পাকিস্তান ঠিকই বুঝেছিল বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার সংগ্রাম করছে
১৯ মার্চ ২০২১ ২১:৩০
ঢাকা: জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিববুর রহমান যে বাংলাদেশের মানুষের জন্যই সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন, এটা আর কেউ না বুঝুক, পাকিস্তানি শাসকরা খুব ভালোভাবে সেটা বুঝেছিল বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
শুক্রবার (১৯ মার্চ) বিকেলে রাজধানীর জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে মুজিব চিরন্তন প্রতিপাদ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানে সভাপতির ভাষণে তিনি একথা বলেন। বাক প্রতিবন্ধীদের ইশারায় জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য মুজিব চিরন্তন প্রতিপাদ্যে তৃতীয় দিনে ‘‘যতকাল রবে পদ্মা-যমুনা’ অনুষ্ঠান শুরু হয়।
এতে সম্মানিত অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং ভিডিও বার্তায় শুভেচ্ছা বার্তা দেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
১৭ই মার্চ প্রথম দিনে ‘ভেঙেছ দুয়ার, এসেছ জ্যোতির্ময়’ মুজিব চিরন্তন প্রতিপাদ্যে ১০ দিনের অনুষ্ঠান শুরু হয়। আজ জাতির জন্ম শতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে শ্রীলঙ্কান এয়ারের একটি ফ্লাইটে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছান শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দ্রা রাজাপাকসে।
আজকের অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিক্ষাবিদ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। ১ম পর্বে আলোচনা সভার অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন নবনীতা চৌধুরী।
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের উপস্থিতি উদযাপনকে মহিমান্বিত করেছে অভিহিত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘শ্রীলঙ্কা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ। বাংলাদেশ এবং শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক ইস্যুতে একই ধরনের মনোভাব পোষণ করে এবং আমরা পরস্পরকে সমর্থন ও সহযোগিতা দিয়ে থাকি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু এবং তিনি সবসময়ই বাংলাদেশের পাশে অবস্থান করেন। আমিও চেষ্টা করি সেই বন্ধুত্বের প্রতিদান দিতে।’
বাংলাদেশের জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসের যোগদান তার নিজের এবং শ্রীলঙ্কার জনগণের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কেরই প্রতিফলন। আমি নিজে, আমার সরকার এবং বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে শ্রীলঙ্কার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে এবং তার দেশের জনগণের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী।
আমি আশা করি আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যকার এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় হবে। পাশাপাশি রাশিয়ার পররারাষ্ট্রমন্ত্রী যে বার্তা পাঠিয়েছেন সে জন্যও ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু আরেকটি দেশ। মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তীকালে যারা সবসময় আমাদের পাশে থেকেছেন এবং আজকে আমরা যে নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট তৈরি করছি, এটা তাদেরই অবদান।’
শেখ হাসিনা জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্মরণ করে বলেন, ‘এই হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ, মূলত তাদের অধিকার যেমন হারিয়েছিল। আর যারা ক্ষমতা দখল করেছিল তারা বাংলাদেশের মহান মুক্তিসংগ্রাম এবং স্বাধীনতার ইতিহাস থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নাম চিরতরে মুছে ফেলার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। কিন্তু সত্যকে কখনো কেউ মুছে ফেলতে পারে না। আজকের দিনে সেটাই প্রমাণিত সত্য।’
‘‘আজকে মার্চ মাস, আমাদের দেশের জন্য আমাদের জাতির জন্য, জাতির ইতিহাসের জন্য একটা অনন্য মাস। ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদার যে আন্দোলন শুরু, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগের ছাত্র। তিনি এই সংগ্রাম সূত্রপাত করেছিলেন এবং ১১ই মার্চ ভাষা আন্দোলন শুরু হয়েছে।
১৯৫২’ তে রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের ভাষার অধিকার পাই। ১১ই মার্চ যখন আন্দোলন হয় তখন কিন্তু শেখ মুজিবসহ আমাদের অনেক ছাত্রনেতাকে সেইদিন গ্রেফতার করা হয়। এরপর ১৫ তারিখ তারা মুক্তি পান। কিন্তু মুক্তি পাওয়ার পরপরেই আন্দোলন কিন্তু থেমে যায়নি। আন্দোলন অব্যাহত থাকে। আন্দোলনের পথ বেয়েই আমরা এগিয়ে যাই। একইসঙ্গে পরপর তিন বার সেই সময় গ্রেফতার হন। অর্থ্যাৎ যখনি বাঙালির কথা বলার চেষ্টা করেছেন, যখনি বাংলাদেশের মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কথা বলেছেন, তখনি তার ওপর নেমে এসেছে চরম আঘাত।
কিন্তু জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কখনো থেমে যাননি দাবি করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি এদেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আমরা দেখেছি, ইতিহাসের পাতায় যখনি তিনি বাংলাদেশের অধিকারের কথা বলেছেন, তখনি কিন্তু চরম আঘাত এসেছে।’
জাতির পিতা ভাষা আন্দোলন করতে যেয়ে, যখন বারবার গ্রেফতার হয়েছেন, ১৯৪৯ সালে যখন তাকে গ্রেফতার করা হল, আর তিনি মুক্তি পাননি। ১৯৫২ সালে ২৭ই ফেব্রুয়ারি তিনি মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু সে মুক্তি পেয়েও সাথে সাথে তিনি আবার তার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে থাকেন এবং এই সংগ্রামের পথ বেয়ে তখন যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয় ১৯৫৪ সালে।
সেই প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করার কথা পটভূমি তুলে ধরে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘বাঙালির হাতে, সত্যিকার যারা বাঙালি জাতির কথা চিন্তা করত, তারা ক্ষমতায় থাকুক, এটা আসলে পাকিস্তানি শাসক কখনো চায়নি। সেই সরকার বেশিদিন ঠিকতে পারেনি। সেই সরকার ইমাজেন্সি ডিক্লেয়ার করে ৯২(ক) ধারা দিয়ে সেই সরকার পতন ঘটিয়ে এই পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় শাসন চালু করা হয়। এবং ৩০ মে ১৯৫৪ সালে সরকার ভেঙে দেয় এবং তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবসহ সকলে আবার বন্দি হয়। তাদেরকে গ্রেফতার করা হয়। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৫৪ সালে মুক্তি পান। এরপর আওয়ামী লীগ ১৯৫৬ সালে সরকার গঠন করে। আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করেই কিন্তু সবসময় এই অঞ্চলে উন্নয়নের জন্য কাজ করে। দুভার্গ্য হলো, সেই সরকার বেশিদিন ঠিকতে পারল না। ১৯৫৮ সালে মার্শাল’ল জারি হল। মার্শাল’ল জারি হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, আবার গ্রেফতার হলেন ৭ই অক্টোবর। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হয় ১১ই অক্টোবর বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় এবং তাকে ১২ই অক্টোবর গ্রেফতার করে।’
ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়ে যে যাত্রা শুরু, সেই থেকে ধাপে ধাপে আমাদের স্বাধীনতা এবং স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন। এই যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে যে বারবার গ্রেফতার করা হয়, তাতে কিন্তু তিনি কখনো দমে যাননি। তিনি কিন্তু তার সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। একটি জাতিকে স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বুদ্ধ করেছেন এবং এই সংগ্রামের পথ বেয়েই কিন্তু আমরা আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করি বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
পাকিস্তান আমলে আন্দোলন সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জাতির পিতাকে বারবার গ্রেফতার এবং মুক্তি দেওয়াসহ মিথ্যা মামলা দেওয়ার ঘটনা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, ‘কাজেই তিনি যে বাংলাদেশের মানুষের জন্যই সংগ্রাম করে যাচ্ছিলেন, এটা আর কেউ না বুঝুক পাকিস্তানি শাসকরা খুব ভালভাবে সেটা বুঝেছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘তিনি একটা লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। সেই লক্ষ্যটা হল দেশকে স্বাধীন করা এবং ১৯৫৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে সেই কেবিনেটে তিনি মন্ত্রীত্ব পেয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মাওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে কাগমারী কনফারেন্সের পর তিনি আওয়ামী লীগ ভেঙে দেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে আরেকটি দল গঠন করে। তিনি যখন আওয়ামী লীগ ভেঙে দেন এবং আওয়ামী লীগ থেকে চলে যান, তখন আওয়ামী লীগ সংগঠনটাকে শক্তিশালী করা, একান্তভাবে প্রয়োজন ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সেই সময় তিনি কিন্তু মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে, দলের সাধারণ সম্পাদক যে পদ তিনি পান এবং মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন। আওয়ামী লীগ সংগঠনকে শক্তিশালি করে গড়ে তোলার জন্য।
‘কারণ তিনি জানতেন যে যেকোন একটা অর্জন করতে হলে একটা শক্তিশালী সংগঠন দরকার। আমরা দেখি পৃথিবীতে মানুষ দল পরিবর্তন করে ফেলে, দলের পদ ছাড়ে মন্ত্রীত্বের লোভে, আর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রীত্ব ছেড়ে ছিলেন দলকে সুসংগঠিত করার জন্য। এই দৃষ্টান্ত আসলে খুব কমই পাওয়া যায়। কিন্তু তার জন্য তাকে অনেক নির্যাতনেরও শিকার হতে হয়। কিন্তু তিনি সবকিছুই মেনে নিয়েছিলেন। এভাবেই তিনি এদেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন।
জাতির পিতার নিজের জীবনের কোন চাওয়া-পাওয়াও তার ছিল না দাবি করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, ‘এই বাংলার মাটি, যা হাজার বছরের পরাধীনতার গ্লানি বয়ে বয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই কিন্তু প্রথম এই মাটির সন্তান, যিনি এই দেশকে স্বাধীন করেছেন এবং এদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। এরপরে প্রধানমন্ত্রীত্ব পান। আপনারা একটু খুঁজে দেখবেন, যখনি এই বঙ্গ বলেন, পূর্ববঙ্গ বলেন বা পাকিস্তান আমলে সেই পূর্ব পাকিস্তান বলেন, এদেশের শাসনভার কিন্তু এমনকি তার পরবর্তী সময়ও যারা এসেছে, স্বাধীনতার পরে ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পরে যারা এসেছেন, তাদেরও জন্ম কিন্তু কারো বাংলাদেশের মাটিতে হয়নি। এই ভূমিপুত্র বা ভূমির সন্তান একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যে কারণে এদেশের মানুষের প্রতি তার সবসময় আলাদা একটা ভালবাসা ছিল, দায়িত্ববোধ ছিল।’
‘তিনি খুব সৌভাগ্যবান ছিলেন, তার পিতা-মাতা সবসময় তার পাশে ছিলেন। তাকে সহযোগিতা করেছেন। আর সবথেকে বড় সহযোগিতা আমার মা। আমার মা তার পাশে থেকে প্রেরণা জুগিয়েছেন। কোনদিন নিজের কোন চাহিদা ছিল না। কোনদিন সংসারের কোন কিছু বলে ব্যতিব্যস্ত করতেন না। সবকিছু তিনি নিজে সামলাতেন। যখন আমার বাবা জেলে থাকতেন, দল সংগঠন সবকিছু তিনি নিজে করতেন।’ এ ধরনের একজনকে সবসময় পাশে পেয়েছিলেন বলেই কিন্তু তিনি তার সংগ্রাম এগিয়ে নিতে যেতে পেরেছিলেন এবং এদেশের মানুষকে মুক্তি দিতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন শেখ হাসিনা।
সারাবাংলা/এনআর/একে