‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের ‘রোল মডেল’
২৬ মার্চ ২০২১ ০০:০৯
ঢাকা: দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছিল বাংলাদেশ। যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আজীবন সংগ্রামে মিলেছিল এই স্বাধীনতার স্বাদ, সেই জাতির পিতার নেতৃত্বেই শুরু হয় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে পুনর্গঠনের লড়াই। কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় জাতির পিতাকে হত্যার মাধ্যমে রুখে দেওয়া হয় বাংলাদেশের অগ্রগতি। মুখ থুবড়ে পড়ে বাংলাদেশ। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার রীতিমতো বাংলাদেশকে আখ্যা দেন ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসেবে। এরপর সামরিক শাসনের যাঁতাকলে বাধাগ্রস্ত হয় গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। এক সংগ্রামের মাধ্যমে শেষ সংসদীয় গণতন্ত্রের ধারায় ফিরে আসে বাংলাদেশ। আজ স্বাধীনতার পাঁচ দশকের পথপরিক্রমা শেষে জাতি যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করছে, সেই বাংলাদেশের আর পেছনে ফিরে তাকানোর কোনো প্রয়োজন নেই। একসময়ের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই উন্নয়নের রোল মডেল।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার তথ্য বলছে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মাহেন্দ্রক্ষণে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের ৪১তম অর্থনীতির দেশ। ২০৩২ সালে বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের তালিকাতেও ঢুকবে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে বাংলাদেশ স্থান করে নিয়েছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। সামাজিক বিভিন্ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশকেই ছাড়িয়ে গেছে। ১৯৭১ সালে যে দেশটির প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যপীড়িত ছিল, স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে সেই দেশটিতে দারিদ্র্যের হার নেমে এসেছে ২০ শতাংশের ঘরে। তারপরও এই সময়ে বাংলাদেশ যতটা উন্নত হওয়ার সম্ভাবনা ছিল, নানা ধরনের অনিয়ম, দুর্নীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে সেই সম্ভাবনার শতভাগ বাস্তবায়ন করা যায়নি বলেও অভিমত অর্থনীতিবিদদের।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী। বর্বরোচিত সেই হামলার পর ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে শুরু হয় সশস্ত্র যুদ্ধ। ৯ মাসের সেই যুদ্ধ শেষে পাকিস্তানি বাহিনীকে পদানত করে অর্জিত হয় লাল-সবুজের পতাকা, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের বিজয়।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান নামে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে স্থান হয় বাংলাদেশের। এরপর ১৯৭১ সাল পর্যন্ত যে ২৪টি বছর পরাধীনতার নাগপাশে আবদ্ধ ছিল, তার পুরোটা সময় অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের স্বীকার হতে হয়েছে। পাশাপাশি ক্ষুধা, অপুষ্টি, স্বাস্থ্যহীনতাসহ নানা কারণে এই ভূখণ্ডের মানুষের আয়ুষ্কালও ছিল অনেক কম। শিক্ষার হার ছিল নিম্নপর্যায়ে। পর্যাপ্ত কর্মসংস্থানও ছিল না। স্বাধীনতার পরও এই বৈষম্য ও বঞ্চনার প্রভাবে ভুগতে হয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু গত ৫০ বছরে নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করেও বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের বিস্ময়। এই সময়ে মাথাপিছু আয়, গড় আয়ু, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, কমেছে প্রসূতি ও শিশুমৃত্যুর হার। ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ নামে দেশের তৈরি পোশাক খাত সারাবিশ্বে পরিচিত।
তথ্য ঘেঁটে দেখা যায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে ৩০ জুন জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা বাংলাদেশের প্রথম বাজেটের আকার ছিল মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা। সেখানে সবশেষ গত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাজেটের আকার দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকায়। অর্থাৎ এই সময়ে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭২২ গুণ। এছাড়াও বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার যেখানে ১৯৭২ সালে ছিল ৫০১ কোটি টাকা, ২০২০ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে দুই লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকায়। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধিও ৮ দশমিক ১৫ শতাংশের ঘর ছাড়ানোর রেকর্ড রয়েছে বাংলাদেশের। শুধু তাই নয়, বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি বিশ্বের বড় বড় অনেক দেশের প্রবৃদ্ধিই ছিল নেতিবাচক, সেখানেও বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশের বেশি।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ছিল ১২৯ ডলার। বর্তমানে দেশের মানুষের মাথাপিছু গড় আয় ২ হাজার ৬৪ ডলার। এই সময়ে মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে প্রায় ১৬ গুণ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, গত ৫০ বছরে আশানুরূপ অর্জন এসেছে রফতানি বাণিজ্যেও। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের রফতানি আয় হয় মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। সেখানে সবশেষে ২০১৯-২০ অর্থবছরে রফতানি আয় হয়েছে ৪০ দশমিক ৬ বিলিয়ন বা চার হাজার ৬০ কোটি মার্কিন ডলার। অন্যদিকে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশেন মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) ছিল ৮ বিলিয়ন ৭৫ লাখ ডলার বা ৮০০ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষে এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ ৯৬ হাজার ৩৭৮ কোটি টাকায়। ১৯৭২ সালের বাজেটে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১২ টাকা। বর্তমানে এর পরিমাণ ২০ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, শূন্যের ঘরে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে।
১৯৭১ সালে দেশে প্রায় ৮৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত। সবশেষ করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির আগে ২০২০ সালের শুরুতে দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২১ দশমিক ৮ শতাংশ। ১৯৭১ সালে মানুষের গড় আয়ু ছিল ৪৭ বছরের একটু বেশি, যা বর্তমানে ৭২ দশমিক ৬ বছর।
বাংলাদেশের অগ্রগতির এই চিত্র নিয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশের অর্থনীতিসহ আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে। সামষ্টিক অর্থনীতির আকার বহুগুণে বেড়েছে। শিক্ষার হার, মাথাপিছু আয় ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে। দারিদ্র্য বিমোচনেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের হয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছি আমরা। স্বাধীনতা অর্জনের সময় আমাদের প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি মানুষের অবস্থান ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। করোনার আগ পর্যন্ত দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর সংখ্যা ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছিল।
বাংলাদেশের অগ্রগতির প্রশংসা করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতির যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে। স্বাধীনতার পর মাত্র ৭৮৬ কোটি টাকা দিয়ে আমাদের বাজেট শুরু করেছিলাম। বর্তমানে বাজেটের আকার সাড়ে পাঁচ লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আমাদের জিডিপি কয়েক হাজার গুণ বেড়েছে। এসব কিছু নিয়ে আমরা বলতেই পারি— আমাদের অর্থনীতির অগ্রগতি প্রশংসনীয়।
তিনি বলেন, আমাদের অর্থনীতি এই অগ্রযাত্রার প্রধান কারণ হলো ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে বসবাসকারী জনগণ একসঙ্গে থাকি, এক ভাষায় কথা বলি, চালচলন-চিন্তাভাবনা ও সামাজিক আচার আচরণ একই রকম। এটা বজায় রাখতে পারলে এবং কিছু রাজনৈতিক বিভাজন কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হলেও আমরা আরও এগিয়ে যাব।
দেশের অগ্রগতির প্রশংসা করলেও আরও অগ্রগতির সুযোগ ছিল বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমরা কতটা এগিয়েছি— এটি আপেক্ষিক ব্যাপার। কারণ আমাদের কাছাকাছি সময়ে যেসব দেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, তাদের অনেকেই আমাদের চেয়ে এগিয়ে গেছে। আবার বেশকিছু দেশ পিছিয়েও গেছে। তবে আমরা সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছি।
তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে আহসান এইচ মনসুর বলেন, ষাটের দশকে চীন, পাকিস্তান একই অবস্থানে ছিল। আমাদের মাথাপিছু আয় ছিল ৬০/৭০ ডলার। বর্তমানে চীনের মাথাপিছু আয় ১৩ হাজার ডলার, আমাদের দুই হাজার ডলার। ১৯৯০ সালে রফতানিতে বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম প্রায় একই অবস্থানে ছিল। বর্তমানে ভিয়েতনাম ২৭০ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে, সেখানে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ মাত্র ৪০ বিলিয়ন ডলার।
কিছু দেশের তুলনায় দেশের অগ্রগতির চিত্রকে কিছুটা মলিন বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজও। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যথেষ্ট উন্নতি লাভ করলেও বাংলাদেশের সমসাময়িক সময়ে যে দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে, সে দেশগুলোর অর্থনীতির অগ্রগতির তুলনায় আমাদের অর্জন কিছুটা মলিন। কারণ থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, মালয়শিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলো থেকে আমরা কিছুটা পিছিয়ে রয়েছে।
দেশের অগ্রগতি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় অর্জিত না হওয়ার পেছনে দুর্নীতিকে বড় একটি কারণ বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর ড. সালেহ। তিনি বলেন, দুর্নীতি আমাদের অর্থনীতির অগ্রযাত্রাকে কিছুটা বাধাগ্রস্ত করেছে। আমরা যদি দুর্নীতি কমিয়ে আনতে পারতাম, তাহলে আমাদের কর আদায় বেড়ে যেত। তাতে দেশের আর্থসামাজিক উন্নতি আরও ত্বরান্বিত হতো।
সারাবাংলা/জিএস/টিআর
অর্থনৈতিক উন্নয়ন আহসান এইচ মনসুর উন্নয়নের রোল মডেল ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম তলাবিহীন ঝুড়ি সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ স্বাধীনতা দিবস ২০২১ স্বাধীনতার ৫০ বছর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী