সুয়েজ খাল বিশ্ব বাণিজ্যের ধমনী
২৫ মার্চ ২০২১ ০৩:২৬
সুয়েজ খালে আটকা পড়েছে এভার গিভেন নামক পণ্যবাহী বিশাল জাহাজ। ৪০০ মিটার লম্বা ও ৫৯ মিটার প্রশস্ত, দুই লাখ ২০ হাজার টন ধারণক্ষমতা সম্পন্ন জাহাজটি সুয়েজ খালে চলার সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আড়াআড়িভাবে আটকে গেছে। মঙ্গলবার (২৩ মার্চ) স্থানীয় সময় সকাল ৭টা ৪০ মিনিটের দিকে সুয়েজ বন্দরের উত্তরে এই ঘটনা ঘটে। জাহাজটি আড়াআড়ি আটকে যাওয়ায় খালে সৃষ্টি হয়েছে পণ্যবাহী জাহাজের জট। বিশ্ব গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে— ১৯৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সুয়েজ খালে সৃষ্ট জটে বিশ্ববাজারে দাম বেড়ে যেতে পারে জ্বালানি তেলের। সুয়েজ খালকে বিশ্ব বাণিজ্যের ধমনী বলা হয়ে থাকে। কখনও কখনও মোট বিশ্ববাণিজ্যের ১২ শতাংশ পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ হয়ে থাকে এই খাল দিয়ে। বর্তমান সময়ে সুয়েজ খাল দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ৫০টির বেশি পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে তেল ও তরল গ্যাসবাহী জাহাজের প্রধান রুট হলো এই সংকীর্ণ জলপথ।
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস
প্রাচীনকাল থেকেই ভূমধ্যসাগর ও লোহিত সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করতে একটি খালের প্রয়োজনীয়তা বুঝতেন মিশরের শাসকরা। ২০০০ খ্রিস্টপূর্ব সময়কালে নীলনদের সঙ্গে লোহিত সাগরের সংযোগ স্থাপনে বেশ কিছু ছোট ছোট খাল খনন করা হয়েছিল। তবে সে সময় দুই সমুদ্র সরাসরি সংযুক্ত হয়নি। এসব প্রচেষ্টার ফলাফল হিসেবেই পরে আধুনিক সময়ে লোহিত সাগরের সঙ্গে ভূমধ্যসাগরের সংযোগ ঘটে খালের মাধ্যমে।
ধারণা করা হয় ফারাও সেনুস্রেত তৃতীয়-এর আমলে (১৮৮৭-১৮৪৯ খ্রিস্টপূর্ব) নীল নদের সঙ্গে লোহিত সাগরের সংযোগ স্থাপনে খাল খনন করা হয়। খালটি পলি জমে প্রায়ই পরিত্যক্ত হয়ে পড়ত। পরে এই খালের সংস্কার কাজ করেন ফারাও নেকো দ্বিতীয়। তিনি খালটিকে দুই সাগরে যুক্ত করতে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। তবে নানা কারণে তার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। পরে এই খালের সংস্কার কাজ ও বর্ধিতকরণের উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ নেন টলেমীয় ফারাওরা এবং পারস্যের সম্রাট দারিউস দ্য গ্রেট। বিশেষ করে মিশরে টলেমি শাসনামলে এই খাল সমৃদ্ধ হয় এবং আকর্ষণীয় পর্যটন হিসেবে রূপ নেয়। তবে ফারাওদের আমলে খালটির খননকার্য শুরু হলেও দুই সমুদ্রের মিলন হয়নি। লোহিত সাগর ও ভূমধ্যসাগরের উচ্চতার ভিন্নতার কারণে দারিউসের মতো সম্রাটও খাল খনন শেষ করতে পারেননি। পরে দীর্ঘকাল এই খাল খননের বড় উদ্যোগ আর কেউ নেননি।
উসমানীয় শাসনামলে তুর্কি প্রধানমন্ত্রী মুহাম্মদ পাশা এই খাল খননের পরিকল্পনা করেছিলেন। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় ও ব্যয় দেখে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখাননি উসমানীয় সুলতান। পরে ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ন বনাপার্ট ১৭৯৮ সালে মিশর দখলের পর দুই সাগরের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করতে ওই অঞ্চলে প্রকৌশলীদের একটি দল পাঠান। তবে তার প্রকৌশলীরা কিছু ভুল হিসেবনিকেশ করে নেপোলিয়নকে জানান, ভূমধ্যসাগর থেকে লোহিত সাগর কমপক্ষে ৩০ ফুট উচ্চতায়। দুই সাগর সংযুক্ত করতে যদি কোনো খাল খনন করা হয় তাহলে পুরো অঞ্চলজুড়ে ভয়াবহ বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। এমন পরামর্শে খাল খননের প্রকল্প স্থগিত করেন নেপোলিয়ন। ১৮৪৭ সাল পর্যন্ত খাল খননের প্রকল্প স্থগিত থাকে। ওই বছর ফরাসি প্রকৌশলী লিনান্ত দি বেলফোন্দের আগ্রহে গবেষকদের একটি দল ওই অঞ্চলে যায় এবং তারা গবেষণা করে দেখেন—দুই সাগরের মধ্যে উচ্চতা এত বেশি নয় এবং খাল খনন করে দুই সাগর যুক্ত করলে বন্যার কোনো ঝুঁকি নেই। ১৮৫৪ সালে ফের সুয়েজ খাল খনন শুরু হয়। সে সময় ফার্ডিনান্ড ডি লেসপেস নামের এক ফরাসি কূটনীতিক মিশরের শাসক সাইদ পাশার কাছ থেকে খাল খননের অনুমতি নেন এবং তিনি সুয়েজ খাল কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে খাল খনন শুরু করেন।
আধুনিক সুয়েজ খাল খননের পর খুলে দেওয়া হয় ১৮৬৯ সালে। ১৮৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর এ খালের উদ্বোধন হয়। ইউরোপ ও এশিয়ার মধ্যে বাণিজ্যের এক নতুন সম্ভাবনার দোয়ার খুলে যায় এতে। আফ্রিকা ও এশিয়ায় বিস্তীর্ণ সাম্রাজ্য নিয়ন্ত্রণে এই খালের গুরুত্ব ইউরোপীয়দের কাছে ছিল খুব বেশি। তবুও খাল খননের আগে যে সংখ্যক জাহাজ চলাচল করবে বলে ধারণা করা হয়েছিল, প্রথম দুই বছর সেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এর মধ্যে খালের মালিক মিশরের শাসক ইসমাইল পাশা, ফ্রান্স ও অন্যান্যরা আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। ফলে ১৮৭৫ সালে খালের শেয়ার যুক্তরাজ্যের কাছে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় তারা। তারপরও খালের বেশিরভাগ মালিকানা থেকে যায় ফ্রান্সেরই হাতে।
১৮৮২ সালে অ্যাংলো-মিশরীয় যুদ্ধ শুরু হয় এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অধিভুক্ত হয় মিশর। বিশাল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বাণিজ্য ও সামরিক স্বার্থে এই খালের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম । ফলে ১৯২২ সালে মিশর স্বাধীন হয়ে গেলেও সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ ছাড়েনি ব্রিটেন। ১৯৩৬ সালে ব্রিটেন ও মিশর অ্যাংলো-মিশরীয় চুক্তি নামে এক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিতে সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণে ব্রিটিশ সৈন্যরা ওই অঞ্চলে থাকতে পারে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্রিটেনের সৈন্যরা সুয়েজ খাল নিয়ন্ত্রণ করে। তবে আধুনিক স্বাধীন মিশরের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের ১৯৫৪ সালে ক্ষমতায় এসেই সুয়েজ খালের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার উদ্যোগ নেন। ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে সুয়েজ খাল জাতীয়করণ করেন গামাল আব্দুল নাসের। সেসময় যুক্তরাজ্য ও মিশরের সম্পর্ক অবনতি হয় এবং গোটা মধ্যপ্রাচ্যে এর প্রভাব পড়ে।
শীতল যুদ্ধের সময়ের ওই ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন পায় মিশর। সোভিয়েত অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তির সমর্থনে সুয়েজ খাল অঞ্চল থেকে ব্রিটিশ সেনাদের জোরপূর্বক সরিয়ে দেন গামাল আব্দুল নাসের। এতে ব্রিটিশ ও ফ্রান্স মিশরের উপর চটে যায়। ১৯৫৬ সালেই যুক্তরাজ্য-ফ্রান্স-ইসরাইলের সামরিক জোট মিশর আক্রমণ করে এবং সুয়েজ খালের দখল নেয়। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ঘটনায় কড়া প্রতিক্রিয়া দেখায় এবং মিশর থেকে সেনা প্রত্যাহার না করলে ইউরোপে হামলার হুমকি দেয়। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রও মিশর থেকে সেনা প্রত্যাহার না করলে তিন দেশের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার হুমকি দেয়। এমন পরিস্থিতিতে কানাডার তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী লেস্টার বি. পিয়ারসন গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথে সংঘাত এড়িয়ে সবার অধিকার নিশ্চিত করতে জাতিসংঘকে শান্তি রক্ষা বাহিনী তৈরি ও সেখানে মোতায়েনের প্রস্তাব করেন। ১৯৫৬ সালের ৪ নভেম্বর জাতিসংঘ পিয়ারসনের প্রস্তাব গ্রহণ করে ও শান্তি রক্ষা বাহিনী নামক ধারণা অনুমোদন করে। ওই ঘটনা থেকেই জাতিসংঘের শান্তি রক্ষা বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৫৭ সালে বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য খালটি ফের খুলে দেওয়া হয়। বর্তমানে সুয়েজ খালটি পরিচালনা করছে সুয়েজ ক্যানেল অথোরিটি।
বিশ্ব বাণিজ্যের ধমনী
মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত কৃত্রিম খাল এটি। বিভিন্ন পরিসংখ্যান মতে, বিশ্বের প্রায় ৯০ ভাগ বাণিজ্য সমুদ্রপথে হয়ে থাকে। এশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত জলপথ হলো ১২০ মাইল দৈর্ঘ্য এই সুয়েজ খাল। মিশরের সিনাই উপদ্বীপের পশ্চিমে অবস্থিত কৃত্রিম খাল এটি। সুয়েজ খাল না থাকলে ইউরোপ থেকে এশিয়ায় জলপথে পণ্য পরিবহণ করতে হলে সম্পূর্ণ আফ্রিকা মহাদেশ ঘুরে আসতে হতো।
ছবি: সংগৃহীত
২০১৯ সালে এই খাল দিয়ে ১৯ হাজার জাহাজে ১২০ কোটি টন পণ্য পরিবহণ করা হয় যা ওই বছর সমুদ্রপথে বিশ্ব বাণিজ্যের প্রায় আট ভাগের এক ভাগ। শুধু মধ্যপ্রাচ্যই নয়, দক্ষিণ এশিয়া ও চীনের বহু উৎপাদক প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্যবাহী জাহাজ এই খাল দিয়ে ইউরোপে পাঠায়। আর মধ্যপ্রাচ্যের তেলবাহী জাহাজ ইউরোপে পাঠাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই জলপথ। আন্তর্জাতিক চুক্তি অনুযায়ী— যুদ্ধ বা শান্তি— যে কোনো সময় যে কোনো দেশের জাহাজ সুয়েজ খাল ব্যবহার করতে পারবে।
তথ্যসূত্র: সুয়েজক্যানেলডটগভডটইজি; বিবিসি; হিস্টোরিডটকম