Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

টুঙ্গিপাড়ার খোকার নাতিদীর্ঘ গল্প

তুহিন সাইফুল, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট
১৭ মার্চ ২০২১ ১৬:৪৬

ঢাকা: এই গল্পটি তখনকার যখন বৃষ্টি থেকে বাঁচতে ছাতা কেনার বিষয়টিও ছিল বিলাসিতা। তবে ওই সময় খোকার একটি ছাতা ছিল। স্কুল থেকে ফিরতে রাস্তায় নামল ঝুম বৃষ্টি। ফিরতি পথের বৃষ্টিতে দুজন মানুষকে ভিজতে দেখে খোকা নিজের ছাতাটি দিয়ে দিলেন। তারপর নিজেই ভিজতে ভিজতে বাড়ি ফিরলেন!

সকালের সূর্য যেভাবে বলে দেয় দিনের গতিপথ- সেভাবেই খোকার শৈশবের মহানুভবতার এই ছোট্ট সাক্ষরটি বলে দিয়েছিল বড় হয়ে কেমন মানুষ হবে সে! পরে খোকা বড় হয়েছে; তবে এতটাই বড় হয়েছে যে, গোটা দুনিয়াই দেখেছে তার মহানুভবতা আর মহৎ হৃদয়ের সব সাক্ষর আর কীর্তি।

বিজ্ঞাপন

খোকা বেড়ে উঠেছেন তিতুমীর, হাজী শরীয়ত, সিরাজ, ক্ষুদিরাম বসু আর মাস্টারদা সূর্য সেনদের গল্প শুনে শুনে। এদের গল্প, দেশের জন্য আত্মত্যাগ ছোট্ট খোকার মনে তৈরি করে দিয়েছে দেশের জন্য প্রবল দায়িত্ববোধ।

খোকা যখন নবম শ্রেণিতে তখনই তিনি নাম লিখিয়েছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক আর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আন্দোলনে। ইংরেজদের সঙ্গে লড়াই করতে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কলকাতায়। এক চিঠিতে আগেই তাদের জানিয়েছিলেন সেই খবর। সেই চিঠি পেয়ে সোহরাওয়ার্দীও পড়ায় মন দিতে বলেন তাকে। উপদেশ দিলেন এন্ট্রান্স (এসএসসি) পরীক্ষার পর যোগাযোগ করতে।

যে খোকার গল্প বলছি সেই খোকাই পরে হয়েছেন শেখ মুজিব। জন মানুষের মুজিব ভাই। বাঙালির জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। মানুষের ইতিহাসে যিনি স্থান করে নিয়েছেন শেরেবাংলা আর সোহরাওয়ার্দীরও অনেক উপরে।

১৯৩৯ সালেও একবার অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক গোপালগঞ্জ মাথুরানাথ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে এসেছিলেন। সঙ্গে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। স্কুল দেখে মন্ত্রী যখন ফিরছিলেন, এমন সময় সদ্য কৈশোরের শেষ অধ্যায়ে থাকা খোকা একেবারে মুখ্যমন্ত্রীর সামনে দাঁড়ালেন। মন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, সে কি চায় তার কাছে। খোকার দাবি, স্কুলের সংস্কার চায় সে।

বিজ্ঞাপন

ছোট্ট খোকার সততা আর দায়িত্ববোধ শেরে বাংলাকে মুগ্ধ করল। মেরামত হলো স্কুল। শিক্ষার্থী আবারও মন দিল পাঠে। শেরে বাংলা আর সোহরাওয়ার্দী মনে রাখলেন ওই কিশোরকে। সেবছরই একবার বেড়াতে কলকাতা যান খোকা। দেখা করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। সোহরাওয়ার্দীকে জানিয়েই তিনি গোপালগঞ্জে ইংরেজ বিরোধী ছাত্রসংগঠন করারও প্রস্তাব দেন। এর মাধ্যমেই খোকা প্রবেশ করেন রাজনীতির ভেতরকার দুনিয়ায়।

বলা যায়, ১৯৪১ সালে মেট্রিক পরীক্ষার সময় থেকে খোকা সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গেলেন। খোকা থেকে হয়ে উঠলেন মুজিব ভাই।। গোপালগঞ্জের মুসলিম লীগ আর ছাত্র সমাজের পরিচিত মুখ। এ সময় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তান আন্দোলন চলছিল।

এন্ট্রান্স পরীক্ষার পর পড়ালেখা আর রাজনীতির টানে তিনি চলে গেলেন কলকাতায়। নানা সভা-সমিতিতে যোগ দিতে থাকেন। সেখান থেকে মাদারীপুরে এসে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন করেন। এ সময় থেকে তার ঘন ঘন যোগাযোগ হতে থাকে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে। শেখ মুজিব মেট্রিক পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হলেন। এর পর ভর্তি হলেন কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে। তার থাকার জায়গা হয় বেকার হোস্টেলে। সেখান থেকেই তিনি সোহরাওয়ার্দীর ছায়ায় বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে থাকেন।

শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজেও একজন ছাত্রনেতা হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে পড়েন। ওই সময়ে তার রাজনৈতিক অবস্থানের পরিচয় শেখ মুজিবের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী বই থেকেও জানা যায়।

শেখ মুজিব জন্মেছিলেন অভিবক্ত ভারতবর্ষের টুঙ্গিপাড়ায়, ১৯২০ সালে। ১৯৪৩ সালে তার বয়স তখন ২৩। সেবছরই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সমীকরণে বাংলায় হানা দেয় নিদারুণ এক মন্বন্তর। মুজিবও সেবছর আত্মপ্রকাশ করেন পরম একজন মানবতাবাদী ছাত্রনেতা হিসেবে। দুর্ভিক্ষে যখন বাংলার লাখ লাখ মানুষ মারা যাচ্ছে, তখন কলকাতায় পরিযায়ী ছাত্র শেখ মুজিব পথে পথে ঘুরছেন এই মানুষদের খাবারের সন্ধানে।

মন্বন্তরের বছর শেখ মুজিবুর রহমান তার রাজনৈতিক গুরু সোহরাওয়ার্দীকে মানুষের জন্য কাজ করতে তাগাদা দিতেন। সোহরাওয়ার্দী তখন মন্ত্রী পরিষদের সদস্য। এই দুজনের প্রচেষ্টায় সারাদেশে লঙ্গরখানা খোলা হয় দুঃস্থ, অভাবগ্রস্থ মানুষের বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় খাবার তুলে দিতে।

সেসময় ছিল বঙ্গবন্ধুর ছাত্র জীবনের একেবারেই শুরুর সময়। বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে পড়াশোনা করতেন, থাকতেন হোস্টেলে। মন্বন্তরের সময় সারাদিন অসহায় মানুষর জন্য ছুটে বেড়িয়ে রাতে এসে পার্টি অফিসের বেঞ্চে ঘুমাতেন। নিজের খরচের টাকা থেকে বাঁচিয়ে ক্ষুধার্ত মানুষের জন্য কাজ করতেন।

এর তিন বছর পর বাংলার মানুষ পরিচিত হয় সাম্যবাদী মুজিবের সঙ্গে। ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গায় কলিকাতার স্থানীয় পর্যায়ে মূল দাঙ্গা প্রতিরোধে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। এরপরের বছরেই ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে জন্ম নেয় দুটি নতুন রাষ্ট্র ইন্ডিয়া ও পাকিস্তান। যে পাকিস্তানের অংশ হয় পূর্ববাংলাও। আর এই পূর্ববঙ্গের স্বাধীনতার লড়াইয়েই শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বঙ্গবন্ধু।

বাংলাদেশ পাক্স্তিানের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরের বছরই শুরু হয় ভাষা আন্দোলন। পাকিস্তানের নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ সিদ্ধান্ত নেন উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এটি তিনি ঘোষণাও দেন প্রকাশ্য জনসভায়। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্রদের এক সভায় দেওয়া বক্তৃতায় প্রথম জিন্নাহর এই ঘোষণার প্রতিবাদ করেন শেখ মুজিব। রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার দাবি জানিয়ে সেসময়ের সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখতে দিতে থাকেন নতুন নতুন কর্মসূচি। সেসময় বিরোধী আন্দোলনের প্রধান হিসেবে গ্রেফতার হন মুজিব। কিন্তু তার শুরু করা ভাষার লড়াই চলতে থাকে। বরং তার গ্রেফতারে কারণে আন্দোলন ফুঁসে ওঠে।

এরপরের যে গল্প সে গল্প আরও বিশাল আর বর্ণিল। যে গল্পের নায়ক ‘বঙ্গবন্ধু’। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে লেখক ও দার্শনিক আহমদ ছফা লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ। একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে।’

সারাবাংলা/টিএস/পিটিএম

টুঙ্গিপাড়ার খোকা নাতিদীর্ঘ গল্প বঙ্গবন্ধুর ১০১তম জন্মবার্ষিকী

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর