দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক খাতে ১৪৪ কোটি টাকার প্রস্তাব
১৮ মার্চ ২০২১ ০৮:০৫
ঢাকা: ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ কাজে লাগাতে দেশের তরুণ জনগোষ্ঠীর দক্ষতা উন্নয়নে বড় অংকের ঋণ দিচ্ছে শ্বিব্যাংক। এই ঋণের টাকায় বাস্তবায়ন করা হবে ‘অ্যাকসিলারেটিং অ্যান্ড স্ট্রেনদেনিং স্কিলস ফর ইকোনমিক ট্রান্সফরমেশন (এএসএসইটি)’ শীর্ষক প্রকল্প। কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে কাজ করবে এই প্রকল্প।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৪ হাজার ২৯২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে এক হাজার ৭১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ও বিশ্বব্যাংকের ঋণ থেকে ২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য রয়েছে। তবে এরই মধ্যে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির বেশকিছু ব্যয় প্রাক্কলন নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে পরিকল্পনা কমিশন থেকে।
প্রকল্পটির প্রস্তাবনায় পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৪৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। এছাড়া ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ও টেলেক্স খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১০৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা। এর সঙ্গে সেমিনার কনফারেন্সের ব্যয় ধরা হয়েছে আরও ৬০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। আরও বেশ কয়েকটি খাতসহ এই খাতগুলোতে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের সংস্থার রাখার যৌক্তিকতা প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটিকে (পিইসি) অবহিত করতে বলা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভাটি আজ বৃহস্পতিবার (১৮ মার্চ) অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। এতে সভাপতিত্ব করবেন কমিশনের আর্থসামাজিক অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোছাম্মৎ নাসিমা বেগম। পিইসি সভা প্রকল্পটি নিয়ে সন্তুষ্ট হলে এটি প্রক্রিয়াকরণ করা হবে এবং অনুমোদনের জন্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে উত্থাপন করা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে চলতি বছর থেকে শুরু হয়ে ২০২৬ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পরিকল্পনা রাখা হয়েছে।
পিইসি সভার জন্য তৈরি কার্যপত্রে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সাম্প্রতিক দশকে দ্রুত সামাজিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতি সাধন করে একটি মধ্যম আয়ের স্থিতিতে পৌঁছেছে। দেশে বর্তমান ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ চলছে। এর সুফল পেতে হলে আমাদের কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীকে দক্ষ করে গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই। এ ক্ষেত্রে কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।
দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার গুরুত্ব তুলে ধরে এতে বলা হয়েছে, প্রতিনিয়ত প্রযুক্তির পরিবর্তন ও উন্নয়ন হচ্ছে। আমাদের শিল্প কারখানাগুলোও আগের তুলনায় অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর হয়ে পড়েছে। দেশ-বিদেশে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে দক্ষ কর্মীর চাহিদা। এদিকে, আমাদের নারী শ্রমশক্তির অংশগ্রহণ সাম্প্রতিক সময়ে বাড়লেও চাকরির হারে নারীরা এখনো অনেকটা পিছিয়ে। সেই সঙ্গে দেখা দিয়েছে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস। অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রেও এটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। অনগ্রসর ও নারী কর্মীদের জন্য এই ক্ষতিটি মারাত্বক আকার ধারণ করেছে।
এ পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পর্যাপ্ত আপগ্রেডেশনের প্রয়োজনীয়তা এবং কোভিড পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন উদ্যেগে প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থেকে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা ও কর্মক্ষম থাকার জন্য যুগোপযোগী দক্ষতা অর্জনে মনোযোগী হওয়া জরুরি বলে মনে করছেন কারিগরি শিক্ষা অধিদফতর। সে কারণেই এই প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হচ্ছে।
কারিগরি শিক্ষা অধিদফতরের অধীনে দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগ এই প্রথম নয়। এর আগে ২০১০ সালের জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘স্কিল অ্যান্ড ট্রেনিং এনহ্যান্সমেন্ট (স্টেপ)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে। ওই প্রকল্পের মাধ্যমে অনগ্রসর যুবসমাজকে স্বল্প সময়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে কর্মমুখী ও উন্নয়ন সহায়ক হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছে। সে কারণেই নতুন সময়ের চাহিদা পূরণে নতুন করে দক্ষ জনশক্তি গড়তে এএসএসইটি শীর্ষক প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয়েছে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণকে সম্প্রসারণ করা এবং এগুলোর মান্ন উন্নত করার লক্ষ্য থাকবে প্রকল্পটির। দক্ষতা খাতে নতুন প্রযুক্তি নেওয়ার জন্য উচ্চতর বিনিয়োগকে অগ্রাধিকার দেওয়ার পাশাপাশি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে শ্রম উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি কর্মসংস্থান বাড়ানোর দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় প্রকল্পটি প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে— তিনটি অনাবাসিক ভবন নির্মাণ, প্রশিক্ষণ, প্রশিক্ষণ অনুদান, প্রকল্প অনুদান, কনসালট্যান্সি, সেমিনার ও কনফারেন্স ব্যয়, আইসিটি সরঞ্জাম, কম্পিউটার সরঞ্জাম কেনা, অফিস সরঞ্জাম ও ফার্নিচারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি কেনা এবং টিভেট সেক্টরে কোভিড-১৯ মোকাবিলা সংক্রান্ত সচেতনতা তৈরিতে সহায়তা দেওয়া।
তবে পরিকল্পনা কমিশনের শিক্ষা উইংয়ের উপপ্রধান মাকসুদা হোসেন পিইসি সভার কার্যপত্রে কমিশনের মতামত দিতে গিয়ে বেশকিছু পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। প্রকল্পের আওতায় ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটগুলোকে আইডিজি দেওয়ার বিষয়ে উল্লেখ আছে। এক্ষেত্রে ইনস্টিটিউট নির্বাচনের পদ্ধতি, ইনস্টিউটের সংখ্যা ও ইনস্টিটিউটগুলোর কাছ থেকে কোনো চাহিদা নেওয়া হয়েছে কি না— সে সম্পর্কে সভায় উল্লেখ করা প্রয়োজন ছিল বলে মত দেন তিনি।
প্রকল্পটির বেশকিছু খাতের ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন মাকসুদা হোসেন। প্রকল্প প্রস্তাবনায় সেমিনার কনফারেন্সে ৬০ কোটি ৩০ লাখ টাকা; ইন্টারনেট, ফ্যাক্স, টেলেক্স খাতে ১০৯ কোটি ৩২ লাখ টাকা; এবং পরামর্শক (কনসালট্যান্সি) খাতে ১ হাজার ৩৫৪ জনমাসের জন্য ১৪৪ কোটি ৩৮ লাখ টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। মাকসুদা হোসেন মত দিয়েছেন— এসব ব্যয়ের যৌক্তিকতা ও নির্ধারণের ভিত্তি পিইসি সভাকে অবহিত করা প্রয়োজন। এছাড়া ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) সম্মানি অনুদান বাবদ ২ কোটি ৫০ লাখ টাকা, প্রকল্প অনুদান বাবদ ১০ কোটি ২৫ লাখ টাকা ও প্রশিক্ষণ অনুদান বাবদ ২ হাজার ১৭ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে খাতগুলোকে স্পষ্ট করা প্রয়োজন বলেও মত দিয়েছেন তিনি।
প্রকল্পে তিনটি অনাবাসিক ভবন নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৮০ কোটি টাকা। এক্ষেত্রে ভবনগুলো কত তলা পর্যন্ত নির্মাণ করা হবে, সে বিষয়টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ নেই প্রস্তাবনায়। প্রস্তাবিত প্রকল্পে ৩৪ জন জনবলের বেতন-ভাতার জন্য আলাদা খাত রাখা হয়েছে। তবে এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি জনবল কমিটির সভায় প্রেষণে ১২ জন এবং আউটসোর্সিং নীতিমালার সেবার আওতায় ১৫ জনসহ মোট ২৭ জন জনবলের সুপারিশ করা হয়। সে অনুযায়ী জনবল খাতের ব্যয়, ড্রাইভারের সংখ্যা ও যানবাহনের সংখ্যা নির্ধারণ করার কথা বলা হয়েছে পিইসি সভায় উপস্থাপনের জন্য তৈরি কার্যপত্রে।
এদিকে, প্রস্তাবিত প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় বিভাজনে বিশ্বব্যাংক থেকে প্রকল্প সাহায্যে হিসেবে ২ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা সংস্থানের প্রস্তাব করা হয়েছে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের এ সংক্রান্ত কোনো সম্মতিপত্র ডিপিপিতে উল্লেখ নেই।
এই বিষয়গুলোর যৌক্তিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করার পর সেই ব্যাখ্যায় পিইসি সভার সদস্যরা সন্তুষ্ট হলেই প্রকল্পটি একনেক বৈঠকে উত্থাপনের জন্য প্রক্রিয়াকরণ করা হবে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর