ভূগর্ভে ফেলা হচ্ছে বিষাক্ত বর্জ্য, ব্যবহার অযোগ্য নলকূপের পানিও!
১৩ এপ্রিল ২০২১ ০৯:০২
সিরাজগঞ্জ: জেলার বেলকুচি উপজেলার মিল ও সুতা রঙ করা কারখানার বিষাক্ত কেমিক্যালের বর্জ্য শোধন না করেই পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে ফেলা হচ্ছে। ফলে উপজেলার তাঁতশিল্প এলাকার আশপাশের প্রায় সব নলকূপের পানি ব্যবহার ও পানের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
এছাড়া এ বর্জ্য খাল-বিল ও জলাশয়ে ফেলার কারণে ঝাঁঝাঁলো দুর্গন্ধে পরিবেশ দূষিত হয়ে আশপাশের বাড়িঘর মানুষ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পানি পান ও ব্যবহার করে অনেকেই পেটের পীড়া ও নানা ধরণের চর্মরোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এ থেকে মুক্তি পেতে অনেকে বোতলজাত ও সাপ্লাইয়ের পানি পান ও ব্যবহার করছেন।
বেলকুচি উপজেলার ভাঙ্গাবাড়ি ইউনিয়নের তামাই নতুনপাড়া গ্রামের হোসেন আলী, ইসমাইল হোসেন, জুলমত প্রমাণিক, আপন দাস, মানিক হোসেন জানান, বেলকুচি উপজেলার পৌর আবাসিক এলাকা ও আশপাশের ইউনিয়নগুলিতে সমিতিভুক্ত ১৩টিসহ ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত ৩৫টি সুতা প্রসেস মিল ও অর্ধশতাধিক সুতা ফিরোজা রঙ করার কারখানা রয়েছে। এরমধ্যে শাহপুর, বোল্ডার বাজার, ক্ষিদ্রমাটিয়া, কামারপাড়া, চালা, মুকন্দগাতি, তামাই, শেরনগর, শ্যামগাতী, রওড়া ও মবুপুর এলাকায় বেশি রয়েছে।
এসব কারখানা ও মিলে সুতা রঙ ও প্রসেসের কাজে প্রতিদিন দেড় থেকে ২ টন পরিমান বিষাক্ত রাসায়নিক কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। এসব বিষাক্ত রাসায়নিক কেমিক্যাল দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে কস্টিক, নাইট্রিক, সোডা, খার, ফিটকেরি, তুত, পটাশ, ব্লিচিং ও নেছাবল ওয়েল। রাসায়নিক কেমিক্যালের প্রত্যেকটিই মানব দেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর পদার্থ।
এসব রাসায়নিক পদার্থ মিশ্রিত পানি শোধন না করেই প্রসেস মিল মালিকরা পাম্পের সাহায্যে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে ও খাল বিল জলাশয়ে ফেলছে। ফলে এ পানি ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে মিশে যাচ্ছে। একারণে নলকূপের পানি পান ও ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এখন এলাকায় নলকূপের পানি কালচে সাবানের ফেনার মত হয়ে বের হয়। এ পানি পান করলে পেটের পীড়া হয়। রান্না করলে ভাত তরকারি কালো ও হলুদ বর্ণ হয়। গোসল করলে শরীরে ঘামাচির মত গোটা ওঠে, চুলকানি হয়।
স্থানীয়রা আরও জানায়, এলাকার অধিকাংশ মানুষ এখন আর নলকূপের পানি পান ও ব্যবহার করে না। অনেকে নলকূপ বন্ধ করে দিয়েছে। তারা এখন পাইপলাইনের সাহায্যে সরবরাহকৃত অথবা বোতলজাত পানি কিনে পান করে।
গ্রামের বিদ্যুৎ মিস্ত্রী ইসমাইল হোসেন জানান, তামাই নতুনপাড়া আবাসিক এলাকায় অবস্থিত মেসার্স মুন্সী ব্রাদার্স মার্চরাইজ অ্যান্ড প্রসেস মিলসের কেমিক্যাল মিশ্রিত বর্জ্য পানি গোপনে ঘরের মধ্যে স্থাপিত বিদ্যুৎ চালিত পাম্প দিয়ে ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে ফেলা হয়। তিনি বিষয়টি ওই প্রসেস মিলে বিদ্যুতের কাজ করতে গিয়ে দেখেছেন। শুধু এ কারখানাই নয়, এলাকার প্রায় সব কারখানাই এ কাজ করে বলেও জানান তিনি।
তামাই গ্রামের ফিরোজ আহমেদ বলেন, ‘নলকূপের পানি খাওয়া ও গোসল করা ছেড়ে দিয়েছি। একটু বৃষ্টি হলে এই প্রসেস মিলের বর্জ্যের দুর্গন্ধে এলাকায় থাকা যায় না। এ সব কারখানায় নিয়ম অনুযায়ী আধুনিক বর্জ্য শোধনাগার থাকার কথা থাকলেও তা নেই। তারা মানবদেহে ক্ষতিকর কেমিক্যালের বর্জ্য শোধন না করেই সরাসরি খাল বিল জলাশয় ও ভূগর্ভস্থ পানির স্তরে ফেলছে।’
সিরাজগঞ্জ স্বার্থরক্ষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক জহুরুল হক রাজা বলেন, ‘সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে এই শিল্পের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করতে হবে। তাঁতশিল্প একটি সম্ভাবনাময় শিল্প। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে হলে এখনই সময় এসেছে পরিকল্পনা করবার। এক্ষেত্রে গুরুত্ব সহকারে সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে এগিয়ে আসতে হবে।’
মেসার্স মুন্সী ব্রাদার্স মার্চরাইজ অ্যান্ড প্রসেস মিলসের মালিক শওকত মুন্সী বলেন, ‘আমরা বর্জ্য মাটির নিচে দেই না। নিজেদের খালের মধ্যে ফেলি। এভাবেও আমরা বর্জ্য ফেলতে চাই না। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের পক্ষ হতে উদ্যোগ নেওয়া হলে আমরাও সহায়তা করব।’
বেলকুচি প্রসেস মিল মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল মজিদ জানান, সব প্রসেস মিলকে এক স্থানে নিয়ে একটি আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট তৈরির প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া আছে। এটি হলে এ সমস্যার সমাধান হবে।
বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আনিছুর রহমান বলেন, ‘যেহেতু এ এলাকাটি তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ এলাকা সেহেতু এখানে অনেকগুলি প্রসেস মিল ও সুতা রঙ করার কারখানা গড়ে উঠেছে। কিন্তু এর সুষ্ঠু বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।’ দ্রুত সময়ের মধ্যে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও আশ্বাস দেন তিনি।
সারাবাংলা/এমও