Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

শরণার্থী স্বীকৃতি রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশকে সহায়তা করবে


২৩ মার্চ ২০২১ ২১:০১

রোহিঙ্গা সংকট ঘিরে গত কয়েকবছর ধরেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া তো বটেই, বিশ্বরাজনীতিতেই যথেষ্ট আলোচিত মিয়ানমার। এর মধ্যে গত ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে ফের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করলে দেশটি নতুন করে আলোচনায় আসে। সামরিক ওই অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) শীর্ষ নেতা অং সান সুচিসহ অন্য নেতাদেরও গৃহবন্দি করা হয়। সু চির বিরুদ্ধে এরই মধ্যে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লোপাটের অভিযোগ আনা হয়েছে। এদিকে, দেশটিতে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে চলছে বিক্ষোভ-প্রতিবাদও। সে প্রতিবাদে অংশ নিয়ে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৭০ জনেরও বেশি মানুষ।

বিজ্ঞাপন

মিয়ানমারের চলমান এই পরিস্থিতি অত্যন্ত নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা সংকট সমাধান ও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে দেশটির এই পটপরিবর্তন কতটুকু প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে কৌতূহল ও উদ্বেগ রয়েছে বিভিন্ন মহলেরই। সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে দেশটির রাজনৈতিক পটপরিবর্তন নিয়ে চীন, ভারত, রাশিয়ার প্রতিক্রিয়া নিয়েও রয়েছে নানা প্রশ্ন।

মিয়ানমারকে ঘিরে এসব প্রশ্ন, কৌতূহল ও উদ্বেগ নিয়ে সারাবাংলার সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজীমউদ্দিন খান। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির পাশাপাশি কূটনীতি তার আগ্রহের বিষয়। মিয়ানমারের চলমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, রোহিঙ্গা সংকটের ওপর দেশটির সামরিক অভ্যুত্থানের প্রভাব এবং এসবের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংশ্লিষ্ট জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সারাবাংলার নিউজরুম এডিটর নূর সুমন। তাকে সহযোগিতা করেছেন অ্যাসিস্ট্যান্ট নিউজ এডিটর মুনীর মুমতাজ

সারাবাংলা: মিয়ানমারে ফের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। অভ্যুত্থানের আগে দেশটিতে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের প্রধান অং সান সু চিসহ শীর্ষ নেতাদের গৃহবন্দি করা হয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর এই সময়ে এসে এরকম সামরিক অভ্যুত্থানকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: বিষয়টিকে দুইভাবে দেখা যায়। এই সময়ে বিশ্বব্যাপী যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে, তা একদমই সংখ্যাগরিষ্ঠের গণতন্ত্র। সেটা আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপের অনেক দেশেও দেখছি। এসব দেশে গণতন্ত্র থাকলেও তাতে সামগ্রিকভাবে সব মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন নেই । সংখ্যা লঘিষ্ঠ ভিন্ন মানুষ ও ভিন্ন চিন্তাকে ধারণের প্রবণতা নেই। গণতন্ত্র থাকলেও এক ধরনের অতি জাতীয়তাবাদী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, যাকে এথনো-ন্যাশনালিজম বা শ্যভিনিজম (উগ্র জাতীয়তাবাদ) বলা যায়। এগুলো খুব প্রবল হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ গণতন্ত্র বলতে আমরা যা বুঝি, সেই গণতন্ত্র কিন্তু অনুপস্থিত। গণতন্ত্রের আড়ালে রাষ্ট্রগুলোতে ভয়ংকরভাবে একনায়কতন্ত্রের প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

এখন মিয়ানমারের দিকে যদি তাকাই সত্যিকার অর্থে দেশটির রাষ্ট্র হিসেবে বিকাশ ঘটার যে প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার কথা ছিল, তা হয়নি। দেশটিতে একটা সময় সামরিক শাসনের অবসানের পর গণতন্ত্রায়ন যে যাত্রা শুরু হলো তাকে আমি গণতন্ত্রের সামরিকীকরণ বলে মনে করি। কেননা, মিয়ানমারে তাদের জাতীয় সংসদের ২৫ শতাংশ আসন সেনাবাহিনীর দখলে। সীমান্ত সম্পর্কিত, প্রতিরক্ষা আর স্বরাষ্ট্র— এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ও তাদের অধীন। সবকিছু মিলিয়ে আসলে ওই অর্থে দেশটিতে গণতান্ত্রিক কাঠামোর উপস্থিতি ছিল না। অনেকে এটাকে ‘সিউডো-ডেমোক্রেসি বা সিউডো-মিলিটারি ডিকটেটরশিপ বলে থাকেন। ফলে এখনকার সামরিক অভ্যুত্থানে খুব বড় পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র চরিত্র পরিবর্তনের যে সামান্য সম্ভবনাটা তৈরি হয়েছিল, সেটা থেমে গেল— এ কথা বলা যায়।

মিয়ানমারের গত নির্বাচনকে বিবেচনায় নিলে দেখব, ওই ৮০ শতাংশ ভোট পেয়েছিল অং সান সু চির দল এনএলডি। ফলে নিশ্চিতভাবেই জনমানুষ পর্যায়ে ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এতে প্রাতিষ্ঠানিক বা সংবিধানিকভাবে মিয়ানমারের রাষ্ট্রব্যবস্থার সামরিক কাঠামো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ তারা মোকাবিলা করতে পারবে কিনা, সেই আশঙ্কা বা ভীতি থেকেই সামরিক বাহিনী হয়তো আবার আসল রূপে ফিরে এসেছে। সেদিক থেকে পরিবর্তনটা এটাই— যারা কিছুদিন আগেও পেছনে ছিল, তারা আবার সামনে এসেছে। তবে রাজনৈতিক নেতা হয়েও সু চি বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক অতি জাতীয়তাবাদী প্রবণতা ধারণ করেছিল যা অন্তত সেনাবাহিনীর সাথে এক ধরনের মতাদর্শিক ঐক্য তৈরি করেছিল। ফলে মিয়ানমারে সবার জন্য গণতন্ত্র অর্থে তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন আসেনি।

সারাবাংলা: ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের তীব্র সমালোচনা করছে। তবে এ ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান কিছুটা নমনীয় দেখা যাচ্ছে। এমনকি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে আনা যৌথ বিবৃতিতেও ভেটো দিয়েছে দেশ দু’টি। এর কারণ কী হতে পারে বলে আপনি মনে করেন?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক— অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখতে হবে। পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে ভারত, চীন ও রাশিয়াকে মেলাতে চাই না। যুক্তরাষ্ট্রে জো বাইডেন ক্ষমতায় আসার পর গণতন্ত্রের অঙ্গীকার করেছেন, যা ট্রাম্প প্রশাসনের নীতি থেকে ভিন্ন। পশ্চিমা বা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানও একই। এর আগেও যখন মিয়ানমারে সামরিক সরকার ছিল এবং সু চির নেতৃত্বে আন্দোলন হচ্ছিল, ওই সময়ও যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের অবস্থান সু চির পক্ষেই ছিল।

আমরা জাতিসংঘের নিরপত্তা পরিষদে চীন ও রাশিয়ার ভেটো প্রদানের প্রবণতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বুঝতে পারব, বিশ্বব্যবস্থা এক ধরনের রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এই ভেটো দেওয়ার প্রবণতার দিকে তাকালে এটা খুব স্পষ্ট রাশিয়া ও চীন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় এক ধরনের মেরুকরণ তৈরির চেষ্টা করছে। একটি হিসেবে দেখা যায়, ১৯৪৬ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তা পরিষদে প্রায় ২০৪টি ভেটো প্রয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৪৬ থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত চীন শুধু একবার ভেটো দিয়েছে, সেটি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ প্রশ্নে। তবে ১৯৯১ পরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নতুন বিশ্বব্যবস্থায় চীন ও রাশিয়ার ভেটো দেওয়ার প্রবণতা সর্বোচ্চ এবং এক্ষেত্রে তারাই কম-বেশি শীর্ষে। এই সময় চীন ১১ বার আর রাশিয়া ২২ বারের অধিক ভেটো দিয়েছে। অর্থাৎ, পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলোর নেতৃত্বে যে নতুন বিশ্বব্যবস্থার বিকাশ ঘটছিল, তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে চীন-রাশিয়া। এমনকি ২০০৭ সালেও সু চির দল এনএলডি’র নেতাদের গ্রেফতারের কারণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে একটি খসড়া প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেন। এর বিপক্ষেও রাশিয়া ও চীন যৌথভাবে ভেটো দিয়েছিল।

এর পেছনের কারণটা হলো, মিয়ানমারের সঙ্গে এই দুই দেশের সম্পর্ক। ২০০৫ সালের পর থেকে রাশিয়া-মিয়ানমারের সম্পর্ক বড় ধরনের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। ২০০৫ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত তাদের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য বেড়েছে প্রায় পাঁচ গুণ। ২০১৮ সালে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সরঞ্জাম বিক্রির চুক্তি হয়। মিয়ানমারে যৌথ পরমাণু গবেষণা কেন্দ্র, গ্যাস ও তেল ক্ষেত্রে রাশিয়ার বিনিয়োগ রয়েছে। তাই অর্থনৈতিক ও সামরিক সবকিছু মিলিয়েই রাশিয়ার জন্য নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে মিয়ানমার।

আর চীন-মিয়ানমার সম্পর্কও তো ঐতিহাসিক। দেশ দুইটি নিজেদের সম্পর্ককে ‘পোকপো’ বলে আখ্যা দিয়ে থাকে। বার্মিজ ভাষার এই শব্দটির অর্থ একই পিতা-মাতার সন্তান। চীন ও মিয়ানমারের নেতারা যখন নিজেদের মধ্যে কোনো বিবৃতি দেয়, তখন তারা বলে তারা সিবলিং বা ফ্যাটারনাল ব্রাদার্স (Fraternal Brothers)। তারা নিজেদের এতটাই ঘনিষ্ঠ মনে করে। তাদের সম্পর্ককে যদি অর্থনৈতিক দিক থেকে দেখি মিয়ানমারে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ চীনের। মিয়ানমারের ১০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক ঋণের চার বিলিয়ন ডলারই চীনের। এজন্য প্রতিবছর মিয়ানমারকে ৫শ মিলিয়ন ডলার সুদ দিতে হয়। মিয়ানমারের কাঠ, এজেট (মূল্যবান আকিক পাথর) ও তেল-গ্যাস খাতে বিনিয়োগ আছে চীনের। এছাড়াও বন্দর, অর্থনৈতিক অঞ্চল ও সীমান্ত অর্থনৈতিক অঞ্চলে অংশীদারিত্ব মিলিয়ে মিয়ানমার অনেক বেশি চীনের ওপর নির্ভরশীল। বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ তো রয়েছেই।

ভারতের ক্ষেত্রেও বিষয়টি অনেকটা এমন। গণতন্ত্রায়নের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে বিনিয়োগ ও বৈদেশিক বাণিজের যে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, সেখানে তারা ভারতকেও আনার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে অবকাঠামো নির্মাণ খাত, যেমনসিটো পোর্ট, কালাদান মাল্টিমোড ট্রান্সপোর্ট ট্রানজিট ও আসাম-শিলিগুড়ি করিডোরে ভারতের বিনিয়োগ রয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এই তিন দেশের কাছেই মিয়ানামারের সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বার্থ খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই মিয়ানমারের স্থিতিশীলতা তাদের জন্য খুব জরুরি। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারলে তাতেও তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা হয়।

অন্যদিকে রাশিয়া, চীন ও ভারতের মতো পশ্চিমা দেশগুলো মিয়ানমারে এই অর্থনৈতিক সম্ভাবনায় ওভাবে ভাগ বসাতে পারেনি। ফলে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের নেতৃত্বে পশ্চিমা দেশগুলো একদিকে; বিপরীতে চীন, রাশিয়া ও ভারত। মিয়ানমারকে ঘিরে দুই পক্ষের অর্থনৈতিক স্বার্থে বড় ধরনের ফারাক এবং বিপরীতমুখিতা আছে। ফলে পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো মিয়ানমারের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যেভাবে কঠোর অবস্থান নিতে পারছে, চীন বা রাশিয়া বা ভারত নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে সেটি পারছে না বা পারবে না।

সারাবাংলা: অনেকেই বলছেন, এই সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে চীনের হাত রয়েছে। এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা থাকতে পারে বলে মনে করেন?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: এই ধারণা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। কারণ চীনের শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের ঐতিহ্যগত সম্পর্ক রয়েছে, যা আগেই বলেছি। সামরিক শাসন জারির পর পশ্চিমা দেশগুলোর তুলনায় চীন প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে অনেক নরম সুরে। ফলে মানুষের মধ্যে এমন ধারণা তৈরি হতেই পারে। এছাড়াও নিরাপত্তা পরিষদে এই সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্দে নেওয়া নিন্দা প্রস্তাবে চীন ভেটো দিয়েছে। অভ্যুত্থানের ঠিক আগে আগে, জানুয়ারি মাসে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছিলেন। তাতে করে অভ্যুত্থানের পেছনে চীনের ভূমিকা থাকার ধারণা একেবারে অমূলক নয়।

তবে এখানে আরেকটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া খুবই জরুরি। মিয়ানমারের কোচিন ও শান প্রদেশের বিদ্রোহী গ্রুপ আছে। আর অভিযোগ আছে, চীন এই গ্রুপগুলোকে বিভিন্ন উপায়ে সাহায্য করছে। এমনকি চীনের ব্যবসায়ীরাও এই বিদ্রোহী গ্রুপগুলোকে সহায়তা করছে বলে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে অনেক সময় দাবি করা হয়। এর একটা বড় প্রমাণ হচ্ছে— ২০১৫ সালে আটটি বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে অস্ত্র বিরতি চুক্তি হলেও কোচিন ও শান প্রদেশের চীনের সীমান্তবর্তী বড় বড় বিদ্রোহী গ্রুপগুলো সেই অস্ত্র বিরতি চুক্তি করেনি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত এই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। তখনও চীনের শাসক গোষ্ঠীর সঙ্গে মিয়ানমারের সুসম্পর্ক বজায় ছিল। এ ঘটনার পর থেকে চীনের বলয় থেকে বের হয়ে আসার জন্য মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর একটা প্রচেষ্টা ছিল।

 

ওই সময় ‘মেইটস্টোন’ নামের একটা বড় বাঁধ নির্মাণে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ করা কথা ছিল চীনের। সেটিসহ চীনের বিনিয়োগ করা তিনটি বড় বড় প্রকল্প ওই সময় বন্ধ করে দেয় মিয়ানমার। একইসঙ্গে দেশটির সামরিক সরকার পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক তৈরির উদ্যোগ নেয়। মিয়ানমারের তৎকালীন সামরিক কর্মকর্তা থি সেন, তিনি প্রেসিডেন্ট হলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলার কাজে হাত দেন। চীনের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতেই ওই সময় বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতকেও কাছে টানে মিয়ানমার।

এমন পরিস্থিতিতে চীন কিন্তু অনেক বেশি এনএলডির নেত্রী সু চি’র ওপর নির্ভর করতে শুরু করেছিল। গত জানুয়ারিতেও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতেও মিয়ানমার সফর করে সু চি’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ সময় চীন-মিয়ানমার ইকোনমিক করিডোরের কাজের অগ্রগতি, বর্ডার ইকোনমিক জোন, কাইকফু গভীর সমুদ্রবন্দর, রেল লাইন নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়াও চীনের একজন শীর্ষ সারির নেতাও সু চি’র সঙ্গে দেখা করেন। আবার ২০১৫ সালের নির্বাচনের আগে সু চি যখন কোনো রাষ্ট্রীয় পদে ছিল না, তখনও সু চি চীনের আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে দেশটিতে গিয়েছিলেন। সেই অর্থে সু চি’কে কেন্দ্র করে চীনের আস্থার জায়গা তৈরি হচ্ছিল। ফলে খুব সহজভাবে বলা যাবে না যে, এই সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে চীনের হাত আছে।

তবে বর্তমান পরিস্থিতি চীনের জন্য নতুন সুযোগ। বিদ্রোহী গ্রুপগুলো নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, তা দূর করার সুযোগ রয়েছে চীনের সামনে। চীন যে নরম ভাষায় সামরিক অভ্যুত্থানের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে এবং জাতিসংঘে চীনের যে ভূমিকা, এগুলো তারই অংশ বলে আমার কাছে মনে হয়েছে। এর মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের সঙ্গে আগের সম্পর্কটা ফিরিয়ে আনার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যেটা চীন সু চি কেন্দ্র করে এগিয়ে নিতে চাইছিল।

সারাবাংলা: এই সামরিক অভ্যুত্থানে ফলে আগামী দিনে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: নতুন করে প্রভাব পড়ার কিছু নেই। কারণ, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে পরিবর্তন, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রাধান্য কিন্তু ক্ষয়িষ্ণু। এ কারণে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় চীন এখন তার অর্থনৈতিক সামর্থ্যের জন্য খুবই শক্তিশালী। আর দক্ষিণ এশিয়ায় চীন ও ভারতের মধ্যে একটা ঠান্ডা লড়াই তো আছেই। এখন মিয়ানমারের এই পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে দেশটির সামরিক শাসনের প্রতি চীন ও ভারতের প্রতিক্রিয়াটা দীর্ঘ মেয়াদে কী হয়, সেটাই দেখার বিষয়।

অর্থনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় নিলে চীন আরও বেশি মিয়ানমারের আস্থা অর্জন করতে চাইবে। আর মিয়ানমারে গণতন্ত্র থাকা বা না থাকার চেয়েও ভারতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক, তারা যেন ভারত বিমুখ না হয়। যেহেতু মিয়ানমারকে ঘিরে দেশ দুটির মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা আছে, এটি এখন আরও শক্তিশালী ও একমুখী হবে। ফলে সামরিক শাসকদের বিরোধিতা করা বা প্রকাশ্যে অবস্থান নেওয়াটা ভারত ও চীনের জন্য সহজ হবে না। এর মধ্য দিয়ে সামরিক শাসনের মৌন বৈধতাও নিশ্চিত হবে। এক্ষেত্রে মিয়ানমারের সামরিক শাসকরা চীন ও ভারতকে কিভাবে কাজে লাগাবে, তার ওপর নির্ভর করছে এটা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না।

ড. তানজীমউদ্দিন খান, অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

তবে মিয়ানমার কিন্তু রাজনৈতিকভাবে দক্ষিণ এশিয়ার মুখাপেক্ষী না। তারা অনেক বেশি আসিয়ান বা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়া দেশ। ফলে এখানে (দক্ষিণ এশিয়া) বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এটা বলা যাচ্ছে না। আবার ঐতিহ্যগতভাবেই মিয়ানমারের সামরিক শাসক গোষ্ঠী নিজেদের গুটিয়ে রাখত, যাকে আমরা গুঁটিয়ে থাকা  (Isolationist) রাষ্ট্র বলতাম। এটা মিয়ানমারের সামরিক সরকারের খুব স্বাভাবিক প্রবণতা এবং এটা তাদের কূটনৈতিক তৎপরতার মধ্যেও ছিল। বর্তমানে এই প্রবণতা আবারও ফিরে আসবে কি না নাকি ভিন্ন কিছু হবে তার ওপর নির্ভর করবে আসলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে নতুন কোনো প্রবণতা তৈরি হবে কিনা সেটা।

সারাবাংলা: অনেকেই দাবি করছেন, সামরিক অভ্যুত্থানের ফলে রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান পিছিয়ে গেল। আবার আরেক পক্ষ মনে করছে, রোহিঙ্গা সংকটের ওপর এর কোনো প্রভাব পড়বে না। বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: কোনো প্রভাব পড়বে না এমনটা মনে হয় না। নতুন শাসক গোষ্ঠী যখন ক্ষমতায় আসে, তাদের মনোজগৎ বোঝাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। সবার মনোজগৎ তো এক রকম নয়। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় নির্বাচন একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল। ভোটার গুরুত্ব পায় এতে। কিন্তু এখন সামরিক শাসনে সেগুলো এখন আর গুরুত্ব পাচ্ছে না। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়টি এখন আরও বেশি জটিল হবে। এখানে দুইটি বিষয় বিবেচনায় নিতে হবে।

প্রথমত, রোহিঙ্গা সম্প্রদায় মিয়ানমারের নাগরিক হলেও ১৯৮২ সালের আইনের মাধ্যমে সামরিক শাসকরাই তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিল। তাদের রাষ্ট্রহীন করা হলো, নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত করা হলো। তারা শরণার্থী হয়ে  বাংলাদেশে এলো। এটা তো সামরিক বাহিনী ঘটিয়েছে। ফলে যারা এই অপরাধটা করেছে, তারা এই সমস্যা খুব সহজে সমাধান করবে বিষয়টি এতো সহজ নয়। আর এখন সরাসরি সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর জনপ্রিয়তামুখী রাজনীতি বেশি গুরুত্ব পাবে। এক্ষেত্রে বৈধতার সংকট উতরানোর জন্য বৌদ্ধ ধর্মভিত্তিক পরিচয়ের অতিজাতীয়তাবাদী  মতাদর্শের উপর তাদের নির্ভশীলতা আরও বাড়বে। ফলে মিয়ানমারের সামরিক শাসক গোষ্ঠী খুব সহজে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান করে ফেলবে এরকম ভাবার কোনো কারণ নেই।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে সামরিক বাহিনী নিয়ে আস্থার সংকট রয়েছে। তারা কিন্তু সামরিক বাহিনীর হাতেই আক্রান্ত হয়েছিল। একটি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থী বলছিলেন আমাকে আরাকান (রাখাইন) নিয়ে যাওয়া হলে আমি আরও বেশি জুলুমের শিকার হব। অর্থাৎ তাদের অনাস্থা কিন্তু আরও প্রবল হয়েছে। ফলে এটি খুব স্পষ্ট যে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানটা আরও জটিল ও সুদূরপরাহত হলো।

তবে এই সমস্যা সমাধানে চীনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এ সংকট সমাধানের করতে চীনকে প্রভাবিত করা খুব জরুরি। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক এখন যেখানে পৌঁছেছে, বিশেষ করে ‘ওয়ান বেল্ট ওয়ান রুট’, বিনিয়োগ ও বাণিজ্য মিলিয়ে বাংলাদেশে চীনের উপস্থিতি (স্টেক) কিন্তু অনেক শক্তিশালী। এটাই কিন্তু বাংলাদেশের দরকষাকষির উপকরণ হতে পারে। চীনকে প্রভাবিত করার মাধ্যমে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের কতটুকু প্রভাবিত করতে পারব শেষ পর্যন্ত, সেটার ওপর নির্ভর করছে আমরা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান করতে পারব কি না। তাই এই মুহূর্তে রোহিঙ্গা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য একমাত্র চীনকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।

সারাবাংলা: সামরিক অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশও উদ্বেগ জানিয়েছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আশাবাদও জানিয়েছে। মিয়ানমারে সামরিক শাসক ক্ষমতায় থাকার এ পরিস্থিতিতে সরকারের আর কী কী করার আছে বলে মনে করেন আপনি?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: মিয়ানমারে যে ক্ষমতার পরিবর্তন হলো, সেখানে উদ্বেগের পাশাপাশি আশাবাদ প্রকাশ করাটাও খুব জরুরি। কেননা এতে কূটনৈতিক তৎপরতার জন্য কিছু জায়গা তৈরি হয়। শুধু উদ্বেগ প্রকাশ করে বসে থাকলে, নতুন সম্ভাবনার পথ বন্ধ হয়ে যাবে। আর নতুন সামরিক সরকারকে জয় করাটাও অনেক কঠিন হবে। তাই আশাবাদ ব্যক্ত করাটা কূটনৈতিক শিষ্টাচারের খুব স্বাভাবিক অংশ। সেটি বাংলাদেশ যথাযথভাবেই করেছে। তবে আরও অনেক কিছু করার আছে।

সামরিক শাসকদের ওপর সবসময় বৈধতার সংকটের এক ধরনের চাপ থাকে। মিয়ানমারের জনগণের জোরদার আন্দোলনের ফলে তাদের ওপর চাপটা অনেক বেশি। একদিকে আন্দোলনের কারণে রাজনৈতিক চাপ, আরেকদিকে সামরিক শাসক হওয়ার কারণে বৈধতার সংকট। এমন পরিস্থিতিতে সমস্যা এড়াতে শাসক গোষ্ঠী সাধারণত মনোযোগ অন্যদিকে নিয়ে যেতে চায়। এজন্য অনেক ক্ষেত্রে সীমান্ত সংঘাত কিংবা সীমান্ত উত্তেজনাকে উসকে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশকে অনেক বেশি সতর্ক থাকতে হবে।

এর সঙ্গে মিয়ানমার-চীন সম্পর্কটা কোন দিকে যাচ্ছে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কেননা চীন কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক আগেই বলেছি। একইভাবে ভারতকে যেহেতু আমরা বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে দাবি করে থাকি, সেই ভারতের ভূমিকাটাও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো নয়। এ ক্ষেত্রে চীন-ভারত, চীন-মিয়ানমার ও ভারত-মিয়ানমার সবগুলো সম্পর্ককেই পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। আর সবচেয়ে বেশি নজর দিতে হবে আমাদের সীমান্ত কিভাবে স্থিতিশীল রাখা যায়, সেদিকে।

সারাবাংলা: বর্তমান পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও মিয়ানমার প্রসঙ্গে বাংলাদেশের সরকারের কোন কোন বিষয়ে সতর্ক থাকা উচিত বলে মনে করেন আপনি?

ড. তানজিম উদ্দিন খান: এক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রোহিঙ্গাদের প্রকৃত পরিচয় আসলে কী, সেটি রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করা। আমার রোহিঙ্গাদের ‘উদ্বাস্তু’ বলছি না, বলছি ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত’। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিবেচনা করে রোহিঙ্গাদের ‘উদ্বাস্তু’ নাকি ‘বাস্তুচ্যুত’ বলব— এই সিদ্ধান্তটা খুব জরুরি। আমরা যদি ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন (জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার গ্রহণ করা শরণার্থী বিষয়ক প্রটোকল, যা জেনেভা কনভেনশন নামে পরিচিত) দেখি, তাহলে রোহিঙ্গারা কিন্তু কোনোভাবেই বাস্তুচ্যুত নয়, তারা শরণার্থী। কিন্তু রাষ্ট্রীয়ভাবে শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি দিলে কিছু বাধ্যবাধকতা তৈরি হয়। সেক্ষত্রে আমরা জোর করে ফেরত পাঠাতে পারব না। এ কারণে হয়তো আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারি পর্যায়ে তাদের শরণার্থী বলছি না।

তবে রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করলে বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরও জোরালোভাবে উপস্থাপন করা যায়। এতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অনুমোদিত গ্লোবাল কমপ্যাক্ট অন রিফিউজি বা জিসিআরকে কাজে লাগাতে পারে বাংলাদেশ। চারটি বিষয় এর আওতাভুক্ত। এর মধ্যে একটিতে বলা আছে— শরণার্থী স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিকে সমর্থন দেওয়া । অর্থাৎ আমরা তাদের যখন শরণার্থী বলব, তখন জিসিআর এর আওতায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব চলে আসে। তাই রোহিঙ্গারা শরণার্থী হিসেবে স্বীকৃতি পেলে এই সম্পর্কটিও আনুষ্ঠানিক হবে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আনুষ্ঠানিকভাবে আরও বেশি আর্থিক দায়িত্বও নিতে হবে।

ফলে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আরও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করতে চাইলে— তারা উদ্বাস্তু না বাস্তুচ্যুত— এই প্রশ্নের সমাধান সরকারি পর্যায়ে হওয়াটাও খুব জরুরি। সেক্ষেত্রে জিসিআর নতুন পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারকে সাহায্য করবে বলে আমি মনে করি।

সারাবাংলা: এরই মধ্যে মিয়ানমারের জনগণ সামরিক অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছে। বেশ কয়েকজনের প্রাণ হারানোর ঘটনাও ঘটেছে। এর পরিণতি কি হতে পারে?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: মিয়ানমারকে নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করাটা খুব সহজ কিছু না। কারণ তাদের যদি রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য দেখি, বিশেষ করে মিয়ানমারের শাসক গোষ্ঠী ঐতিহ্যগতভাবেই খুব বিভ্রান্তিকর (Deceptive)। তাই খুব সহজেই বলা যাবে না মিয়ানমারে কী পরিণতি হতে পারে। তবে এটা খুব স্পষ্ট যে মিয়ানমারে সামরিকায়িত গণতন্ত্রের মধ্যেও সু চি’র নেতৃত্বাধীন এনএলডি রাজনৈতিক দল হিসেবে বেশ সুসংগঠিত হয়েছে। তারা তৃণমূল পর্যায়ে খুব সংগঠিত। আর এই কারণেই আমরা জোরালো প্রতিবাদ ও আন্দোলন দেখছি। আর আমি মনে করি, এর মাধ্যমে সু চি দ্বিতীয় রাজনৈতিক জীবন পেয়েছেন।

অন্য কথায়, রোহিঙ্গা সংকটকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সু চি’র ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছিল। রাজনৈতিক নেতা হিসেবেও এক ধরনের বৈধতার সংকট তৈরি হয়েছিল। এক্ষেত্রে সু চি আবার নিজেকে ফিরে পেলেন। যেহেতু পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে সমর্থন করে, এক্ষেত্রে সামরিক শাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সু চি’র জন্য ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সুযোগ তৈরি হলো। তবে এক্ষেত্রেও চীনের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। চীনের অবস্থানটা যদি পরিষ্কার না হয়, তাহলে কিছুই বলা যাবে না।

সারাবাংলা: মিয়ানমারের সামরিক শাসক গোষ্ঠী নিজেদের বের হওয়ার রাস্তা হিসেবে এই আন্দোলনকে ব্যবহার করবে কি?

ড. তানজীমউদ্দিন খান: মিয়ানমারে আগেও কিন্তু এর থেকে কম কঠোর আন্দোলন হয়নি। তারপরও তাদের ১৯৬২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে। সেই সময়েও অনেক মানুষের প্রাণ গেছে, অনেক রক্তপাত হয়েছে। এরপরও সামরিক শাসক দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থেকেছে। তাই এটা স্পষ্ট করে বলা যাবে না যে এর মধ্য দিয়ে তারা বের হওয়ার পথ খুঁজবে। রোহিঙ্গা সংকটকে ঘিরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে আন্তর্জাতিক আদালতে সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে মামলা চলছে। এতে করে কি তাদের টনক নড়েছে? নড়েনি। একইভাবে জনসমর্থন না থাকার বিষয়টি তোয়াক্কাই না করেই তো তারা ক্ষমতা দখল করল। মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের বুঝতে এ ঘটনাই যথেষ্ট। ফলে এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তারা নিরাপদে বের হওয়ার পথ খুঁজবে বলে আমার মনে হয় না। বরং প্রতিদিন আন্দোলন জোরদার হওয়ার সাথে সাথে সামরিক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, জুলুমও আরও তীব্র রুপ নিবে মিয়ানমারে।

সারাবাংলা: মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ড. তানজীমউদ্দিন খান: আপনাকেও ধন্যবাদ।

সারাবাংলা/এনএস/টিআর

অং সান সু চি আঞ্চলিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক চীন-ভারত সম্পর্ক চীন-রাশিয়া-ভারত ড. তানজিম উদ্দিন খান মিয়ানমার রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন রোহিঙ্গা সংকট রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান সামরিক শাসন সেনা অভ্যুত্থান

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর