‘গণহত্যার বিভীষিকা পেছনে ফেলে বাঙালি জেগেছিল ফিনিক্স পাখির মতো’
২৫ মার্চ ২০২১ ২১:১৩
ঢাকা: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাঙালির জীবনে একটি দুঃস্বপ্নের কালো রাত। সে রাতে ধ্বংসযজ্ঞ আর হত্যালীলায় মেতেছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত-নিরস্ত্র-নিরীহ বাঙালির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তারা। তাদের উদ্দেশ্য ছিল— বাঙালির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া। গণহত্যার সেই বিভীষিকা পেছনে ফেলে বাঙালি জাতি যেভাবে জেগে উঠেছিল, দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে হানাদার বাহিনীকে পদানত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল— এ যেন ফিনিক্স পাখি। এমন অর্জন বিশ্বের ইতিহাসে বিরল।
সারাবাংলার এই প্রতিবেদকের কাছে একাত্তরের ২৫ মার্চের সেই কালরাত নিয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে এসব কথা বললেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তফা মোহসীন মন্টু। গণফোরামের একাংশের স্টিয়ারিং কমিটির এই প্রধান ষাটের দশকে ছিলেন ছাত্রনেতা। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকদের মধ্যে তিনি অন্যতম।
একাত্তরের মার্চের স্মৃতি স্মরণ করে মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, একাত্তরের শুরুর দিকে ছিলাম কারাগারে। মার্চ মাসের শুরুতেই কেন্দ্রীয় কারাগারে বিদ্রোহ করে জেল ভেঙে পালিয়েছিলাম। ওই সময় আমি ছিলাম পাকিস্তানি চার সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি। এই মামলায় মুক্তিযোদ্ধা খসরুসহ (‘ওরা ১১ জন’ চলচ্চিত্রের অন্যতম কেন্দ্রীয় চরিত্রের অভিনেতা) ১৫/১৬ জন আসামি ছিলাম। বঙ্গন্ধু আমাকে মৃত্যুদণ্ড থেকে বাঁচাতে পাকিস্তান সরকারের কাছে তদবির করেছিলেন। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।
তিনি বলেন, আমরা তখন জেলে বসেই বাইরের পরিস্থিতি আঁচ করতে পারছিলাম। আমরা বুঝতে পারছিলাম, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ শুরু হবে শিগগিরই। তখনই সিদ্ধান্ত নিই, যেভাবেই হোক জেল থেকে পালাতে হবে। তখন খুবই গোপনে জেলের অন্যান্য সেলে খবর পাঠালাম— জেলের মধ্যে বিদ্রোহ করে জেল ভেঙে পালাতে হবে।
মন্টু বলেন, ওই সময় জেলখানায় একটি সেলে সব কয়েদিদের দুপুরে খাবার খেতে দিত। তারিখ মনে নেই, একদিন দুপুরে দুপুর ১২টার সময় সবাই ওই সেলে খাবারের জন্য একত্রিত হয়। আমার সেলে কারারক্ষী ছিল জব্বার, সে পাকিস্তানি। কৌশল করে তাকে সিগারেট দিয়ে সেলের সামনে হাঁটাহাঁটি করছিলাম। এক ফাঁকে কয়েদিদের খাবারের সেলের দিকে যাওয়া শুরু করলে করারাক্ষী জব্বার চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, ‘ঠ্যাহরো, আন্ধার মে যাও (থামো, অন্ধকারে যাও)।‘ ততক্ষণে আমি খাবারের সেলের কাছে চলে গেছি। ওখানে যাওয়ার পরপরই জব্বার আমাকে দৌড়ে এসে দাঁড় করানোর চেষ্টা করে। আমি তখন ওর হাতে বড় বাঁশের লাঠি নিয়ে জব্বারের মাথায় আঘাত করি। জব্বার মাটিতে পড়ে যায়।
‘একপর্যায় সব কয়েদিরা মিলে জেলখানার প্রধান ফটক ভেঙে ফেলার চেষ্টা করি। কিন্তু সেই ফটক ভাঙা সম্ভব হয়নি। পরে ওপরের দিকের একটি জানালা ভেঙে সেখান থেকে সবাই মিলে বের হয়ে প্রধান ফটক খুলিয়ে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়ি। এসময় কারারক্ষী ও পুলিশের গুলিতে ৪০ থেকে ৫০ জন কয়েদি নিহত হন,’— বলেন মন্টু।
কারাগার থেকে বেরিয়ে প্রথমে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের (বর্তমান বুয়েট) আহসান উল্লাহ হলে আশ্রয় নেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু। সেখানে কিছু সময় অবস্থান করে চলে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমানে জহুরুল হক হল)। পরে সেখানেও খুব বেশি সময় অবস্থান করেননি। মূলত কেউ যেন সন্ধান না পায়, সে কারণে ওই সময় কোথাওই বেশি সময় অবস্থান করতেন না বলে জানালেন।
একাত্তরে মোস্তফা মোহসীন মন্টু ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র। জহুরুল হক হলে থাকতেন। ছাত্রজীবন থেকে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। পরে যুক্ত হন যুবলীগের রাজনীতিতে, সংগঠনটির চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। যুবলীগ থেকে আওয়ামী লীগে গিয়ে ঢাকা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৯২ সালে তিনি আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হন এবং ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরামে যোগ দেন। ২০০৯ সালে তিনি গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এর মধ্যে ১৯৮৬ সালে তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মন্টু আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঢাকা-৩ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী ছিলেন। ঢাকা-৩ আসনে নির্বাচন করে ৬৬ হাজার ২২০ ভোট পেয়ে বিএনপির প্রার্থী আমানউল্লাহ আমানের কাছে পরাজিত হন। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি ঢাকা-২ ও ঢাকা-৩ আসন থেকে গণফোরামের প্রার্থী হিসেবে ‘উদীয়মান সূর্য’ প্রতীকে এবং ঢাকা-৭ আসন থেকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমানবন্দরে মোস্তফা মোহসীন মন্টুই প্রথম উড়োজাহাজে উঠে বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানান। ওই সময় তার সঙ্গে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা চিত্রনায়ক খসরু। এছাড়া ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসা থেকে এসকর্ট করে রেসকোর্স ময়দানে মঞ্চে ওঠানো পর্যন্তও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গী ছিলেন মন্টু ও খসরু।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা জেলার মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডরের দায়িত্ব পালন করেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু। তিনি ছিলেন মুজিব বাহিনীর সদস্য। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে প্রথম সারির ছাত্রনেতা তিনি। কাওরান বাজার এলাকায় আইয়ুব খানের আগমন উপলক্ষে ‘খোশ আমদেদ আইয়ুব খান’ লিখে গেট সাজানো হলে তিনিই তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। এজন্য তার ওপর মৃত্যু হুলিয়া জারি করে পাকিস্তান সরকার।
মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এই সংগঠক জানান, একাত্তরের মার্চে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পরপরই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকেন তারা। সেই প্রস্তুতির কথা জানিয়ে তিনি বলেন, জেল থেকে বেরিয়ে আমরা কয়েকজন মিলে অস্ত্র গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে থাকি। পাশাপাশি জহুরুল হক হল, রোকেয়া হল, জগন্নাথ হলে গোপনে অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ দিতে শুরু করি। আমার পরিবারেই টুটু রাইফেল ছিল। আমি পরিবার থেকেই অস্ত্র চালানো শিখেছি। সে কারণে ওই সময় প্রশিক্ষণ আমি নিজেই দিতাম।
২৫ মার্চের কালরাতের সেই ভয়াল স্মৃতিও এখনো ভেসে ওঠে মোস্তফা মোহসীন মন্টুর মনে। সেদিনের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আমরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসায় যাই। ওখানে তখন তাজউদ্দিন আহমেদ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম, ড. কামাল হোসেন, আ স ম আবদুর রব, তোফালে আহমেদ, নায়ক খসরুসহ ছাত্রনেতারা উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে ওই সময়। সবকিছু স্মরণেও নেই। তবে আলোচনার একপর্যায় বঙ্গবন্ধুকে আমরা বললাম, আপনার এই মুহূর্তে এখানে থাকা ঠিক হবে না। আমাদের সঙ্গে চলুন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু জবাবে বললেন, ‘তোমারা নিরাপদে চলে যাও। আমি পালাব না। মরতে হয় মরব।’
মন্টু জানালেন, একাত্তরের ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (তৎকালীন রেসকোর্স ময়দান) বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ভাষণ থেকেই যুদ্ধে নামার নির্দেশনা পেয়েছিলেন তারা। ফলে তখন থেকেই তিনি ও তার সহযোগীরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হতে থাকেন। আর ২৫ মার্চের ভয়াল রাত পেরোতেই ২৬ মার্চ স্বজন হারানোর শোক বুকে নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়েছেন যুদ্ধে।
মোস্তফা মোহসীন মন্টু বলেন, বঙ্গবন্ধুর ওখান থেকে বের হয়ে আমরা যখন সায়েন্স ল্যাবরেটরির কাছে, তখনই পাকিস্তানি সেনারা আমাদের লক্ষ করে গুলি করতে থাকে। আমরা আঁকাবাঁকা পথ ধরে ইকবাল হলে (বর্তমান জহুরুল হক হল) গিয়ে উঠি। সময় নষ্ট না করে দ্রুততার সঙ্গে আগে থেকে জমানো অস্ত্র গোলাবারুদ গাড়িতে তুলে নেই। ওই সময় পাকিস্তানিরা ট্যাংক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে আসছে বলে খবর পাই। এই খবর পেয়েই হঠাৎ করে একটি মর্টার শেল এসে ইকবাল হলের কাছাকাছি পড়ে। তখন আমরা গাড়ি নিয়ে আবার আঁকাবাঁকা পধ ধরে কামরাঙ্গীর চরে পৌঁছাই। ওখান থেকে চলে যাই কেরাণীগঞ্জ।
‘চার থেকে পাঁচটি অস্ত্র (বন্দুক) নিয়ে ভোর ৪টায় কেরাণীগঞ্জে পৌঁছে সেখানকার থানা লুট করে আরও অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহ করি। এসময় থানার সামনে পাকস্তানি পতাকা উড়ছিল। ওই পতাকা নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলি এবং আমাদের জাতীয় পতাকা তুলে দেই। তখন কেরাণীগঞ্জ থানার ওসি তালুকদার থানার অন্যান্য পুলিশদের নিয়ে জাতীয় পতাকাকে স্যালুট জানায়। একইসঙ্গে তারা স্যালুট জানান আমাদেরও,’— সেদিনের সেই সম্মাননার কথা স্মরণ করে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন মোস্তফা মোহসীন মন্টু।
ওই সময় কেরাণীগঞ্জের অধিবাসীরাও ঘর থেকে বের হয়ে আসতে থাকেন। তাদের কারও হাতে ছিল খাবার, কারও হাতে ছিল পানি। ঢাকায় কালরাতের সেই বর্বরতার বেদনা বুকে নিয়ে শহর ছাড়ছে। তাদের অনেকেই পায়ে হেঁটে কেরাণীগঞ্জ দিয়ে যাচ্ছিলেন অজানা গন্তব্যে। সেখানে একটি ক্যাম্প করা হয়। খবর পেয়ে পাকিস্তানিরা পুরো কেরাণীগঞ্জ ঘিরে ফেলে। তখনই কেরাণীগঞ্জ ছাড়েন মোস্তফা মোহসীন মন্টু ও তার সঙ্গীরা। জানা যায়, ওই সময় কেরাণীগঞ্জেই সাড়ে ৪ হাজার মানুষকে হত্যা করেছে।
সারাবাংলা/এএইচএইচ/টিআর
২৫ মার্চ কালরাত একাত্তরের ২৫ মার্চ মোস্তফা মোহসীন মন্টু স্মৃতিচারণ