Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মার্চের শেষ ৮ দিনেই সংক্রমণ জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারির বেশি!

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ এপ্রিল ২০২১ ১৮:৩৭

ঢাকা: বছর পেরিয়ে এসে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ সব মাত্রা ছাড়াচ্ছে। গত বছরের শেষ ভাগ থেকে চলতি বছরের মার্চের আগ পর্যন্তও সংক্রমণের গতি ছিল কিছুটা কম। কিন্তু মার্চে এসে সংক্রমণ ছাড়িয়ে যাচ্ছে গত বছরের সর্বোচ্চ অবস্থানকেও। বিশেষ করে মার্চের শেষের দিকে এই সংক্রমণের মাত্রাটা ভয়াবহ হারে বেড়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, মার্চে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬৫ হাজার ৭৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এই মাসের সংক্রমণের সংখ্যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মোট সংক্রমণের চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু তাই নয়, মার্চের শেষ আট দিনের সংক্রমণই জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মোট সংক্রমণের চেয়ে বেশি! কেবল সংক্রমণের সংখ্যা নয়, মার্চে এসে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হারও।

বিজ্ঞাপন

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি দিকে দেশে সংক্রমণের সংখ্যা কমে এলেও মার্চে যেভাবে সংক্রমণ বেড়েছে, তাতে প্রাথমিকভাবে এটিকেই করোনাভাইরাসের ‘সেকেন্ড ওয়েভ’ বা ‘দ্বিতীয় ঢেউ’য়ের শুরু বলা যেতে পারে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনের দিনে সংক্রমণ ও সংক্রমণের হার আরও অনেক বেশি বাড়বে। সেক্ষেত্রে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হারও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিটি কর্তৃপক্ষকে পর্যাপ্ত পরিমাণে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

বুধবার (৩১ মার্চ) স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানার সই করা কোভিড-১৯ সংক্রান্ত নিয়মিত বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় সারাদেশে শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৩৫৮ জন, যা এখন পর্যন্ত একদিনে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্তের রেকর্ড। এছাড়া এদিন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৫২ জন। এতে দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু ৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

বিজ্ঞাপন

জানুয়ারি মাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি

দেশে জানুয়ারি মাসে চার লাখ ২৪ হাজার ১২৪টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে ২১ হাজার ৬২৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই মাসের কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ৫৬৮ জন মৃত্যুবরণ করেন। জানুয়ারি মাসে দেশে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল পাঁচ দশমিক ১০ শতাংশ। এই মাসে শনাক্ত অনুপারে মৃত্যুর হার ছিল দুই দশমিক ৬৩ শতাংশ।

জানুয়ারি মাসে দেশে ২৪ ঘণ্টায় সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা ছিল ১০ জানুয়ারি এক হাজার ৭১ জনের মাঝে। তবে ১১ জানুয়ারি থেকে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা শতকের ঘরে নেমে আসে। এই দিন থেকেই মূলত বাংলাদেশে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা কমতে শুরু করে। এই মাসের ৭ জানুয়ারি সর্বোচ্চ ৩১ জন মারা গেলেও পরবর্তীতে এই সংখ্যাও কমে আসে।

ফেব্রুয়ারি মাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি

জানুয়ারি মাসের ধারাবাহিকতায় ফেব্রুয়ারি মাসেও দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা কমতে থাকে। এই মাসে ২৯১ জনের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি, যা ৩০২ দিনের মধ্যে সর্বনিম্ন। সব মিলিয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৩০৫টি নমুনা পরীক্ষা করে ১১ হাজার ৭৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

বাংলাদেশে সংক্রমণ শনাক্তের পরে মাসিক হিসেবে এটি সর্বনিম্ন সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা। নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে এই মাসে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল দুই দশমিক ৮২ শতাংশ, যেটিও যেকোনো সময়ের তুলনায় ছিল সবচেয়ে কম। ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান ২৮১ জন। এটিও বাংলাদেশে ২০২০ সালের এপ্রিল মাসের পরে সর্বনিম্ন সংখ্যা।

মার্চ মাসের সংক্রমণ পরিস্থিতি

মার্চ মাসের প্রথম ১০ দিন দেশে নমুনা পরীক্ষার অনুপাতে সংক্রমণ শনাক্ত এক হাজারের নিচে থাকলেও ৯ মার্চ দেশে দ্বিতীয়বারের মতো কোভিড-১৯ সংক্রমণ হার পাঁচ শতাংশের ওপরে ওঠে। ওই দিন দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয় এক হাজার ১৮ জনের মাঝে। ৫৮ দিন পরে দেশে এ দিন কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা এক হাজার ছাড়ায়।

১১ মার্চ থেকে সংক্রমণের মাত্রা বাড়তে থাকে। ১৮ মার্চ এই শনাক্তের সংখ্যা হয় ২ হাজার ১৬৯, যা ৯ ডিসেম্বরের পরে সর্বোচ্চ। এরপর ২৩ মার্চ দেশে সংক্রমণ শনাক্তের সংখ্যা তিন হাজার ৫৫৪ জনে দাঁড়ায়, যা ১৮ আগস্টের পর সর্বোচ্চ। আর মার্চের শেষ তিন দিনই সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে পাঁচ হাজারের বেশি, যা এর আগে কখনোই হয়নি।

সব মিলিয়ে মার্চে ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ৬৫ হাজার ৭৯ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এই মাসে দেশে প্রায় সাত মাস পর সংক্রমণ হার ১৭ শতাংশ অতিক্রম করে ২৮ মার্চ। ৩১ মার্চ দেশে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ১৯ দশমিক ৮৯৫ শতাংশ, যা গত বছরের ২২ আগস্টের (১৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ) পর সর্বোচ্চ। সব মিলিয়ে মার্চে সংক্রমণের হার ১০ দশমিক ৩৯ শতাংশ। এদিকে, মার্চ মাসে দেশে ৬৩৮ জনের মৃত্যু হয়েছে করোনা সংক্রমণ নিয়ে।

মার্চে সংক্রমণ জানুয়ারিফেব্রুয়ারির দ্বিগুণ

দেশে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাস মিলিয়ে সারাদেশে মোট ৩২ হাজার ৭০৬ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। কিন্তু কেবল মার্চ মাসেই কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৬৫ হাজার ৪১২ জনের মাঝে। অর্থাৎ মার্চের সংক্রমণ সংখ্যা যা জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের মোট সংক্রমণেরও দ্বিগুণ।

কোনো একমাসের সংক্রমণের হিসেবে বাংলাদেশে চলতি মার্চে চতুর্থ সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর আগে ২০২০ সালের জুন মাসে এখন পর্যন্ত একমাসে সর্বোচ্চ ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের মধ্যে সংক্রমণ শনাক্ত হয়, জুলাই মাসে সংক্রমণ ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৯২ হাজার ১৭৮। আর গত বছরের আগস্টে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার ৩৩৫ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়।

এই তথ্য বলছে, জানুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চ মাসে সংক্রমণ বেড়েছে তিন গুণ। অন্যদিকে ফেব্রুয়ারি মাসের তুলনায় মার্চ মাসে সংক্রমণ বেড়েছে প্রায় ছয় গুণ।

মার্চের শেষ দিনে সংক্রমণ জানুয়ারিফেব্রুয়ারির মাসের দ্বিগুণ

এদিকে, মার্চের শেষ আট দিনেই সংক্রমণের পরিমাণ ছাড়িয়েছে জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি মাসের চেয়ে বেশি। কেননা, জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে যেখানে মোট সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল ৩২ হাজার ৭০৬টি, সেখানে মার্চে শেষ আট দিনেই এর পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৫৪টি।

ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিগুণ মৃত্যু মার্চে

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে ফেব্রুয়ারি মাসে মারা গেছেন ২৮১ জন। কিন্তু মার্চ মাসে মারা যান ৬৩৮ জন। অর্থাৎ মার্চ মাসে ফেব্রুয়ারি চেয়ে ২ দশমিক ২৭ গুণ বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, বাংলাদেশের মৃত্যুর হার কম ছিল। এটা অনেক কারণে হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যে প্রবণতা দেখা যাচ্ছে, তাকে সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। মানুষের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। ভ্যাকসিন নেওয়ার সংখ্যাও বাড়াতে হবে। কারণ ভ্যাকসিন কিন্তু মৃত্যুঝুঁকি অনেকটাই কমিয়ে আনে। এক্ষেত্রে কেউ সংক্রমিত হলেও তার হয়তো ঝুঁকির মাত্রা কমে আসবে। সব দিক বিবেচনায় বলব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাই মিলে চেষ্টা করা হলে তবেই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যেতে পারে।

তিনি বলেন, দেশে যেভাবে এখন সংক্রমণ বাড়ছে, সেটিকে আমরা সেকেন্ড ওয়েভের সূচনা বলতে পারি। পরপর চার সপ্তাহ যদি সংক্রমণের হার এমন থাকে, তবে সেটিকে ওয়েভ বলা যেতে পারে, যার পুরোপুরি লক্ষণ এখন আছে। এই ধারা যদি কমাতে হয় তবে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।

সংক্রমণের মাত্রা কমানোর জন্য মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার দিকে গুরুত্ব দেন কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও ভাইরোলজি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম।

তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ভ্যাকসিন প্রয়োগ শুরু হলেও মাস্ক পরার প্রবণতা ধরে রাখতে হবে। পাশাপাশি মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। অসুস্থ বোধ করলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়াটাও জরুরি, যেন প্রাথমিক পর্যায়েই চিকিৎসা শুরু করা যায়। এমনটা যদি করা যায় তবে হয়তোবা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে বর্তমান পরিস্থিতি। একই সঙ্গে সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকরি ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন, যেন সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।

আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এ এস এম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে— শনাক্তের হার শতকরা পাঁচ শতাংশের নিচে নেমে এলে সেটিকে স্থিতিশীল বা সহনীয় পর্যায় বলা যেতে পারে। আমাদের এখানে একটা দীর্ঘ সময় সেভাবেই যাচ্ছিল। কিন্তু মার্চ মাস থেকে সংক্রমণ হার বাড়তে থাকে। এর অন্যতম কারণ মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে কিছুটা অসেচতনতা। মাস্ক পরার অভ্যাস যেটা আমরা জানুয়ারিতেও গড়ে তুলেছিলাম, সেটি কমে গেছে। একইসঙ্গে দেশে বিভিন্ন পিকনিক স্পটসহ বিয়ে ও জনসমাগম হয়— এমন অনুষ্ঠান বেড়েছে। সবকিছু মিলিয়েই সংক্রমণ পরিস্থিতি বাড়ছে।

তিনি বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কিন্তু এখন সংক্রমণ বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মহারাষ্ট্র, কেরালাসহ আরও অনেক জায়গায় সংক্রমণ বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে মাস্ক পরাসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি আমাদের মেনে চলতেই হবে।  স্বাস্থ্যবিধি বিষয়ে যেকোনো ধরনের শিথিলতার সুযোগে কিন্তু সংক্রমণ বেড়ে যেতে পারে।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

করোনা সংক্রমণ করোনাভাইরাস কোভিড-১৯

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর