মুছে যাচ্ছে দারিদ্র্যের তিলক
২৬ মার্চ ২০২১ ০৮:৫৯
ঢাকা: স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশের অন্যতম অর্জন উন্নয়নশীল দেশের গৌরব। ইতোমধ্যেই এলডিসি বা স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার যোগ্যতা অর্জনের চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে জাতিসংঘ সদর দফতরের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসি (সিডিপি)। এর মধ্য দিয়ে হতদরিদ্র্যের তিলক মুছে নতুন উদ্যোগে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি লাভ করেছে দেশ— এমনটিই বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে যে চ্যালেঞ্জ আসবে তা মোকাবিলায় প্রস্তুতিও নেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এমনকি এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদনও তৈরি করেছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (জিইডি)।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) সচিব ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘বহির্বিশ্বে জাতি হিসেবে বাংলাদেশের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হওয়ায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে বিনিয়োগে আরও উৎসাহী হবেন। আমরা সম্পূর্ণ যোগ্যতা অর্জন করেই এই সুপারিশ লাভ করেছি। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এমন অর্জন সামনে এগিয়ে যাওয়া শক্তি জোগাবে।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘২০২৪ সালের পর প্রধান বাজারগুলোতে বড় ধরণের অগ্রাধিকার সুবিধা হারানোর কারণে বাংলাদেশের রফতানির ওপর চাপ পড়বে। ভবিষ্যৎ চিত্রের এক প্রাথমিক ফলাফলে দেখা যায়, ২০২৭ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ভারত ও চীনের বাজারে সুবিধা হারানোর ফলে বছরে ১১ শতাংশ হারে রফতানি কমতে পারে। যার পরিমাণ প্রায় ৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত হতে পারে।’
তিনি আরও বলেন, ‘২০২৪ সালের পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বেশকিছু ছাড় আর পাওয়া যাবে না। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এর আওতায় পড়বে না, যেখানে ইবিএ সুবিধায় ২০২৭ সাল পর্যন্ত তিন বছরের প্রস্তুতিকালীন সময় পাওয়া যাবে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতোমধ্যেই পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এমনকি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়,বিভাগ, সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।’
ইআরডি সূত্র জানায়, জাতিসংঘের হিসেবে বিশ্বে তিন ধরনের দেশ রয়েছে। এগুলো হচ্ছে-উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত বা এলডিসি। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভুঙ্গতা বা সংকট সূচক অনুযায়ী জাতিসংঘ সূচকটি করে থাকে। বর্তমানে বিশ্বে বাংলাদেশসহ ৪৭টি দেশ এলডিসির হিসেবে রয়েছে। এলডিসি থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। এই মূল্যায়ন করে সিডিপি। পুরো প্রক্রিয়াটি শেষ হতে অন্তত ছয় বছর লাগে। বাংলাদেশ ২০১৮ সালে প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছে। সব শর্ত পূরণ হওয়ায় গত ২৬ ফেব্রুয়ারি রাতে পর্যালোচনা সভা শেষে এলডিসি গ্রাজুয়েশনের চূড়ান্ত সুপারিশ করে সিডিপি। পরদিন ২৭ ফেব্রুয়ারি সেটির আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই চূড়ান্ত সুপারিশ পাওয়ায় নিয়মানুযায়ী ২০২৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে মিলবে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি।
শুধু চ্যালেঞ্জ নয়, আছে সম্ভাবনাও
এলডিসি উত্তরণের ফলে বেশকিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ আসবে। তবে সম্ভাবনাও সৃষ্টি হবে তার চেয়ে অনেক বেশি। এ প্রসঙ্গে জিইডির সদস্য ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ‘নতুন করে অনেক দেশের সঙ্গে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হবে। কিছু ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ তৈরি হলেও সুযোগও তৈরি হবে অনেক। ক্রেডিট রেটিং অনেক বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যেই আমরা মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছি। এছাড়া এফটিএ, পিটিএসহ বিভিন্ন চুক্তির প্রস্তুতি চলছে। ফলে বাণিজ্য বাড়বে। পণ্য বৈচিত্রায়নসহ রফতানি বাড়াতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ফলে এলডিসি উত্তরণ হলেও কোনো সমস্যা হবে না। আমরা সেই সামর্থ্য ও যোগ্যতা অর্জন করেই এলডিসি উত্তরণ করছি। তাই এ নিয়ে দশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই।’
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি
এলডিসি উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বেশকিছু সুপারিশ তৈরি করেছে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ। এগুলো হলো- সম্প্রতি অনুমোদিত প্রেক্ষিত পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজস্বনীতি বাস্তবায়নের সুপারিশ দেওয়া। এটি করা গেলে জিডিপির ১০ শতাংশ কর বাড়বে। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে তা বেড়ে দাঁড়াবে জিডিপির ১৫ শতাংশ। এছাড়া রাজস্ব ঘাটতি থাকবে ৫ শতাংশের নিচে। পাশাপাশি প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতির দিকে লক্ষ্য রেখে অর্থ সরবরাহ বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে যাতে মূল্যস্ফীতি ৫ শতাংশের নিচেই থাকে। প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এজন্য একটি কর্মসংস্থান নীতিমালা বাস্তবায়ন করতে হবে। ২০২২ সালের মধ্যে এটি তৈরি করে ২০২৩ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের জন্য একটি অ্যাকশন প্ল্যান করতে হবে। বৈদেশিক ঋণ নেওয়ার ক্ষেত্রে উন্নয়নের প্রয়োজন অনুযায়ী তা গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ঋণ যেন জিডিপির ১৫ শতাংশের মধ্যেই থাকে। বৈদেশিক ঋণ সেবা যেন মোট রফতানি ও প্রবাসী আয়ের ১০ শাতাংশের মধ্যেই থাকে।
এছাড়া ব্যাংকিং খাতে তদারকি বাড়াতে হবে। সব ব্যাংকের জন্য সমান আচরণ নিশ্চিত করতে হবে। খেলাপি ঋণ চলতি বছরের মধ্যে ৭ শতাংশ বা তার নিচে নামিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি রফতানি প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন নীতি পরিহার করতে হবে। বাণিজ্যনীতি বিরোধী রফতানির ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্ব দূর করতে বাণিজ্য সুরক্ষা দ্রুত কমাতে হবে। শিল্প ও বাণিজ্য নীতি বাস্তবায়নের জন্য একটি কৌশলপত্র তৈরি করতে হবে। যেটি বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহীত করবে এবং রফতানি বাড়াতে সহায়ক হবে।
চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাণিজ্য সংক্রান্ত দক্ষতা উন্নয়নে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নানা ধরণের উদ্যোগ নিতে পারে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি। বিশেষ করে ২৩টি প্রধান দেশের সঙ্গে এফটিএ’র প্রস্তাব ২০২৩ সালের মধ্যে তৈরি করে পাঠাতে হবে। এর মধ্যে অন্তত দুটি এফটিএ বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। এছাড়া বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সুবিধা বাড়াতে সময়ভিত্তিক অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি করতে হবে। দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়নে দ্রুত অ্যাকশন প্ল্যান তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংকের ডুয়িং বিজনেস ইন্ডিকেটরে উন্নয়ন ঘটাতে হবে। এ জন্য ২০১৯ সালের ১৭৬তম অবস্থান থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ৭৫ নম্বরে যেতে হবে।
বেসরকারি বিনিয়োগ ২০২৫ সালের মধ্যে জিডিপির ২৯ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। এছাড়া ২০৩১ সালের মধ্যে তা জিডিপির ৩২ শতাংশে নিতে হবে। সেইসঙ্গে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) ২০২২ সালের মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করতে হবে। জিইডির সুপারিশে আরও বলা হয়েছে, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে দক্ষ মানব সম্পদ তৈরি করতে হবে।
সারাবাংলা/জেজে/পিটিএম
দারিদ্র্য দারিদ্র্য বিমোচন স্বাধীনতা দিবস ২০২১ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী