উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির ধারাবাহিকতায় উন্নত দেশের পথে যাত্রা
২৬ মার্চ ২০২১ ২১:৩৮
ঢাকা: স্বাধীনতার পাঁচ দশকের পথচলা পূর্ণ করার প্রাক্কালেই এক অভূতপূর্ব অর্জনের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনকারী দেশটি স্থান করে নিয়েছে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে। আওয়ামী লীগ সরকার ঘোষিত ‘রূপকল্প ২০২১’ আর তাই কল্পনা নয়, আজ বাস্তব। দীর্ঘ প্রতীক্ষিত এই অর্জনেই অবশ্য থেমে নেই দেশ। ‘রূপকল্প ২০৪১’ নিয়ে এখন রীতিমতো উন্নত দেশের তালিকায় নিজেদের ঠাঁই বুঝে নিতে শুরু হয়েছে কাজ। আর সেই উন্নত দেশের পথে পৌঁছাতে সব সিঁড়ি আর প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করতেই বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ২০ বছর মেয়াদি দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০২১-২০৪১)।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানাচ্ছে, গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এনইসি বৈঠক এই ২০ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই রূপকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের লক্ষ্য অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয় এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হবে। আমরা নিম্ন আয়ের দেশ থেকে এখন নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সব শর্ত বাংলাদেশ পূরণ করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের সংস্থা সিডিপি বাংলাদেশকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দিতে চূড়ান্ত সুপারিশও দিয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২০২৪ সালে তা কার্যকর হবে।
ড. শামসুল আলম আরও বলেন, বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জনে উল্লেখযোগ্য সাফল্য লাভ করেছে। এখন চলছে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নের কাজ। এজন্য প্রয়োজন দ্রুতগতিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশীদারিত্বমূলক সমৃদ্ধির জন্য টেকসই রূপান্তর। দীর্ঘ মেয়াদি এ পরিকল্পনাটির সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমেই সেটি সম্ভব হবে।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, দেশের প্রথম প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি তৈরি করা হয় ২০১০-২০২১ মেয়াদে ১০ বছরের জন্য। ষষ্ঠ (২০১০-১৫) ও সপ্তম (২০১৬-২০) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। ফলে ২০০৯ সালের ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি বেড়ে ৮ শতাংশের ঘরও অতিক্রম করে। সবশেষ ২০১৯-২০ অর্থবছরে অবশ্য করোনাভাইরাস মহামারির কারণে সেটি কমে ৫ দশমিক ২৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে এ ক্ষেত্রেও মনে রাখতে হবে, এই অর্থবছরে বিশ্বের বড় বড় অর্থনীতির অনেক দেশের প্রবৃদ্ধিও ছিল নেতিবাচক। কেবল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে বাজেট ও পরিকল্পনার মধ্যে সমন্বয় ঘটানোর কারণেই এমন অর্জন সম্ভব হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রেক্ষিত পরিকল্পনাটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ২ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০৩১ সালে ৯ শতাংশে দাঁড়াবে। সেটি আবার বাড়তে বাড়তে ২০৪১ সালে গিয়ে হবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। এছাড়া চরম দারিদ্র্যের হার ২০২০ সালের ৮ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে কমে ২০৩১ সালে পৌঁছাবে শূন্যের কোঠায়। মাঝারি দারিদ্র্য বর্তমান বছরের ১৭ দশমিক ৮৩ শতাংশ থেকে কমে ২০৩১ সালে দাঁড়াবে ৯ দশমিক ৯ শতাংশে। পরিকল্পনার বাস্তবায়ন শেষে ২০৪১ সালে এ হার হবে ৫ শতাংশের নিচে। অর্থাৎ প্রায় দারিদ্র্যশূন্য হবে দেশ।
২০ বছর মেয়াদি এই পরিকল্পনাটিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার, জ্বালানি, যোগাযোগ, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি, তথ্য ও প্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণ এবং বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মতো বিভিন্ন বিষয়ে। আরও গুরুত্ব পেয়েছে বৈষম্য হ্রাস, ধারাবাহিক জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন, দারিদ্র্য নিরসন, কর্মসংস্থান তৈরি এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য কমানোর মতো বিষয়গুলো। মোট কথা, উন্নত দেশে পরিণত হতে হলে যা যা প্রয়োজন, তার প্রায় সবকিছুই পরিকল্পনাটিতে রয়েছে।
১৫ চ্যালেঞ্জ
রফতানি বহুমুখীকরণ ও বিনিময় হার ব্যবস্থাপনা, লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষাসহ ১৫টি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে দ্বিতীয় প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়। এর মধ্যে পুষ্টি ও খাদ্য নিরাপত্তা, টেকসই বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, প্রবৃদ্ধির জন্য পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপনা অন্যতম। এছাড়া খাতভিত্তিক বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ নির্ধারণ করে সেগুলো বাস্তবায়নে রূপরেখা দেওয়া হয়েছে।
গ্রাম হবে শহর
সরকারের নির্বাচনি ইশতেহার পূরণে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বৈষম্য কমানোর জন্য সব ধরনের বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়। এক্ষেত্রে শহরের সব সুবিধা পৌঁছে যাবে গ্রামে। মানুষকে আর যেকোনো প্রয়োজনে শহরে ছুটতে হবে না।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের ৮০ ভাগ মানুষ বাস করবে শহরে। সুতরাং গ্রাম ও শহরের বৈষম্য আর থাকবে না। চলতি অর্থবছরের জাতীয় বাজেটের মাধ্যমেও এরই মধ্যে গ্রামকে শহরে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন শুরু হলেও এই বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়।
প্রেক্ষিত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপই এই অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। এরই মধ্যে বাস্তবায়ন শুরু হওয়া এ পরিকল্পনাটিতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য নিয়ে আসার কথা বলা হয়েছে। গ্রাম ও শহরের মধ্যে ব্যবধান কমাতে উত্তম পরিবহন সেবা ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ছড়িয়ে দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। রূপান্তরের এ গতিকে আরও ত্বরান্বিত করার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যা আছে
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ৬৪ লাখ ৯৫ হাজার ৯৮০ কোটি টাকা। এর মধ্যে অভ্যন্তরীণ (দেশীয়) উৎস থেকে ৫৭ লাখ ৪৮ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা ও বৈদেশিক উৎস থেকে ৭৪ হাজার ৭৫৯ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। এছাড়া মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে ১২ লাখ ৩০ হাজার ১২০ কোটি টাকা ও ব্যক্তি খাত থেকে ৫২ লাখ ৬৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ব্যয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে।
পরিকল্পনা মেয়াদে অর্থাৎ পাঁচ বছরে ১ কোটি ১৩ লাখ ৩০ হাজার নতুন কর্মসংস্থান তৈরির লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে বৈদেশিক কর্মসংস্থান ৩২ লাখ ৫০ হাজার, দেশীয় ৮০ লাখ ৫০ হাজার। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে বার্ষিক গড় জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) অর্জন হবে ৮ শতাংশ হারে। পরিকল্পনার শেষ অর্থবছরে এই হার দাঁড়াবে ৮ দশমিক ৫১ শতাংশে।
দেশের মূল্যস্ফীতির লাগাম টানার লক্ষ্যও নির্ধারণ করা হয়েছে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়। এক্ষেত্রে চলতি অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে পাঁচ দশমিক পাঁচ শতাংশ। পাঁচ বছর পর ২০২৪-২৫ অর্থবছরে একে চার দশমিক আট শতাংশে নামানোর লক্ষ্য রয়েছে।
পরিকল্পনায় বিনিয়োগের লক্ষ্য ধরা হচ্ছে মোট জিডিপির ৩৭ দশমিক চার শতাংশ। ২০২৫ সাল নাগাদ কর জিডিপির অনুপাত বর্তমানের ৮ দশমিক ৯০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১২ দশমিক ৩০ শতাংশ করা হবে। রাজস্ব আয় বাড়ানো ও বাণিজ্য শুল্কের উপর নির্ভরতা কমাতে এই দুই লক্ষ্য অর্জনের জন্য রাজস্ব আইনের আরও সংস্কার এবং কর প্রশাসনে আধুনিকায়ন ও শক্তিশালীকরণে প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা হবে। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় অর্থায়নের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।
করোনা মোকাবেলা ও আর্থিক পুনরুদ্ধারে ২৪৪ উন্নয়ন কৌশল
দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির যে ধারাবাহিকতা, তাতে ২০৪১ সাল নাগাদ উন্নত দেশে রূপান্তরিত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সংশয় ছিল না প্রায় কারওই। তবে করোনাভাইরাসের অভিঘাত এই ধারাবাহিকতায় ছেদ টেনেছে। অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় আগের গতি থাকবে কি না, তা নিয়েও ছিল সংশয়। সেই সংশয় মেটাতেই চলমান অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কোভিড-১৯ মোকাবিলাসহ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ২৪৪টি উন্নয়ন কৌশল নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে কেবল করোনা মোকাবিলায় থাকছে পাঁচটি কৌশল। এছাড়া আন্তঃসম্পর্কিত উন্নয়ন কৌশল রয়েছে ছয়টি। পশ্চাৎপদ অঞ্চলের দারিদ্র্য সমস্যা মোকাবিলায় রয়েছে ছয়টি কৌশল। সেই সঙ্গে খাতভিত্তিক উন্নয়ন কৌশল রয়েছে ২২৭টি কৌশল। ১৪টি অধ্যায়ে এসব কৌশল নির্ধারণ করা হয়েছে।
অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় কোভিড-১৯-এর প্রভাব মোকাবিলায় যে কৌশলগুলো নেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে সরকারের উন্নয়ন রূপকল্প ও নির্বাচনি ইশতেহারের আলোকে পরিকল্পনায় নীতি ধারাবাহিকতার দিকটিতে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হবে। এক্ষেত্রে যেসব কার্যসম্পাদক সূচকে বাংলাদেশ এখনো পিছিয়ে আছে, সেসব ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া অর্থনীতিতে পিছিয়ে পড়া খাতগুলো সংস্কারের গতি বাড়ানোর বিষয়টি কোভিডের কারণে আরও বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে।
কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট সাময়িক বেকারত্বসহ বিদেশ ফেরত কর্মীদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরিতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। স্বাস্থ্য খাতে কোভিড-১৯ মহামারিসহ ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে ক্রমান্বয়ে একটি সার্বজনীনন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা বা ইউনিভার্সাল হেলথ সিস্টেম প্রবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। কোভিড-১৯-এর বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা এবং প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনের হার বাড়াতে জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়নের কথাও বলা হয়েছে।
সারাবাংলা/জেজে/টিআর