সপ্তাহের ব্যবধানে সংক্রমণ বেড়েছে ২৬%, মৃত্যু ৩০%
১০ এপ্রিল ২০২১ ২০:২১
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অব্যাহত আছে। নতুন সংক্রমণ শনাক্তের পাশাপাশি করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর পরিমাণও দিন দিন বাড়ছে। তাতে করে গত সপ্তাহ দুয়েক হলো প্রায় প্রতিদিনই ভাঙছে করোনায় নতুন সংক্রমণ শনাক্ত ও করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর রেকর্ড। তাতে সপ্তাহের হিসেবে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যাও ক্রমেই ছাড়িয়ে যাচ্ছে আগের সপ্তাহগুলোকে। সবশেষ দেশে করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ৫৭তম সপ্তাহে এসে নমুনা পরীক্ষা থেকে শুরু করে সংক্রমণ ও মৃত্যু— সবই বেড়েছে আগের যেকোনো সপ্তাহের তুলনায়।
এর আগের সপ্তাহ, অর্থাৎ ৫৬তম সপ্তাহেই করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পরিমাণ ও করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু ছাড়িয়েছিল সব রেকর্ড। ৫৭ সপ্তাহে এসে দেখা যাচ্ছে, আগের সপ্তাহের তুলনায় সংক্রমণ বেড়েছে আরও এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। একই সময়ে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। একই সময়ের ব্যবধানে নমুনা পরীক্ষাও বেড়েছে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ।
আরও পড়ুন-
- একদিন পর ফের করোনায় মৃত্যুর রেকর্ড
- সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে অন্তত ২ সপ্তাহের লকডাউন চান বিশেষজ্ঞরা
- বাজার ও গণপরিবহন থেকে করোনার সংক্রমণ বেড়েছে ৬১ শতাংশ
দেশে প্রথম নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে দেশে প্রথম মৃত্যুবরণের ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। ধীরে ধীরে সংক্রমণ ও মৃত্যু— দুই-ই বাড়তে থাকে। নমুনা পরীক্ষার পরিমাণও শুরুর দিকে কিছুটা কম থাকলেও একসময় বাড়তে থাকে সেটিও। সেপ্টেম্বরে গিয়ে কমতে শুরু করে সংক্রমণ। এরপর নভেম্বর মাসে সংক্রমণে ফের কিছুটা ঊর্ধ্বগতি দেখা গেলেও ডিসেম্বরে গিয়ে তা কমতে শুরু করে। একপর্যায়ে সংক্রমণের হারও নেমে আসে ২ শতাংশে। তবে মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে যে সংক্রমণ-মৃত্যু বাড়তে শুরু করেছে, তা এর আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক অনেক বেশি। এর মধ্যেও সবশেষ দুই সপ্তাহে সংক্রমণ ও মৃত্যু ছাড়িয়েছে আগের যেকোনো সময়কে। একইভাবে শেষ সপ্তাহের সংক্রমণ ও মৃত্যুও আগের সপ্তাহের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা শেষ ৩ সপ্তাহে
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্তের পর আজ ১০ এপ্রিল শেষ হওয়া সবশেষ ৫৭তম সপ্তাহেই সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা হয়েছে। ৪ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল পর্যন্ত এই সপ্তাহে দেশে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে দুই লাখ ২০ হাজার ৮২৮টি।
এর আগের সপ্তাহে, অর্থাৎ ২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৬তম সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল এক লাখ ৮৫ হাজার ৯৬৭টি, যা এখন পর্যন্ত দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। এর তুলনায় পরবর্তী সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষা হয়েছে প্রায় ২০ শতাংশ বেশি।
নমুনা পরীক্ষার দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ৫৫তম সপ্তাহ (২১ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ)। এ সপ্তাহে দেশে করোনাভাইরাসের নমুনা পরীক্ষা হয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৬৮৩টি। এছাড়া মার্চের আগের তিন সপ্তাহেও নমুনা পরীক্ষা হয়েছে লক্ষাধিক।
আগের সপ্তাহের চেয়েও সংক্রমণ ২৬% বেশি
নমুনা পরীক্ষার পাশাপাশি দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণও ব্যাপকভাবে বেড়েছে শেষ দুই সপ্তাহে। সবশেষ ৫৭তম সপ্তাহে দেশে ৪৮ হাজার ৬৬০ জনের মধ্যে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়।
এর আগে সাপ্তাহিক হিসেবে সর্বোচ্চ সংক্রমণ দেখা গেছে ৫৬তম সপ্তাহে (২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল)। ওই সপ্তাহে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল ৩৮ হাজার ৪৭১ জনের মাঝে। সে হিসাবে ৫৬তম সপ্তাহের তুলনাতেও ৫৭তম সপ্তাহে সংক্রমণ বেড়েছে ২৬ শতাংশের বেশি।
সংক্রমণের দিক থেকে তৃতীয় স্থানে রয়েছে অবশ্য ১৭তম সপ্তাহ। ২৮ জুন থেকে ৪ জুলাই পর্যন্ত ওই সপ্তাহে দেশে ২৫ হাজার ৭০১ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল।
সপ্তাহের ব্যবধানে মৃত্যু বেড়েছে ৩০%
দেশে করোনা সংক্রমণ শনাক্তের পর গত বছরের জুনের শেষ ভাগ থেকে শুরু করে জুলাইয়ের প্রথম ভাগ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যুর পরিমাণ ছিল সর্বোচ্চ। এরপর তা কমতে থাকলেও মার্চের শেষের দিকে এসে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সবশেষ ৫৭তম সপ্তাহে এসে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ৪৪৮ জন, যা এর আগের যেকোনো সপ্তাহের তুলনায় অনেক বেশি।
এর আগে, ৫৬তম সপ্তাহ অর্থাৎ ২৮ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিল পর্যন্ত সময়ে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা যান ৩৪৪ জন, যা একসপ্তাহে মৃত্যুর পরিমাণে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। সে হিসাবে ৫৭তম সপ্তাহে এসে আগের সপ্তাহের তুলনায় মৃত্যু বেড়েছে ৩০ শতাংশেরও বেশি।
এক সপ্তাহে সর্বোচ্চ মৃত্যুর পরিসংখ্যানে তৃতীয় স্থানে রয়েছে ১৮তম সপ্তাহ। ৫ জুলাই থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ওই সপ্তাহে তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩০৮ জন মারা গিয়েছিলেন করোনা সংক্রমণ নিয়ে।
পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ?
স্বাস্থ্য অধিদফতরের অধীন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, স্বাস্থ্যবিধি না মানলে সংক্রমণ বাড়বেই। আর তাই সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। সংক্রমণের উৎস ও উৎপত্তিস্থল বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে।
ডা. মোশতাক আরও বলেন, করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যায় যে ঊর্ধ্বগতি দেখা যাচ্ছে, তা আশঙ্কাজনক। সংক্রমণ বাড়লে মৃত্যুও বাড়বে। তবে সংক্রমণ তুলনামূলকভাবে বেশি বাড়লে মৃত্যুহার কমে যেতে পারে। তাতে স্বস্তি পাওয়ার কিছু নেই। কেননা মৃত্যুহার কমলেও মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু বাড়বে। ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ জরুরি। বর্তমানে সরকার একসপ্তাহের জন্য কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। এটি কতটুকু কার্যকর হলো, সেটি জানতে হলে আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে। ওই সময়ে গিয়ে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসতে শুরু করলে বোঝা যাবে যে এসব বিধিনিষেধ কাজ করেছে। নেইলে বিকল্প ভাবতে হবে সরকারকে।
দেশে কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি ও ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, দেশে সংক্রমণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হলো মানুষের মাস্ক পরাসহ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ নিশ্চিত করা। নইলে সংক্রমণের এই ঊর্ধ্বগতি ঠেকানো সম্ভব হবে না। আর তাতে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। জনসমাগম বন্ধ করা না গেলে এবং স্বাস্থ্যবিধি অবজ্ঞা করা হলে নিশ্চিতভাবে আমাদের ভবিষ্যৎ হবে ভয়াবহ।
ডা. নজরুল আরও বলেন, পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য শুনছি ও মিডিয়ায় বলা হচ্ছে যে সরকার দ্বিতীয় দফায় লকডাউন ঘোষণা করেছে। কিন্তু লকডাউন মানে কী, সেটা তো কেউ বুঝতে পারছে না। এখন এক সপ্তাহ কঠোর লকডাউনের বিষয়ে বলছেন মন্ত্রীরা। তার রূপরেখা স্পষ্ট করতে হবে। সাহিত্য বা কবিতার ভাষায় কারিগরি কাজ হয় না। এক্ষেত্রে মানুষের কাছে সঠিক বার্তাটি পৌঁছাতে হবে যে সে কী করতে পারবে ও কী করতে পারবে না। তাদের স্বাস্থ্যবিধির গুরুত্ব বোঝাতেই হবে। আর সবকিছু পালন হচ্ছে কি না, সেটির পর্যবেক্ষণও জোরালো করতে হবে। একটি বিষয় সবাইকে স্পষ্ট করে বুঝতে হবে— কেবল মাস্ক পরিধান ও স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের মাধ্যমেই অন্তত ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রে ব্যক্তি পর্যায়ে সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. নুসরাত সুলতানা লিমা সারাবাংলাকে বলেন, দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে একমাত্র করণীয় হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। বিশেষ করে মাস্ক পরার অভ্যাসটা চালু রাখতে হবে। মাস্ক পরে বাইরে যাওয়ার পর হাঁচি-কাশি দিলেও সেই মাস্ক তার কাছ থেকে ভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা কমিয়ে দেবে। একইসঙ্গে অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করলে তার কাছ থেকে যেকোনোভাবেই ভাইরাস ছড়ানোর সম্ভাবনা কমবে।
সারাবাংলা/এসবি/টিআর