ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় আগামী ৫ এপ্রিল থেকে সারাদেশে লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের এমন বক্তব্যের পর রাজধানীর বাস, ট্রেন ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে উপচে পড়া ভিড় শুরু হয়েছে। বাস টার্মিনালগুলোর এমন চিত্রকে রীতিমতো ঈদ উৎসবের সঙ্গে তুলনা করছেন পরিবহন সংশ্লিষ্টরা। বাড়ির পথে থাকা যাত্রীদের মধ্যে সরকারি চাকরিজীবীদেরও একটি বড় অংশ রয়েছে বলে জানা গেছে।
শনিবার (৩ এপ্রিল) দুপুরে রাজধানীর সায়েদাবাদ, গুলিস্তান, ফুলবাড়িয়া, গাবতলী ও মহাখালী বাস টার্মিনাল, কমলাপুর রেলস্টেশন এবং সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল ঘুরে হঠাৎ ঘরমুখী মানুষের এমন উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে।
শনিবার দুপুর ১টার দিকে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায়, যাত্রীরা টিকিটের জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। অনেকেই টিকেট পাচ্ছেন না। সাধারণত কুমিল্লাগামী বাসগুলোর টিকিট বাসে ওঠার পর দেওয়া হয়। তবে এই রুটের বাসগুলো টার্মিনাল থেকে ছেড়ে যাওয়ার প্রস্তুত নিলে নিমিষেই ভরে যাচ্ছে।
এর জন্য অবশ্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিষয়টিকে কারণ হিসেবে অভিহিত করছেন তিশা পরিবহনের ম্যানেজার আব্দুল হাকিম। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, একটি বাসে আগে যেখানে ৪০-৫০ জন যাত্রী ওঠার পর ছাড়ত, সেখানে এখন ২০-২৫ জন যাত্রী ভরলেই বাস ছেড়ে যাচ্ছে।
শফিকুল ইসলাম নামে এক যাত্রী সারাবাংলাকে বলেন, সরকার ৬০ শতাংশ ভাড়া বাড়াতে বললেও টিকিটের দাম দ্বিগুণ করা হয়েছে। তবে দ্বিগুণ ভাড়া দিয়েও সিট মিলছে না। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর একেকজন বাসে উঠতে পারছেন ।
পরিবার নিয়ে বাড়ি যাবেন নোয়াখালী ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি বলেন, লকডাউন দেওয়া হবে এমন খবর শোনার পর পরিবারের সদস্যদের গ্রামের বাড়িতে রাখতে টার্মিনালে এসেছি। কিন্তু সহজে বাস মিলছে না। ভাড়াও দ্বিগুণ চাচ্ছে। তবে ভাড়া যাই হোক, নোয়াখালী যেতেই হবে।
প্রায় একই চিত্র দেখা গেছে কমলাপুর বাস কাউন্টারগুলোতে। আর যাত্রাবাড়ী এলাকা তো মোটামুটি থমকে আছে। সড়কে গাড়ির চাপও আজকে অনেক বেশি।
যাত্রাবাড়ী এলাকার ট্রাফিক সার্জেন্ট রাব্বানী সরকার বলেন, ওয়াবায়দুল কাদের লকডাউনের ঘোষণা দেওয়ার পরপরই হঠাৎ করেই সড়কে মানুষের স্রোত শুরু হয়। কেউ পরিবার নিয়ে, আবার কেউ নিজে ব্যাগ-বস্তা নিয়ে বাস ধরতে টার্মিনালগুলোতে ভিড় শুরু করেন।
গাবতলী বাস টার্মিনালে গিয়ে দেখা যায় বাসগুলো সারি সারি করে রাখা আছে। যাত্রীদের তেমন একটা ভিড় নেই। তবে টার্মিনাল সংশ্লিষ্টরা জানান, গাবতলী টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বাস বিশেষ করে রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, বুড়িমারী ও নীলফামারীর দিকে মূলত ছেড়ে যায় সন্ধ্যার পর। সকালে কিছু বাস ছাড়লেও বেশিরভাগ বাসেই ছেড়ে যায় সন্ধ্যার পর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সময়ে। তাই দুপুরের দিকে যাত্রীদের ভিড় কম। তবে বেশিরভাগ বাসের টিকিটই সব শেষ হয়ে গেছে।
লকডাউন ঘোষণার খবর পেয়ে সরকারি চাকরিজীবী সাখাওয়াত হোসেন লাভলু যাবেন লালমনিরহাটে। অনেক কষ্টে নাবিল পরিবহনের টিকিট পেয়েছেন। তবে দ্বিগুণ দামে কিনেছেন। লাভলু সারাবাংলাকে বলেন, আগে এই রুটে ভাড়া ছিল ৫৫০ টাকা। আজ ১১০০ টাকায় কিনতে হয়েছে অনেক কষ্টে। একই অবস্থা ওই রুটের অন্যান্য বাস কাউন্টারগুলোতেও।
বরকত কাউন্টারের ম্যানেজার আজমল উদ্দিন বলেন, যাত্রীদের চাপে ঈদের মতো অবস্থা তৈরি হয়েছে। আরও ঝামেলায় পড়েছি অর্ধেক সিট বিক্রির কারণে। একটা যাত্রী বেশি তুললে সার্জেন্ট গাড়ি আটকে দেয়। সেজন্য সরকারি নির্দেশ মেনে চলছি।
গাবতলী পুলিশ ফাঁড়ির এসআই আব্দুল আউয়াল বলেন, আগে একটি গাড়িতে ৫০টি সিট বিক্রি হত। সেখানে এখন ২৫টি সিট বিক্রি হচ্ছে। এজন্য এমনিতেই টিকিটের একটা সংকট ছিল। তার ওপর বাড়তি যাত্রীর চাপ। সব মিলিয়ে এই সংকট মহাসংকটে পরিণত হয়েছে।
যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে কমলাপুর রেলস্টেশনেও। ট্রেনে যাত্রীদের গাদাগাদি করে উঠতে দেখা গেছে। নারী, শিশু, বৃদ্ধসহ সকলেই ছুটছেন বাড়ির দিকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে চাকরি করেন রাশেদুল ইসলাম। তিনি বলেন, সরকার এক সপ্তাহের লকডাউন ঘোষণা করতে যাচ্ছে। এই লকডাউন আরও বাড়তে পারে। লকডাউন কবে শেষ হবে তাও জানি না। যেভাবে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে পরিস্থিতি ভালো ঠেকছে না। সবাইকে সতর্ক রাখতেই আগেভাগেই পরিবারকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাচ্ছি।
অসংখ্য যাত্রী দেখা গেছে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও। সন্ধ্যার দিকে বেশির ভাগ লঞ্চ ছেড়ে যায় সদরঘাট থেকে। কিন্তু তার আগেই যাত্রীরা সদরঘাটের দিকে ছুটে চলেছেন। সদরঘাটমুখী যাত্রীদের ঢল এতটাই যে, গুলিস্তান থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পর্যন্ত যানজট দেখা দিয়েছে। ফলে বাস থেকে নেমে অনেকে হেঁটেই সদরঘাটের দিকে ছুটছেন।
মহাখালী বাস টার্মিনালেও যাত্রীদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে। এই টার্মিনাল থেকে মূলত, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, মৌলভীবাজার ও সিলেটে যায় যাত্রীরা। সাধারণত শনিবার এই টার্মিনালে যাওয়া যাত্রীর সংখ্যা কম থাকে। ঢাকায় আসার যাত্রীই বেশি থাকে। তবে আজ উল্টো, অসংখ্য যাত্রী বাড়ির দিকে ছুটছেন।
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা যাবেন বাবুল আক্তার। তিনি বলেন, এত যাত্রী এর আগে কোনো শনিবারই দেখিনি। আজ যারা যাচ্ছেন তাদের বেশিরভাগই লকডাউন ঘোষণা পেয়ে যাচ্ছেন। টিকেট পাওয়া যাচ্ছে, তবে দাম দ্বিগুণ। তবুও যেতে হবে তাই যাচ্ছি।
সিলেটগামী এনা পরিবহনের হেলপার মুক্তার হোসেন বলেন, শনিবার সাধারণত এত যাত্রী থাকে না। আজ যাত্রী চাপ অনেক বেশি। সরকার নাকি লকডাউন ঘোষণা করেছে তাই সবাই বাড়ির দিকে ছুটছে।