বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটে কাটা পড়ছে যাত্রীর পকেট
১৬ এপ্রিল ২০২১ ২২:৩৬
ঢাকা: নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নিতে ‘কঠোর লকডাউন’ চালু হওয়ায় ১৪ এপ্রিল থেকে এক সপ্তাহের জন্য দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। তবে দাবির মুখে এ সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে ‘বিশেষ ফ্লাইট’ চালুর ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। ঘোষণা অনুযায়ী ১৭ এপ্রিল থেকে পাঁচটি দেশে চলবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট। দেশগুলো হলো সৌদি আরব, কাতার, দুবাই, ওমান ও সিঙ্গাপুর।
বিশেষ ফ্লাইট চালুর ঘোষণা আসার পর থেকে টিকিটের দাম বেড়েছে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। ৩০ হাজার থেকে ৫০ হাজার টাকা বেশি দিতে হচ্ছে একেকটি টিকিটের পেছনে। করোনা মহামারি পরিস্থিতির মধ্যে যে সব বিদেশযাত্রী ঋণ কিংবা সহায়-সম্বল বিক্রি করে বিদেশে যেতে চাইছেন তাদের জন্য গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বাড়তি দামের এ টিকেট।
বরিশালের আগৈলঝাড়া থেকে ঢাকায় এসেছেন তোফাজ্জল তরফদার। তিনি সৌদি আরব যেতে চান। কিন্তু লকডাউনের মধ্যে তার ফ্লাইট স্থগিত হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় বিশেষ ফ্লাইটের ঘোষণা আসায় ‘আদম অফিস’ থেকে তার কাছে টিকেট বাবদ চাওয়া হয়েছিল বাড়তি ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু একদিন পর তার কাছে চাওয়া হয়েছে আরও ১৫ হাজার।
‘আদম অফিস’ থেকে বলা হয়েছে, বাড়তি টাকা দিতে পারলে তারা টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবেন। তা না হলে তার ফ্লাইট হবে না।
অথচ তোফাজ্জল তরফদারের ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ মাসেই। এর মধ্যে যেতে না পারলে তার ভিসা বাতিল হয়ে যাবে।
তোফাজ্জল তরফদার বলেন, ‘আমার বাড়িতে বুড়ো মা আছে। স্ত্রী ও দুই ছেলে মেয়ে চারজনের সংসার গ্রামের বাড়িতে। নদীতে বাড়িঘর ভেঙে যাওয়ায় মাসে ৬ হাজার টাকা ভাড়া দিতে হয় তাকে। এমন অবস্থায় টিকেটের জন্য এই বাড়তি টাকা জোগার করার বিষয়টি তার নাকেমুখে ঠেকে যাচ্ছে।’
‘আমি চেষ্টা করছি, টাকা জোগাড় করতে পারি তো বিদেশে যাব। আর যদি যেতে না পারি তাহলে কপালে যা হওয়ার তাই হবে’ বলেন তোফাজ্জল তরফদার।
আরও পড়ুন: প্রবাসী কর্মীদের জন্য শনিবার থেকে বিশেষ ফ্লাইট
ঝিনাইদহের শ্যামনগর গ্রাম থেকে গত ৬ এপ্রিল ঢাকায় এসেছিলেন শাহাজান মিয়া। ওই সময় কড়া বিধি-নিষেধ থাকায় তিনি গ্রাম থেকে প্রাইভেটকার ভাড়া করে ঢাকায় আসেন। সে সময় তাকে প্রাইভেটকারের ভাড়া গুনতে হয়েছে ৯ হাজার টাকা।
১১ তারিখে ফ্লাইট হওয়ার কথা থাকলেও ঠিক সময়ে ‘টিকেট’ না পাওয়ায় শাহাজান সৌদি আরবে যেতে পারেননি। ১৪ তারিখের আগে ফ্লাইট হওয়ার কোনো সম্ভাবনাও ছিল না। তবে বিশেষ ফ্লাইট হওয়ার ঘোষণা আসায় তিনি ১৭ এপ্রিল সকাল ৯টা ২০ মিনিটের একটি ফ্লাইটে টিকেট কাটতে পেরেছেন।
শাহাজান বলেন, ‘আত্মীয়-স্বজনদের কাছ থেকে টাকা ধার করেছি। ব্যাংক থেকে সুদের ওপর ধার করেছি। প্রতিমাসে ব্যাংকের কিস্তি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এতকিছুর পরও ৪০ হাজার টাকা বেশি দিয়ে টিকেট কাটতে হয়েছে।’
‘দেশে আটকা পড়লেই তো লোকসান এর থেকে বিদেশে গিয়ে কিছু করতে পারলে তো সুবিধা হবে। ব্যাংকের কিস্তি দিতে না পারলে বিপদে পড়তে হবে।’
রিক্রুটিং এজেন্টদের অভিযোগ, করোনা মহামারির সুযোগ নিচ্ছে অসাধু এয়ারলাইন্সগুলো। এরা তাদের পছন্দের এজেন্টদের ছাড়া অন্য কোথাও টিকেট বিক্রি করে না। ফলে টিকিটের বিষয়ে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। টিকেট এজেন্সি কিংবা তাদের সাজানো লোকজন যেভাবে বলে ওভাবেই টিকেটের দাম দিতে হচ্ছে।
আরও পড়ুন: কয়েকটি দেশের জন্য বিশেষ ফ্লাইট চালু হচ্ছে
টিকেটের বাড়তি দাম বিষয়ে কাকরাইলের এ এ ওভারসিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলমগীর হোসাইন বলেন, ‘গত বছরের শুরুতে যে টিকিটের দাম ছিল ৩০/৩২ হাজার টাকা, করোনা শুরু হওয়ার পর থেকে টিকেটের দাম বেড়ে হলো ৮০/৮৫ হাজার টাকা। এখন টিকেটের দাম এক লাখ টাকার বেশি।’
‘এই টাকাগুলো আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে নিচ্ছি। রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো বাড়তি টাকা দিয়ে টিকেট কেটে যাত্রী তুলতে পারবে না। কারণ প্রত্যেক যাত্রীর জন্য ২৫/৩০ হাজার টাকা বাড়তি দিতে হবে। এমনিতেই করোনার মধ্যে এই খাতের ব্যবসা শেষ হয়ে গেছে।’
বনানীর এ এম এয়ার ট্রাভেলস লিমিটেডের জেনারেল ম্যানেজার আতাহারুল ইসলাম হিল্লোল বলেন, ‘করোনার কারণে ফ্লাইটে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হচ্ছে এই কারণে টিকেটের দাম কিছু বাড়া স্বাভাবিক। কিন্তু যে হারে দাম বেড়েছে তা অশনি সংকেত।’
এইম ওভারসিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুক্তার হোসেন বলেন, ‘বিমানের কিছু করাপটেড লোকজন আছে, তারা এগুলো করছে। করোনায় মানুষজন মরছে, দুর্নীতিগ্রস্ত লোকরা এগুলোর সুযোগ নিচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আগে সৌদি আরবের টিকেটের যে দাম ছিল তার থেকে এখন অন্তত ৩০০ ডলার দাম বেড়েছে। এটি অন্যায়।’
এ ছাড়া বিমান এয়ারলাইন্সগুলো তাদের তালিকায় থাকা শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকেট দেয়। ফলে সেখানে স্বেচ্ছাচারিতার জন্ম হয়। এর ফলে যেভাবে টিকেটের দাম বলে সেই দাম দিয়েই টিকেট কিনতে হয় অভিযোগ মুক্তার হোসেনের।
ফ্লাইটগুলোর টিকেট ব্যবস্থাপনা খাতে মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে বলে মনে করেন একতা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘শুধু বিশেষ ফ্লাইট চালু করলেই হবে বিশেষ ফ্লাইটে কোন দেশের টিকেটের কত দাম সেটিও উল্লেখ করে দিতে হবে। তাহলে কালোবাজারিরা সুযোগ নিতে পারবে না।’
এ ছাড়া বিদেশগামী শ্রমিকদের জন্য ‘লেবার ফেয়ার’ ব্যবস্থা চালুর দাবি জানান একতা ইন্টারন্যাশনালের ব্যবস্থা পরিচালক।
তিনি বলেন, ‘এখন বিমানে ইকোনোমিক ক্লাস, বিজনেস ক্লাস প্রভৃতি ক্যাটাগরিতে ভাড়া পরিশোধ করতে। যারা লেবার তাদের জন্য আলাদা ভাড়া নির্ধারণ করা উচিত।’
বিশেষ ফ্লাইটের টিকিটের বাড়তি দাম বিষয়ে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (এটিএবি) মহাসচিব মো. মাজহারুল এইচ ভূঁইয়া বলেন, ‘বিশেষ ফ্লাইটের ঘোষণা আসায় যাত্রীদের চাপ অনেকে বেড়েছে। অনেক প্রবাসী কর্মী আছেন যাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাচ্ছে তারা টিকেটের জন্য হুমড়ি খাচ্ছেন। টিকিটের চাহিদা বাড়ায় এয়ারলাইন্সগুলো দাম বেশি নিচ্ছে।’
সারাবাংলা/একে
করোনা কোভিড-১৯ নভেল করোনাভাইরাস প্রবাসী কর্মী বিশেষ ফ্লাইট লকডাউন