ফ্লাইট বন্ধের পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের, সরকারের না
২ এপ্রিল ২০২১ ২২:১৫
ঢাকা: গত কয়েকদিন ধরে প্রতিদিন করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের হার ব্যাপকভাবে ঊর্ধ্বমুখী। প্রতিদিনই আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে বাড়ছে সংক্রমণ। এ পরিস্থিতিতে সরকার ১৮ দফা নির্দেশনা জারির মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতির পেছনে জনগণের স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদাসীনতার পাশাপাশি কাজ করছে যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের করোনাভাইরাসের নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি। চলমান এই পরিস্থিতিতে তারা অন্যান্য দেশের সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ তথা উড়োজাহাজের ফ্লাইট বন্ধের পরামর্শ দিচ্ছেন।
এভিয়েশন খাতের বিশেষজ্ঞরাও বলছেন, পুরোপুরি না হলেও যেসব দেশ করোনা সংক্রমণের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে, সেসব দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে। তবে এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান ভিন্ন। এখনই কোনো দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না বলে জানাচ্ছে কর্তৃপক্ষ।
এর আগে, গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথমবারের মতো দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়। ওই মার্চেরই মাঝামাঝি সময়ে দুয়েকটি দেশ ছাড়া বাকি সব দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশ। অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট তো বন্ধ ছিলই। কিন্তু এবারে দেশে করোনা সংক্রমণ অতীতের সব রেকর্ড ছাড়ালেও সব দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধের পথে হাঁটছে না সরকার।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য বলছে, শুক্রবার (২ এপ্রিল) দেশে একদিনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্তের ফের নতুন রেকর্ড হয়েছে। আগের দিনের রেকর্ড ভেঙে আক্রান্ত ৬ হাজার ৮৩০ জন শনাক্ত হয়েছেন। একই সময়ে সারাদেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন আরও ৫০ জন। এমন পরিস্থিতিতে বৃহস্পতিবার (১ এপ্রিল) বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইউরোপের ২৫টি দেশ এবং আর্জেটিনা, ব্রাজিল, চিলি, তুরস্ক, সাউথ আফ্রিকা, উরুগুয়ে, পেরু, বাহরাইন, জর্ডান, লেবানন, কুয়েত ও কাতার— এই ৩৭টি দেশ থেকে কোনো যাত্রী বাংলাদেশে প্রবেশ করতে পারবেন না। ৩ এপ্রিল রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে থেকে ১৮ এপ্রিল পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা কার্যকর থাকবে।
বাংলাদেশ ৩৭ দেশ থেকে আকাশপথে আসা যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিলেও যুক্তরাজ্যের জন্য এই নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। যদিও পরদিন আজ শুক্রবার যুক্তরাজ্যই বাংলাদেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ৩৭টি দেশ থেকে যাত্রী প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেশে করোনা সংক্রমণের বর্তমান পরিস্থিতিতে যথেষ্ট নয়। যেসব দেশেই করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি অবনতিশীল, সেই প্রতিটি দেশকেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা উচিত।
দেশে করোনা সংক্রমণের বর্তমান এই পরিস্থিতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) সাবেক উপাচার্য ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অন্যতম সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, এভিয়েশন থেকে এর আগে যেসব সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে, এর মধ্যে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ না করার সিদ্ধান্তটি সাংঘর্ষিক। কেননা যুক্তরাজ্যে এখনো করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণ বন্ধ হয়নি। এছাড়া ভারতের সঙ্গে আমাদের আকাশপথে যোগাযোগ চলমান রয়েছে। সেখানে সংক্রমণ বাড়ছে। ভারত থেকে কেউ যদি সংক্রমিত হয়ে বাংলাদেশে আসেন, তার মাধ্যমে দেশে সংক্রমণ ছড়ালে তার দায়ভার কে নেবেন?
ডা. নজরুল আরও বলেন, অন্যান্য দেশের সঙ্গে আমাদের আকাশপথে যোগাযোগ ব্যবস্থা যে চলমান রয়েছে, এটি আমদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। এ অবস্থায় নির্দিষ্ট সময়েরর জন্য প্রতিটি দেশের সঙ্গে ফ্লাইট নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বন্ধ করা জরুরি।
অন্যান্য দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ নিয়ে জানতে চাইলে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ আশীষ রায় চৌধুরী সারাবাংলাকে বলেন, করোনা যে হারে বাড়ছে, সেটা তো আমরা লুকাতে পারি না। যুক্তরাজ্য যেহেতু আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, এখন আরও অনেক দেশ আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। আমাদের এখানে সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে। সময় হয়েছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠিন পদক্ষেপ নেওয়ার। এর জন্য আংশিক লকডাউন দিয়ে হলেও বিমানবন্দরকে সুরক্ষিত করতে হবে। কেননা সামনে আরও অনেক দেশ আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেবে। আমাদেরও আসলে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকি বিবেচনায় বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করা উচিত।
আশীষ রায় চৌধুরী আরও বলেন, আন্তর্জাতিক ফ্লাইট তো বটেই, আমাদের অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটও বন্ধ করতে হবে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি, সেসব এলাকায় সম্পূর্ণভাবে লকডাউন করা উচিত। এখন সিভিল এভিয়েশন কী করবে, সেটা তারাই জানে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ মনিটর পত্রিকার সম্পাদক কাজী ওয়াহিদুল আলম সারাবাংলাকে বলেন, ফ্লাইট পুরোপুরি বন্ধ না করলেও আংশিকভাবে বন্ধ তো করতেই হবে। যেসব দেশে করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি নাজুক, সেবব দেশের সঙ্গে ফ্লাইট তো বন্ধ করতেই হবে। করোনা যেভাবে বাড়ছে, তাতে যেকোনো ধরনের বিপদ আসার আগেই আমাদের সেটি আটকাতে হবে। ফ্লাইট কিছুটা সচল রাখতে হলেও বিমানবন্দরে স্ক্রিনিংটার ওপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
কাজী ওয়াহিদুল আলম আরও বলেন, ফ্লাইট চালু রাখতে হলে আমরা সিঙ্গাপুরকে অনুসরণ করতে পারি। তারা কিন্তু যেকোনো দেশ থেকে যাত্রী গেলেই বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইন করাচ্ছে। আমরাও যদি ফ্লাইট চালু রাখি, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এই ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইন যেকোনো মূল্যে পালন করাতে হবে। অন্য দেশগুলোর উদাহরণ এ ক্ষেত্রে রয়েছে, সেগুলোই অনুসরণ করা উচিত।
বিশেষজ্ঞরা ফ্লাইট বন্ধের এমন মত দিলেও সরকারের পক্ষ থেকে এখনই ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে না বলে জানালেন বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল এম মফিদুর রহমান। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, আমরা যে দেশগুলোর সঙ্গে আকাশপথে যোগাযোগ বন্ধ করেছি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকায় তারা ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে যুক্তরাজ্যের নাম না থাকায় আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করিনি। কিন্তু আজ যুক্তরাজ্যই আমাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। তারা নিজেদের স্বার্থেই এটি করেছে।
বেবিচক চেয়ারম্যান আরও বলেন, আমরা যে সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছি সেগুলো সব স্তরে ভালোভাবে পালন করা গেলে আকাশপথ থেকে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি অনেকটাই কমে যাবে। কিন্তু আমাদের এখন ঝুঁকিটা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে। আমাদের জনগণ অসচেতন। তারা অবাধে চলাচল করছে। কোনো স্বাস্থ্যবিধি মানছে না। বিদেশ থেকে আসা যাত্রীদের যে ঝুঁকি রয়েছে, সেটি আমরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করছি। আমরা এখন যেকোনো দেশ থেকে আসা যাত্রীদের ১৪ দিনের কোয়ারেনটাইন ব্যবস্থা নিয়েছি। এতেও যদি কাজ না হয়, তাহলে আমরা লকডাউনে যাব। আমরা আগামী দুই সপ্তাহ দেখব যে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো থেকে কোনো ফল আসছে কি না। যদি দেখা যায় বিদেশ থেকে আসা যাত্রীরা আমাদের করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে, তাহলে আমরা লকডাউন দিয়ে দেবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী সারাবাংলাকে বলেন, কোনো কিছু বন্ধ করে কোনো সমাধান আসবে না। এটা তো আর কেউ বলতে পারবে না যে কতদিন সংকমণ থাকবে বা থাকবে না। তাই পরিস্থিতি বুঝে আমরা ব্যবস্থা নেব। একইসঙ্গে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে ফ্লাইট পরিচালনা করার দিকে আমরা জোর দিচ্ছি।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, সারাবিশ্বে এখন করোনা সংক্রমণ বাড়ছে। যেখানে সংক্রমণের হার কমে গিয়েছিল, সেখানেও সংক্রমণ বাড়ছে। তাই ফ্লাইট চালু রেখেই আমরা পরবর্তী সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছি। কেননা এখানে জীবন ও জীবিকার প্রশ্ন রয়েছে। আর ফ্লাইট বন্ধ করলেই তো সবকিছুর সমাধান হবে না। এখানে আন্তর্জাতিক যোগসূত্রও রয়েছে।
যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সে বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী বলেন, যুক্তরাজ্য আমাদের ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, সেটি তাদের ব্যাপার। যেসব দেশে সংক্রমণ বাড়ছে, সেসব দেশের ওপর তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। একসময় অন্যরাও আমাদের যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্লাইট বন্ধ করতে বলেছিল। কেননা যুক্তরাজ্যে তখন সংক্রমণ বেশি ছিল। এখন আমাদের এখানে সংক্রমণে ঊর্ধ্বগতি থাকায় তারা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।
সারাবাংলা/এসজে/টিআর
টপ নিউজ ফ্লাইট বন্ধ বিমানবন্দর লকডাউন বেবিচক বেসরকারি বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ সিভিল এভিয়েশন