স্বাস্থ্যবিধি না মানার মাশুল গুনছে বিএনপি
৩ এপ্রিল ২০২১ ০৯:৪৪
ঢাকা: শুরুটা হয়েছিল গত বছর ২৫ মার্চ। বাংলাদেশে করোনা শনাক্ত হওয়ার ১৭তম দিনে দেশে যখন লগডাউনের প্রস্তুতি চলছিল, করোনাতঙ্কে মানুষের যখন ‘জুবুথুবু অবস্থা’ ঠিক তখন সরকারের নির্বাহী আদেশে সাময়িক মুক্তি পান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর দলের চেয়ারপারসনকে স্বাগত জানাতে বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী, সমর্থক জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। শুধু তাই নয়, শাহবাগ থেকে গুলশান-২ পর্যন্ত খালেদা জিয়ার যাত্রাপথ জুড়ে ছিল দলীয় নেতাকর্মীর জটলা।
এরপর গত এক বছরে নানা ইস্যুতে মাঠে নেমেছে বিএনপি। কখনো ত্রাণ তৎপরতা, কখনো সাংগঠনিক কার্যক্রম, কখনো রাজনৈতিক কর্মসূচি, কখনো সরকারবিরোধী সভা-সমাবেশ। সর্বশেষ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে নানা আয়োজন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এসব কর্মসূচি পালনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। সাধারণ নেতাকর্মী তো বটেই, অনেক সময় দায়িত্বশীল নেতারাও যথাযথভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানেন নি। ফলে করোনা সংক্রমণ শুরুর পর পরই দলটির বেশ কয়েকজ গুরুত্বপূর্ণ নেতা আক্রান্ত হন। কয়েকজন মারাও যান। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন বিএনপির ৪৪০ নেতা।
বিএনপির প্রেস উইংয়ের দেওয়া তথ্যমতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে এই মুহূর্তে চিকিৎসাধীন আছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ডাক্তার এ জেড এম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য ডা. এ কে এম আজিজুল হক, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন মিডিয়া কমিটির সদস্য সাংবাদিক আতিকুর রহমান রুমন, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল প্রমুখ।
উল্লেখিত নেতাদের মধ্যে করোনাকালে সব চেয়ে বেশি মাঠে থাকতে দেখা গেছে দলটির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীকে। প্রায় প্রতিনিদিনেই কোনো না কোনো ইস্যুতে মাঠে নেমেছেন তিনি। শুধু রাজধানী ঢাকা নয়, করোনা মহামারির মধ্যে আশপাশের জেলাগুলোতে আয়োজিত দলীয় প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন তিনি। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে গাদা-গাদি, ঠেলা-ঠেলি করে মানববন্ধন, ত্রাণবিতরণ, বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা গেছে তাকে।
করোনার প্রথম ‘ঢেউ’ সুস্থ অবস্থায় পার করলেও দ্বিতীয় ‘ঢেউ’- এ এসে কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে এ মুহূর্তে চিকিৎসাধীন আছেন রুহুল কবির রিজভী। অবস্থার অবনতি হওয়ায় গত বুধবার (৩১ মার্চ) স্কয়ার হাসপাতালের আইসিইউতে স্থানান্তর করা হয়েছে তাকে।
করোনাভাইরাস বয়স্কদের জন্য বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির প্রবীণ নেতারা দলের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সারা বছর মাঠে থেকেছেন। দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হওয়ার পর প্রায় প্রতিদিন তাকে নানা অনুষ্ঠানে যেতে হয়েছে।
দলীয় সূত্রমতে, এসব অনুষ্ঠানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বাস্থ্যবিধি মানা হয়নি। বিশেষ বিশেষ দিবসে আয়োজিত আলোচনা সভাগুলোতে সভাপতিত্ব করতে হয়েছে তাকে। ফলে অনুষ্ঠানের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বসে থাকতে হয়েছে তাকে। সঙ্গত কারণেই ‘অশীতিপর বৃদ্ধ’ ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন অতিমাত্রায় করোনা ঝুঁকির মধ্যে ছিলেন। দুইদিন আগে তার শরীরে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছে। এখন তিনি স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পেশাজীবী নেতা হিসেবে তো বটেই, বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবেও ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন করোনার শুরু থেকেই ছিলেন মাঠে। নিজে একজন চিকিৎসক হওয়া সত্বেও করোনাকালে মানুষের ভিড়ের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ থাকা, শারীরিক দূরত্ব বজায় না রেখে দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে গা ঘেঁষে কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক বিক্ষোভ সমাবেশে পুলিশের পিটুনি খান ডা. এ জেড এম জাহিদ হোসেন। এই মুহূর্তে তিনিও করোনা পজিটিভ।
দলের ‘সেকেন্ডম্যান’ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও সারাবছর মাঠে ছিলেন। তবে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে অন্যদের তুলনায় তিনি একটু এগিয়ে ছিলেন। শুরুর দিকে পিপিই পরেই অনুষ্ঠানগুলোতে অংশ নিতেন। করোনা প্রকোপ কমে এলে ‘সুরক্ষা ক্যাপ’, ‘মাস্ক’, ‘হ্যান্ডগ্লাভস’ পরে দলীয় প্রোগ্রামে অংশ নিয়েছেন। করোনার দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর আগে সিঙ্গাপুর গিয়ে চিকিৎসা নিয়ে এসেছেন। গত ১ মার্চ করোনার ভ্যাকসিনও নিয়েছেন তিনি। এখন পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হননি তিনি। তবে দলের অন্যান্য নেতাদের করোনা আক্রান্ত হওয়ার খবরে বিচলিত মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
কারণ, এরইমধ্যে করোনায় মারা গেছেন বিএনপির ৪৪০ জন নেতাকর্মী। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ, মেজর জেনারেল (অব.) রুহুল আলম চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সিলেট মহানগর বিএনপির সাবেক সভাপতি এম এ হক, ঢাকা মহানগর (উত্তর) বিএনপি সাধারণ সম্পাদক আহসান উল্লাহ হাসন, বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল আউয়াল খান, ওলামা দলের নেতা মওলানা কাসেমী, গাইবান্ধা জেলা বিএনপির সহসভাপতি খন্দকার আহাদ আহমেদ, ঢাকা পল্লবী থানা বিএনপির সহ-সভাপতি মো. আনিসুর রহমান, সাবেক মন্ত্রী টি এম গিয়াস উদ্দিন, চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সহ-সভাপতি লায়ন মোহাম্মদ কামাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি সভাপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য অ্যাডভোকেট কবির চৌধুরী, জাতীয় ট্যাক্সসেস বার সভাপতি অ্যাডভোকেট গফুর মজুমদার, শ্রমিক দলের সহ-সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক মোল্লা, গাজীপুর শ্রীপুর পৌরসভা বিএনপি মেয়র প্রার্থী শহিদুল্লাহ শহীদ, আমেরিকার বোস্টন বিএনপি ক্রীড়াবিষয়ক সম্পাদক মিতোষ বড়ুয়া, বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য আমজাদ হোসেন সরকার, এ টি এম আলমগীর প্রমুখ।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা মহামারির পুরো সময়টা যখন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ সিনিয়র নেতারা নিজ নিজ বাসায় থেকেই দলীয় এবং সরকারের কার্যক্রম পরিচালনা করেছেন, ঠিক তখন বিএনপির শীর্ষ নেতারা স্বদলবলে স্বাস্থ্যবিধির তোয়াক্কা না করে মাঠে কাঁপিয়ে বেড়িয়েছেন। আর এখন সেই ভুলেরই মাশুল গুনছেন তারা।
অবশ্য দলটির শীর্ষ নেতারা বলছেন, ‘জনগণের দল’ হিসেবে বিএনপি জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। এটা তাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর সরকারই বিএনপিকে বার বার মাঠে নামতে বাধ্য করেছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সারাবাংলাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে বিএনপি স্বচেষ্ট ছিল সব সময়। কিন্তু সরকারই আমাদেরকে করোনা ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিয়েছে। তারা আমাদেরকে বাধ্য করেছে মাঠে নামতে।’
সারাবাংলা/এজেড/একে