তু উনারা বলেননি যে উপহারের বিনিময়ে উনাদের ভোট দিতে হবে। আমি স্বাভাবিক সৌজন্যতার সংস্কৃতি হিসেবে উপহারগুলো নিয়েছি।’
২২ নম্বর এনায়েতবাজার ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ সলিম উল্লাহ সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুনেছি অনেক প্রার্থী অনেক কাউন্সিলরকে টাকা-আইফোন দিয়ে ভোট চেয়েছেন। অনেকে নিয়েছেন, অনেকে ফিরিয়ে দিয়েছেন। আমি যেহেতু এসবের মধ্যে নেই, কে নিয়েছেন, কে দিয়েছেন— সেটা জানতেও চাইনি। প্যানেল মেয়র পদটা এমন হয়ে গেছে যে আমরা কয়েকজন ছাড়া সবাই সেই পদে যেতে চান। প্রথমবার কাউন্সিলর হয়েও বলেন— আমি প্যানেল মেয়র হতে চাই।’
প্যানেল মেয়র পদের দৌড়ে এগিয়ে থাকা জহরলাল হাজারী ৩২ নম্বর আন্দরকিল্লা ওয়ার্ড থেকে চার বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর। তিনি নগর আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক। প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর আস্থাভাজন ছিলেন। এখন উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের ঘনিষ্ঠ। জহরলাল হাজারী সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি টাকা-পয়সা দিতে পারছি না। গরীব মানুষ। কাউন্সিলর পদ ব্যবহার করে এক টাকাও অবৈধ ইনকাম করিনি। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে কাউন্সিলর হয়েছিলাম। আমি রাজনীতি করি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় চট্টগ্রামে প্রথম গ্রেফতার করা হয়েছিল আমাকে। মহিউদ্দিন ভাইয়ের বিশ্বস্ত ছিলাম— এ অপরাধে আমার ওপর অমানুষিক নির্যাতন হয়েছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলররা সবাই আমাকে নিজেদের ভাইয়ের মতো ভালোবাসে। টাকা-পয়সা দিতে না পারলেও কথা দিচ্ছি, আমি সবসময় ফোন ধরব। সুখে-দুঃখে এগিয়ে যাব। আরা যারা টাকা দিয়ে ভোট কিনতে চাচ্ছেন, তারা জিতে গেলে কাউন্সিলরদের ফোনও ধরবেন না।’
১৫ নম্বর বাগমনিরাম ওয়ার্ড থেকে পাঁচ বার নির্বাচিত কাউন্সিলর মো. গিয়াস উদ্দিন। তিনি সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। পারিবারিকভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত এবং নেতাকর্মীদের কাছেও গ্রহণযোগ্য। গিয়াস উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘শুনেছি, কেউ কাপড়-চোপড় পাঠাচ্ছে, কেউ সোনার চেইন, কেউ টাকা-পয়সা দিচ্ছেন। কাউন্সিলররা সবাই জনগণের ভোটে নির্বাচিত অভিজ্ঞ মানুষ। আশা করি চিন্তাভাবনা করে তারা ভোটটা দেবেন। আমি ২১ বছর ধরে কাউন্সিলরের দায়িত্ব পালন করছি। নতুন-পুরাতন সবার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক, শ্রদ্ধা-ভালোবাসার সম্পর্ক। মেয়রকে সহযোগিতা করার জন্য আমি প্যানেল মেয়র পদে জিততে চাই।’
এনায়েত বাজার, পূর্ব মাদারবাড়ি ও আলকরণ সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছেন নীলু নাগ। তিনি চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। রাজনীতিতে প্রয়াত নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারী। নীলু নাগ সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমি দুইবার কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছি। জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমার কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমি মানুষের জন্য আরও ভালো কিছু করার প্রত্যাশায় প্রার্থী হচ্ছি।’
উপহার দিচ্ছেন কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি দিচ্ছি না। যার খুশি সে দিচ্ছে। এটা আসলে ভোটের জন্য দিচ্ছেন, বিষয়টা সেরকম না। আমরা কাউন্সিলররা সবাই এক পরিবারের মতো। পরিবারের সদস্যদের তো একজন আরেকজনকে উপহার দিতেই পারেন। উপহার দিয়ে কেউ কিন্তু ভোট চাচ্ছেন না।’
সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে হাসান মাহমুদ হাসনী, নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু ও শৈবাল দাশ সুমন এবং জোবাইরা নার্গিস খান, লুৎফুন্নেছা দোভাষ বেবি, ফেরদৌস বেগম মুন্নি ও জেসমিন পারভীন সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এদের মধ্যে হাসনী ও মঞ্জু গতবারও প্যানেল মেয়র ছিলেন, যারা তৎকালীন মেয়র নাছিরের পছন্দের হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
দুই দফায় রামপুর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচিত আব্দুস সবুর লিটন উপমন্ত্রী নওফেলের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। আর প্রবীণ কাউন্সিলর সাইয়েদ গোলাম হায়দার মিন্টু প্রয়াত এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি চকবাজার ওয়ার্ড থেকে সাত বার কাউন্সিলর হয়েছেন। ভিন্নধারার সৎ জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকার মানুষের কাছে তার মূল্যায়ন আছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটি করপোরেশনের দুই কাউন্সিলর বলেন, ‘কাউন্সিলরদের মধ্যে প্যানেল মেয়র পদ নিয়ে প্রবল আগ্রহ। আরও বেশি আগ্রহ তারা যাদের আশীর্বাদপুষ্ট সেইসব নেতাদের। প্যানেল মেয়র পদে জিতলে মেয়রের পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে— এমন ভাবনা আছে অনেকের মধ্যে। আবার সামনে আওয়ামী লীগ-যুবলীগের সম্মেলন আছে। প্যানেল মেয়র হলে সেখানে পদ-পদবী পাবার পথ সুগম হবে বলে অনেকে ভাবছেন। তবে সিটি করপোরেশনের কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে রাখাটাই মুখ্য বলে মনে হচ্ছে।’
সারাবাংলা/আরডি/টিআর