বইমেলার স্বাধীনতা বোর্ডে অশালীনতা— কেন এই বিকৃতি?
৪ এপ্রিল ২০২১ ১১:৩৩
ঢাকা: বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর থিম নিয়ে ১৮ মার্চ থেকে শুরু হয়েছে এবারের অমর একুশে বইমেলা। বিশেষ আয়োজন হিসেবে এবারের বইমেলা চত্বরে স্থাপন করা হয়েছে একটি বোর্ড, যার শিরোনাম দেওয়া হয়েছে ‘হে স্বাধীনতা‘, যাতে লেখা রয়েছে ‘লিখুন আপনার কথা’। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বইমেলায় আসা দর্শনার্থীরা কী ভাবছেন, সেই মতামত তুলে আনতেই সাদা রঙের গোলাকার বোর্ডটি বসানো হয়েছে। দেশ, স্বাধীনতা, তারুণ্য, অধিকার নিয়ে নানা কথাও থাকলেও দেখা গেছে, এই বোর্ডে অনেকেই অশালীন কথা লিখে রেখেছেন, লিখেছেন নানা অপ্রাসঙ্গিক ও কুরুচিপূর্ণ কথাবার্তা। শুধু তাই নয়, ভুল বানান, বাক্য গঠনে দুর্বলতাসহ নানা ভাষাগত সমস্যাও রয়েছে এই বোর্ডে লিখে রাখা কথাগুলোতে।
‘হে স্বাধীনতা’ বোর্ডটি নিয়ে এরই মধ্যে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সারাবাংলা। তাতে উঠে এসেছে এই বোর্ডে লিখে রাখা অপ্রাসঙ্গিক, অশ্লীল বিভিন্ন কথা। বোর্ডের একপাশে বড় বড় অক্ষরে লেখা— ‘মদ খা, মানুষ হ’; ‘আরেকপাশে লেখা ছিল ‘দিমু তোরে এমন গুতা, ছিঁড়ে যাইবো প্রেমের খেতা’। বোর্ডের ওপরে ‘হে স্বাধীনতা’ লেখাটির নিচেই কেউ একজন নিজের প্রেম নিবেদনের কথা লিখে রেখেছেন। একজন লিখেছেন— ‘বইমেলায় আসলে DU-তে চান্স পাওয় যাবে?’ একইসঙ্গে রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বহুল ব্যবহৃত ‘ট্রল’— ‘নোয়াখালী বিভাগ চাই’।
অমর একুশে বইমেলা কেবল বাঙালির অন্যতম আবেগই নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের জাতীয় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক পরিচয়। এই বইমেলা ঘিরে প্রতিবছর বের হয় হাজার হাজার বই। পাঠক, লেখক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী আর সুধীজনের ভিড়ে মুখর থাকে মেলাপ্রাঙ্গণ। ধরেই নেওয়া যায়— এখানে যারা আসেন, তারা সবাই কিছু না কিছু বই পড়েন। সাহিত্য, সংস্কৃতি আর উন্নত চিন্তা ধারণ করেন।
একটি চীনা প্রবাদ আছে— ‘একটি বই পড়া মানে হলো একটি সবুজ বাগানকে পকেটে নিয়ে ঘোরা।’ অর্থাৎ, বই যেন অক্সিজেনের মতো। অক্সিজেন যেমন মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে, বইও তেমনি আমাদের আত্মাকে বাঁচিয়ে রাখে, চিন্তাকে সতেজ রাখে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেই বইয়ের মিলনমেলা বইমেলায় স্থাপন করা বোর্ডে উঠে আসা এমন বিকৃত রুচির পরিচয় কেন? দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, জাতির জনককে নিয়ে বিভিন্ন কথা থাকলেও সেগুলোকে ছাপিয়ে অপ্রাসঙ্গিক, অশালীন উদ্ধৃতির অযোগ্য মন্তব্যগুলো কিভাবে স্থান পাচ্ছে এই বোর্ডে? যারা এগুলো লিখছেন, তাদের মনোজগতের এই বিকৃতির পেছনে কারণটিই বা কী?
সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ ও শিক্ষক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, মানুষের চিন্তার জগত অনেকটাই বদলে গেছে। ফলে বেড়েছে এসব বিকৃতি। আর এসবের পেছনে দায়ী আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, পরিবার, সমাজ, রাজনীতি, বিচারহীনতার সংস্কৃতি— এগুলোর সবই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা এখন ক্লাস-মুখস্ত-পরীক্ষায় আটকে গেছে। শ্রেণিকক্ষে লেখাপড়ার পাশাপাশি যে নৈতিকতাও শেখাতে হয়, তা যেন ভুলতে বসেছি আমরা। নৈতিক শিক্ষাদান থেকে শিক্ষকরা বিরত থাকায় সন্তানদের চরিত্র গঠন আর হচ্ছে না, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটুকুই কিছুটা অর্জন করছে তারা।
শিক্ষা ছাড়াও তারুণ্যের এই বিকৃত চিন্তা-ভাবনার জন্য পারিবারিক ও সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনকেও দায়ী করছেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, একসময় আমাদের সমাজে মুরব্বি প্রথা ছিল। ছেলেমেয়েরা শুধু পরিবারই নয়, মুরব্বিদের কথাও গুরুত্ব দিত। এখনকার সমাজের সীমাহীন দুর্নীতি ও অসৎ জীবনযাপনের ফলে নৈতিকতা পিছু হটেছে। অনুকরণীয় ব্যক্তি না থাকায় সমাজের শ্রদ্ধা-ভক্তির অভাব দেখা যাচ্ছে, যা মানুষকে দুর্বিনীত আচরণ করতে উৎসাহ দিচ্ছে। যেন জবাবদিহির কোনো জায়গাই নেই।
‘মা-বাবাও আর এসবকে গুরুত্ব দেন না। কোনো কোনো অভিভাবক আবার দুর্নীতি করে অর্থ উপার্জন করছেন। সেই দুর্নিতির অর্থেই হয়তো সন্তান বিলাসিতা করছে। এর ফলে সমাজে আর আগের মতো মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ দেখা যায় না। মা-বাবার কথা শুনতে হয় তাই শোনা, কিন্তু নৈতিক আর সামাজিক শিক্ষা নিতে চায় না কেউ। মা-বাবারাও সেই আদর্শ ধরে রাখতে ব্যর্থ হচ্ছেন অনেকসময়। একই অবস্থা শিক্ষকদের ক্ষেত্রেও। অনেকেই ব্যস্ত প্রাইভেট টিউশন নিয়ে। এভাবে তারা নৈতিকতা শেখাবেনই বা কখন। আবার আগে দেখা যেত ধর্মীয় শিক্ষায় নৈতিকতাকে প্রাধান্য দেওয়া হতো, যা আমরাও ছোটবেলায় শিখেছি। কিন্তু এখন দেখা যায়, সেই নৈতিক শিক্ষার পরিবর্তে রাজনৈতিক শিক্ষাই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে বদলে যাচ্ছে আচরণ,’— বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক।
তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থাকেও চলমান এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী মনে করছেন তিনি। বলেন, ‘তিন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা থাকাও সমস্যার কারণ। এর ফলে একেক জায়গায় একেক রকম শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। ফলে নৈতিক শিক্ষার কোনো আদর্শ মান বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
প্রযুক্তির নানা সুফল থাকলেও প্রযুক্তিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারাকে সমাজের চলমান অবক্ষয়ের কারণ মনে করেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বই পড়ার অভ্যাস কমে গেছে। ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়লেও একে সুস্থভাবে ব্যবহার করছেন না অনেকেই। বরং পর্নসহ নানা অসাধু কাজে এর ব্যবহার বেড়েছে। সেইসঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আমাদের চিন্তাভাবনার জগত নিয়ন্ত্রণ করছে অনেকটাই। এখানে যা ইচ্ছা তাই বলা যায় বা লিখে ফেলা যায়। সেই সুযোগে অনেকেই বিকৃতি ছড়াচ্ছেন। এর প্রভাব পড়ছে তরুণদের ওপর। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের এসব আচরণ বাইরেও করছেন। নারীর প্রতি অশ্রদ্ধা, অশালীন কথা বলা, ইঙ্গিত করা যেন তাদের কাছে কোনো অপরাধই নয়। আমাদের নৈতিকতার মান নেমে গেছে অনেকটাই, যেন কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। বইমেলায় যারা যাচ্ছে, তারাও হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘ব্যাটাগিরি’ দেখিয়ে অভ্যস্ত, যা এখন বাইরেও উগড়ে দিচ্ছে। তারা যে শুধু এসব নোংরা কথা লিখছে তাই নয়, এরাই সুযোগ পেলে নারীকে অসম্মান করছে, উত্ত্যক্ত করছে।
সার্বিক পরিস্থিতির পেছনে রাজনৈতিক সংস্কৃতিও দায়ী বলে অভিমত সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর পরে আর সেররকম জনদরদী রাজনীতিবিদ উঠে আসেনি। আগে নেতারা রাজনীতি করতেন মানুষের কল্যাণের জন্য, এখন করেন ক্ষমতার জন্য। সেইক্ষমতার লোভে তারা নৈতিকতা বিসর্জন দেন। এখন রাজনৈতিক প্রভাব বলয় তৈরির জন্য তারা ‘বড় ভাই’ সংস্কৃতি তৈরি করে অনুসারীদের বশে রাখতে তাদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন, অস্ত্র-মাদক তুলে দিচ্ছেন হাতে। ফলে তরুণ প্রজন্ম কিন্তু বিভ্রান্ত হচ্ছে, নৈতিকতার ছিঁটেফোঁটাও তাদের মধ্যে স্থান পাচ্ছে না। আবার দেখা গেছে, বিএনপির মতো দল বিকৃত ইতহাস শিখিয়েছে পাঠবইয়ে। এর ফলে প্রজন্মের একটি বড় অংশ ভুল ইতিহাস আর অশ্রদ্ধা শিখে বড় হয়েছে। তারাও তাই সুযোগ পেলেই অশ্রদ্ধা দেখায়।
তিনি আরও বলেন, অনেক দিন থেকেই দেখা যাচ্ছে, কিশোর গ্যাংয়ের উৎপত্তি হয়েছে। সমাজের উচ্চবিত্ত-নিম্নবিত্ত সব শ্রেণিতেই এসব গ্যাংয়ের সদস্য রয়েছে। উচ্চবিত্ত মা-বাবারা সন্তানের খোঁজখবর নিচ্ছে না। নিম্নবিত্তরা হয়তো সেই সুযোগ পাচ্ছেনই না। এসব শিশু-কিশোরদের দায়িত্ব নেওয়ার কথা ছিল সমাজের। সেখানে সমাজ ব্যর্থ হয়েছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেই, শিশুদের খেলার মাঠ নেই, বিদ্যালয় বা পাড়ায় পাড়ায় সাংস্কৃতিক চর্চার সুযোগ নেই। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা নোংরামি করছে, তাদের সাইবার আইনে ধরা হচ্ছে না, ধরা হচ্ছে এমন অনেককে যারা সরকার বা ক্ষমতাশালী কারও সমালোচনা করছে। নারী নির্যাতন, যৌন হয়রানি করলেও যারা প্রভাবশালী হলে পার পেয়ে যাচ্ছে। অথচ ধরার কথা ছিল যারা নোংরা কথা লিখে, তাদের; যারা বেপরোয়া আচরণ করে, তাদের। সব মিলিয়ে নতুন প্রজন্ম সুন্দর কিছু দেখে বেড়ে উঠতে পারছে না। ফলে তারা নিজেরা সুন্দর কিছু ভাবতে পারছে না, করতে পারছে না।
‘হে স্বাধীনতা’ বোর্ডে যেসব কথা উঠে এসেছে, তা দেখে আসলে আমি আর অবাক হই না, বিকৃতির এই ধারা আরও আগেই শুরু হয়েছিল, এটুকু দেখাই যেন বাকি ছিল— বলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম।
সুচিন্তক এই শিক্ষাবিদ বলেন, যেকোনো বীভৎস আচরণের জন্য আসলে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো একটি কারণকে দায়ী করা যায় না। সমাজের সব দিক মিলিয়েই আমরা এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছি যে সমাজের সেই অস্থিরতা ও বিকৃতির নিদর্শনই চোখে পড়ছে বইমেলার ‘হে স্বাধীনতা’ বোর্ডের কিছু কিছু লেখায়।
‘হে স্বাধীনতা’ বোর্ডে এসব অপ্রাসঙ্গিক ও অশালীন বক্তব্য উঠে আসা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মনোস্বাস্থ্যবিদ ড. হেলাল উদ্দীন আহমেদ সারাবাংলাকে বলেন, মানুষের এই আচরণ আসলে ধারণা ও জ্ঞানের বিকাশের জগতে বিকৃতির বহিঃপ্রকাশ। পরিবার থেকে শুরু করে সমাজ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান— সবাই আমাদের শিশুদের নৈতিক শিক্ষা দিতে ব্যর্থ। আর শৈশবেই যদি একজন মানুষকে নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত না করা যায়, তাহলে তাদের কাছ থেকে সুআচরণ আশা করা যায় না। এ কারণেই তারা ব্যক্তি পর্যায় থেকে শুরু করে সবখানে অবলীলায় এমন আচরণ করছে।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের এই সহযোগী অধ্যাপক বলেন, একটি উদাহরণ দিই। এই করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যে সবাইকে কিন্তু মাস্ক পরতে বলা হচ্ছে নিজের সুস্থতা, নিরাপত্তার জন্যই। অথচ সেই মাস্কও কিন্তু সবাইকে পরাতে হচ্ছে জোর করে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে। এসব আচরণ আসলে একই সূত্রে গাঁথা। আইন, নিয়ম, শৃঙ্খলা মানার বিষয়ে আমাদের সবার ভীষণ অনীহা রয়েছে। এই সবকিছুর প্রভাব তো সার্বিক পরিস্থিতিতে রয়েছেই।
‘শিশুরা শুধু পড়েই শেখে না, তারা দেখেও শেখে, শুনেও শেখে। তাই তারা বইতে হয়তো ভালো ভালো জিনিস পড়ছে, কিন্তু গ্রহণ করছে সেটিই, যা তার চারপাশে দেখছে। তার অভিজ্ঞতা বলছে— চারপাশের মানুষ কুৎসিত কথা বলছে, দুর্নীতি করছে, অশালীন আচরণ করছে। তার অভিজ্ঞতা বলছে— মানুষে-মানুষে শ্রদ্ধার সম্পর্ক নেই, ভালো কিছু করার মতো আগ্রহ-উদ্দীপনা কারও মধ্যে নেই। ফলে ধীরে ধীরে দুর্নীতি, কুরুচি, ভালো কাজের প্রতি অনীহা, মন্দ কাজ কিংবা অশালীনতার মতো উপাদানগুলো তার কাছে স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়। এতে শিশুদের নৈতিক শিক্ষণের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। আর তার প্রভাব পড়ে আচরণে, লেখায়, কথায়,’— বলেন ড. হেলাল।
ঠিক এখনকার এই সময়টিতে বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের প্রভাবও রয়েছে বলে মনে করছেন এই মনোবিদ। তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে অনেক পরিবারেই অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। এর ফলে অনেকেই মানসিকভাবে ‘স্ট্রেসে’ ভুগছেন। আমাদের আচরণে এই স্ট্রেসের প্রভাবও ব্যাপক। পারিবারিক ও অর্থনৈতিক সংকট মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়। আর এর প্রকাশ ঘটে তার চিন্তা, আচরণ ও আবেগের মাধ্যমে। মানসিক ভারসাম্যের অভাবেও কিন্তু মানুষ অনেক সময়ই অনৈতিক আচরণ করে থাকে।
চলমান বাস্তবতায় অর্থনৈতিক ও পারিবারিক সংকটের মুখোমুখি তো নারীরাও। সেই সংকটের মুখে তাদের আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ পুরুষদের মতো এত বেশি অশালীন হয় না কেন— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. হেলাল বলেন, নারী-পুরুষ সবার মধ্যেই এই সংকট থাকলেও নারীরা তুলনামূলকভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করেন বেশি। কারণ তারা জন্ম থেকেই আবেগ অবদমন করতে শেখেন। এই শিক্ষা তাদের সামাজিক আচরণে প্রভাব ফেলে। তাই তারা অপেক্ষাকৃত বেশি নিয়ন্ত্রিত আচরণ করেন। অন্যদিকে পুরুষদের মধ্যে একটি ‘ড্যাম কেয়ার’ ভাব দেখা যায়, যা মূলত ‘masculinity’ বা আধিপত্যবাদের বাহিঃপ্রকাশ। পুরুষ নিজেকে সমাজের সবার থেকে বড় মনে করে, যার ফলে অশালীন ও সমাজবিরোধী কাজে জড়াতে কুণ্ঠিত হয় না। অশালীন আচরণ, বাজে কথা লেখা বা বলার মাধ্যমে যেমন তাদের এই আচরণ ফুটে ওঠে, তেমনি ফুটে ওঠে নারীর প্রতি সহিংসতার মধ্যেও।
তরুণদের এই নৈতিক অধঃপতন থেকে উত্তরণের উপায় কী হতে পারে— জানতে চাইলে সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বলেন, সবার আগে প্রয়োজন সুশিক্ষা। শিক্ষাই পারে এগুলো থেকে মুক্তি দিতে। ইউরোপের দেশ নরওয়েতে যেমন দেখেছি, তেমনি পাশের দেশ শ্রীলংকাতেও দেখেছি তারা সমতাভিত্তিক উন্নত চরিত্রের সমাজ গঠনে শিক্ষাকে কীভাবে কাজে লাগাচ্ছে। সত্যিকার অর্থের সৃজনশীল শিক্ষা চালু করতে হবে যেখানে শিশুরা নৈতিকতা শিখবে, নিয়ম মেনে চলতে শিখবে, নারীকে সম্মান করতে শিখবে, ইন্টারনেটকে সুন্দর ও শিক্ষামূলক কাজে লাগাতে শিখবে; একইসঙ্গে শিখবে বৈষম্যহীন ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা। একইসঙ্গে পরিবার ও সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে, যেন তারা শিশুদের উন্নত নৈতিকতার শিক্ষাটা দিতে পারে, শিশুদের জন্য উন্নত নৈতিকতা চর্চার সুযোগটা করে দিতে পারে।
শিক্ষাকেই এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় মনে করছেন ডা. হেলাল উদ্দীনও। তিনি বলেন, এর থেকে মুক্তির জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিকল্প নেই। মূলত এসব শিক্ষার ব্যর্থতার কারণেই ধীরে ধীরে এই বিকৃতি গড়ে উঠেছে সমাজে, যার শিকার সবচেয়ে বেশি হয়েছে শিশু-কিশোররা। তাই শিশুদের শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনতে হবে, তাদের নীতি-নৈতিকতা, নিয়ম ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলতার শিক্ষা যুক্ত করতে হবে। ছোটবেলা থেকেই নিয়ম অনুসরণের শিক্ষা দিতে হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এবং পারিবারিক ও সামাজিকভাবেও।
তিনি আরও বলেন, এর পাশাপাশি শিশুদের সামনে উদাহরণ তৈরি করতে হবে। শিশুরা যদি উন্নত নৈতিকতার শিক্ষা পেয়ে থাকে, তাদের সামনে উন্নত নৈতিকতার চর্চার উদাহরণও রাখতে হবে বয়োজ্যেষ্ঠদের, যেন সেটিকেই আদর্শ ধরে নিয়ে তারা নিজেদের গড়ে তুলতে পারে।
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর
অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম অমর একুশে বইমেলা-২০২১ জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট মুজিব জন্মশতবর্ষ হে স্বাধীনতা