।। জাকিয়া আহমেদ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট ।।
ঢাকা: দেশে যক্ষ্মা চিকিৎসার ক্ষেত্রে সাফল্য এলেও ডায়াগনসিস সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা বা এমডিআর টিবি নিয়ন্ত্রণ এখনও বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। আর এই রোগ শনাক্তকরণের আধুনিক যন্ত্র ( জিন এক্সপার্ট) রয়েছে মাত্র ১৯৩ টি। অথচ প্রতিটি উপজেলায় একটি করে এই মেশিন দরকার-বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, দেশে প্রতি বছর প্রতি লাখে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছে ২২১ জন, মৃত্যু হচ্ছে ৪০ জনের। তাই যক্ষ্মা চিকিৎসায় সচেতনতার পাশাপাশি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি স্থাপন জরুরি।
শনিবার (২৪ মার্চ) আন্তর্জাতিক বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস। এবারে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, ‘নেতৃত্ব চাই যক্ষ্মা নির্মূলে, ইতিহাস গড়ি সবাই মিলে।’
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিশু যক্ষ্মা শনাক্তকরণে জটিলতা, নগরে যক্ষ্মার প্রকোপ বৃদ্ধি, আধুনিক ডায়াগনসিসের ক্ষেত্রে জিনএক্সপার্ট মেশিনের স্বল্পতা, পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে জনবল সঙ্কট, বেসরকারি পর্যায়ে কম সম্পৃক্ততা, শনাক্তকরণকে বাধ্যতামূলক না করা- এই বিষয়গুলো নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির (এনটিপি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এনটিপির মাধ্যমে দেশে ২ লাখ ৪৪ হাজার ২০১ জন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয়েছে ও চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ১৫ বছরের কম বয়সী যক্ষ্মারোগী শনাক্ত হয়েছে ১০ হাজার ১৮৯ জন। দেশে এখন এক্সটেনসিভলি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট রোগীর সংখ্যা ১২ জন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেব মতে, প্রতিবছর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে বছরে ৬৬ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এখনও এ ধরনের রোগীদের আনুমানিক ৮০শতাংশই শনাক্তের বাইরে থাকছেন। আর সব ধরনের যক্ষ্মায় চিকিৎসার বাইরে থাকছেন ৩৩ শতাংশ রোগী। যদিও ফুসফুসের যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীদের ৯৫ শতাংশই চিকিৎসায় সফলতা পেয়েছেন।
জাতীয় বক্ষব্যাধি ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের রেসপারেটরি মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ও হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ডা. বশীর আহমদ সারাবাংলাকে বলেন, এই হাসপাতালের মোট আসন সংখ্যার মধ্যে ৩৯০ টি আসন যক্ষা রোগীদের জন্য নির্ধারিত। আর এই নির্ধারিত বেড সবসময় পরিপূর্ণ থাকে। কখনও কখনও বেডের অভাবে হাসপাতালের জরুরি বিভাগ এবং বর্হিবিভাগ থেকে রোগীদের ফেরত দিতেও বাধ্য হন তারা।
ডা. বশীর আহমদ বলেন, বর্তমানে গ্রামের চেয়ে শহরে যক্ষ্মা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, এখন মানুষ গ্রাম ছেড়ে শহরে আসছে। শহরে জনসংখ্যা বেশি থাকার কারণে এখানে যক্ষ্মার ঝুঁকি এবং রোগীর সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে।
ঘনবসতি-যক্ষ্মার রোগী বাড়ার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে ডা. বশীর আহমদ বলেন, যক্ষ্মা ছড়ায় বাতাসের মাধ্যমে, হাঁচি-কাশির মাধ্যমে। যক্ষ্মা আক্রান্ত রোগী যখন কোথাও তার জীবানুযুক্ত কফ ফেলছেন, সেই কফের জীবানু বাতাসের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, আর সেই বাতাস অক্সিজেনের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে সুস্থ মানুষের শরীরে। যার কারণে শহরে যক্ষ্মার হার এখন অত্যন্ত বেশি বলেও জানান তিনি।
এদিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যক্ষ্মার প্রকোপ এবং ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মার (এমডিআর টিবি) প্রকোপ বেশি এমন দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম রয়েছে বলে জানিয়েছেন যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির চিকিৎসা কর্মকর্তা নাজিস আরেফিন সাকি। তিনি বলেন, যক্ষ্মা এখনো জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
তিনি জানান, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ৬৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে যক্ষ্মায় আর নতুন করে যক্ষ্মার জীবানুতে আক্রান্ত হয়েছে ৩ লাখ ৬০ হাজার মানুষ।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের যক্ষ্মা নয়ন্ত্রণ কর্মসূচির জ্যেষ্ঠ সেক্টর স্পেশালিস্ট ডা. মো আবুল খায়ের বাশার বলেন, এমডিআর রোগী শনাক্তকরণের ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হচ্ছে যে সংখ্যক জিনএক্সপার্ট মেশিন থাকার কথা, তা নেই। তাছাড়া সচেতনতার অভাব ও চিকিৎসাব্যয় বেশি বলে অনেকের পক্ষে নিয়মিত ওষুধ খাওয়া সম্ভব হয় না।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক অধ্যাপক ডা. সামিউল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশ ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে যক্ষ্মা নির্ণয় ও নিরাময়ের ক্ষেত্রে যে সাফল্য অর্জন করেছে, তা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচিরই সাফল্য। এই কর্মসূচির মাধ্যমে রোগনির্ণয়ের হার প্রতি এক লাখ জনসংখ্যায় ৭৭জন এবং আরোগ্যের হার ৯৫ শতাংশ। এতো সফলতার পরেও বিশ্বে যক্ষ্মার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ৩০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম বলেও জানান তিনি।
সারাবাংলা/জেএ/এমএস