পরিস্থিতি মেনে বর্ষবরণে মঙ্গলের আহ্বান চৈত্রসংক্রান্তিতেই
১২ এপ্রিল ২০২১ ২১:১০
ঢাকা: করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে এমনিতেই গণজমায়েতে রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এর মধ্যে ১৪ এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাচ্ছে আরও কঠোর বিধিনিষেধ, যার আওতায় অফিস ও গণপরিবহন সবই বন্ধ থাকবে। সেই ১৪ এপ্রিলই আবার বাংলা নববর্ষের প্রথম দিন, পুরনো বছরের জীর্ণতা কাটিয়ে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মেতে ওঠার সার্বজনীন উৎসব। করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে গত বছরও আপামর বাঙালি এই উৎসব কেটেছে ঘরবন্দি হয়ে। এ বছরও পরিস্থিতি অনুকূলে নয়। তারপরও সব ধরনের কার্যক্রম চলমান থাকায় সীমিত আকারে বৈশাখ বরণের আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায়।
বর্ষবরণের বিভিন্ন অনুষঙ্গের অন্যতম মঙ্গল শোভাযাত্রা। করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি মাথায় রেখেই সীমিত পরিসরে সেই মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হবে এবার। আর প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ এই শোভাযাত্রা করা হলেও এ বছর ওই দিন থেকেই সরকার ‘সর্বাত্মক লকডাউন’ পালনের ঘোষণা দিয়েছে। ফলে আগের দিন, অর্থাৎ আগামীকাল ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তির দিনে এ বছর এই মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন রাখছেন সংশ্লিষ্টরা। এ বছর এই শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য রাখা হয়েছে ‘কাল ভয়ংকরের বেশে, এবার ওই আসে সুন্দর’।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটে গিয়ে দেখা গেল, মঙ্গল শোভাযাত্রার পূর্ণ প্রস্তুতি চলছে। তবে অন্যান্য বছরগুলোতে যেমন জমজমাট আয়োজন দেখা যায়, এবারের চিত্রটি ঠিক তেমন নয়। মুখোশ-মোটিফ সবই বানানো হচ্ছে, তবে অল্প পরিমাণে। আয়োজকরা জানালেন, একশ জনের অংশগ্রহণে এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা করবেন তারা। আর এই শোভাযাত্রাটি এবার ক্যাম্পাসের বাইরে যাবে না। পরিস্থিতি বিবেচনায় চারুকলা ইনস্টিটিউটের ভেতরেও তারা প্রতীকী হিসেবে এই শোভাযাত্রা করতে পারেন।
অনুষদের ডিন নিসার হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে নিয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা করার সুযোগ নেই। তাই একশ জনের জন্য মুখোশ, মাস্ক, মোটিফ ইত্যাদি তৈরি করা হচ্ছে। এই একশ জন ক্যাম্পাসের বাইরে যাবেন না। তারা চারুকলার মধ্যেই এগুলো নিয়ে দূরত্ব বজায় রেখে প্রতীকী শোভাযাত্রা উদযাপন করবেন।
করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিতে গত বছর পহেলা বৈশাখের আগে-পরের দীর্ঘ সময় ধরে দেশে ছিল ‘সাধারণ ছুটি’। ফলে পহেলা বৈশাখের কোনো আয়োজনই হয়নি সে বছর। এ বছর বর্তমানে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ চললেও এখন পর্যন্ত সীমিত পরিসরে সব কার্যক্রম চলছে। এ ছাড়াও আরও তিনটি বিশেষ ক্ষণকে স্মরণ করার জন্যই সীমিত পরিসরে হলেও মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন করা হচ্ছে বলে জানালেন নিসার হোসেন।
তিনি বলেন, এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ বছরে পদার্পণের বছর। শুধু তাই নয়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী আমরা পালন করেছি এ বছর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানে জন্মশতবর্ষের আয়োজনও উদযাপন করা হচ্ছে। ফলে এই বছরটি একটি বিশেষ বছর। এসব কারণেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে স্বল্প পরিসরে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
সীমিত পরিসরে হলেও বরাবরের মতো চারুকলা প্রাঙ্গণে বর্তমান ও সাবেক কিছু শিক্ষার্থীরা ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রস্তুতিতে। মুখোশ বানানোর কাজ বলতে গেলে শেষ। কেউ মুখোশ, কেউ অন্য মোটিফ আঁকতে তুলির শেষ আঁচড়টি বুলাচ্ছেন। এ বছর নতুন উপকরণ হিসেবে যোগ হয়েছে প্রোটেক্টিভ ফেস শিল্ড, সেটিও তৈরি করা হচ্ছে বৈশাখের থিমে। অন্যদিকে চারুকলার বাইরের দেয়ালে ফুটপাথে দূরত্ব বজায় রেখে ছবি আঁকতেও দেখা গেল কয়েকজন শিক্ষার্থীকে।
এবারের পহেলা বৈশাখের প্রতিপাদ্য, ‘কাল ভয়ংকরের বেশে, এবার ওই আসে সুন্দর’; বিদ্রোহী ও জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি গান থেকে নেওয়া হয়েছে এই চরণটি— জানালেন চারুকলা অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, “প্রতিবছরই মঙ্গল শোভাযাত্রার একটি প্রতিপাদ্য থাকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের ড. আজিজুল হক স্যার অন্যদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নির্ধারণ করে দেন। এবার সার্বিক পরস্থিতি বিবেচনায় জাতীয় কবির ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’ গানের থেকে দু’টো লাইন নেওয়া হয়েছে।”
রবিউল ইসলাম আরও বলেন, ‘বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে গত বছর মঙ্গল শোভাযাত্রা করা সম্ভব হয়নি। এবার করোনা পরিস্থিতি কিছুটা ভালোর দিকে যাওয়ায় সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে মঙ্গল শোভাযাত্রার পরিকল্পনা করা হয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ করে করোনা পরিস্থিতির অবনতি ঘটনায় এখন প্রতীকী আকারে ছোট পরিসরে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা হবে। অন্যান্যবারের মতো সাধারণ মানুষের উপস্থিতি থাকবে না।‘ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার আশপাশে থাকা শিক্ষক এবং বর্তমান ও সাবেক শিক্ষার্থীদের নিয়ে অল্প পরিসরের এই আয়োজন হচ্ছে বলে জানান তিনি।
১৯৮৯ সালে প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রার অংশ ছিলেন ১৯৮৭-৮৮ সেশনের চারুকলার শিক্ষার্থী আমিনুল হাসান। এ বছরও তিনি এসেছেন মঙ্গল শোভযাত্রার অংশ হতে। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, প্রথমবার মঙ্গল শোভাযাত্রার সঙ্গে আমরা যারা যুক্ত ছিলাম, আমরা সবাই মিলে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা গবেষণা ও প্রসার কেন্দ্র’ গঠন করেছি। এর মাধ্যমে সারাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে তো বটেই, বিশ্বের নানা স্থানে থাকা বাঙালিদের মধ্যে মঙ্গল শোভাযাত্রা আয়োজন ছড়িয়ে দিতে কাজ করছি আমরা। শুরু থেকেই এই শোভাযাত্রায় লোকজ মোটিফ, বাংলার ঐতিহ্যবাহী পুতুল ইত্যাদি নিয়ে কাজ করা হয়। এর ধারাবাহিকতা আজও বজায় আছে।
মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা চারুকলার সাবেক ও বর্তমান শিক্ষার্থীরা বলছেন, বাংলার লোকজ সংস্কৃতি তুলে ধরে মঙ্গলের আবাহন থেকেই এই আয়োজনের সূচনা। কিন্তু বরাবরই একটি গোষ্ঠী এই আয়োজনকে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করার চেষ্টা করেছে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে চারুকলা ডিন নিসার হোসেন বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য। পাকিস্তানের সাম্প্রদায়িক সরকার যেমন বাংলা সংস্কৃতিকে থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে বারবার, তেমনি এখনো একটি শ্রেণি সেই চেষ্টা করছে। এরা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনৈতিক উদেশ্য হাসিলের চেষ্টা করছে। এর মানে এই না যে বাংলাদেশের সব মানুষ সাম্প্রদায়িক হয়ে গিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী একটি শক্তি পাকিস্তানের সমান্তরাল রাষ্ট্র গঠনের আশায় এসব প্রচারণা চালায়।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আশাবাদও দেখছেন চারুকলার এই শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘আমি আশার আলোই দেখতে পাচ্ছি। সাম্প্রদায়িক শক্তি একসময় আধুনিক যেসব জীবনব্যবস্থার বিরুদ্ধেই ফতোয়া দিত, আজ তারা সেসবে অভ্যস্ত হয়েছে। আজ যারা মঙ্গল শোভাযাত্রার মতো নিরীহ বিষয়ে ধর্ম জড়িয়ে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, আমার আশা— তারাই একসময় এটি সাদরে গ্রহণ করবে।’
ছবি: সুমিত আহমেদ
সারাবাংলা/আরএফ/টিআর