নুসরাত হত্যা: করোনায় আটকে আছে আপিল শুনানি
১৮ এপ্রিল ২০২১ ১০:১৫
ঢাকা: ফেনীর মাদরাসা শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার দুই বছর পেরিয়েছে। প্রায় দেড় বছর আগে রাফি হত্যার মামলায় ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করে বিচারিক আদালত। এরপর ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের জন্য (ডেথ রেফারেন্স) মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে পাঠানো হয়। তবে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) মহামারি শুরু হওয়ায় থেমে যায় এ মামলার যাবতীয় বিচার কার্যক্রম।
রায় ঘোষণার প্রায় দেড় বছর হতে চললেও হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের আপিল শুনানি এখনো শুরুই হয়নি। কবে আপিল শুনানি শুরু হবে তাও বলতে পারছে না কেউ। এ মামলার বাদীপক্ষের চাওয়া বিচারিক আদালেতের রায় হাইকোর্টেও বহাল থাকবে এবং তা দ্রুত কার্যকর করবে সরকার। অন্যদিকে আসামিপক্ষের প্রত্যাশা দ্রুত আপিল শুনানি শেষ করার মধ্যে দিয়ে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা হবে।
২০১৯ সালের ৬ এপ্রিল ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার প্রশাসনিক ভবনের ছাদে নিয়ে নুসরাত জাহান রাফির গায়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। পরে ১০ এপ্রিল চিকিৎসারত অবস্থায় মারা যান নুসরাত।
এর আগে একই বছরের ২৭ মার্চ ইসলামিয়া ফাজিল মাদরাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদদৌলা নিজ কক্ষে ডেকে নিয়ে নুসরাতের শ্লীলতাহানি করেন। এ ঘটনায় তার মা শিরিনা আক্তার বাদী হয়ে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করলে পুলিশ অধ্যক্ষকে গ্রেফতার করে। মামলা তুলে না নেওয়ায় ৬ এপ্রিল নুসরাতের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয় দেয় বোরকা পরা পাঁচজন। এতে তার শরীরের ৮৫ শতাংশ পুড়ে যায়। এরপর ৮ এপ্রিল তার ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান আটজনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাতনামা আরও কয়েকজনকে আসামি করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন। ১০ এপ্রিল ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নুসরাত।
পরে মামলাটি তদন্ত করে পিবিআই ১৬ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয়। এর পর ২০১৯ সালের ২৪ অক্টোবর ফেনীর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক মামুনুর রশিদ রায়ে ১৬ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। পাশাপাশি প্রত্যেককে ১ লাখ টাকা করে অর্থদণ্ড করা হয়।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদদৌলা, নুর উদ্দিন, শাহাদাত হোসেন শামীম, কাউন্সিলর ও সোনাগাজী পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মাকসুদ আলম, সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের, জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন, হাফেজ আব্দুল কাদের, আবছার উদ্দিন, কামরুন নাহার মনি, উম্মে সুলতানা পপি, আব্দুর রহিম শরীফ, ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভাপতি ও মাদরাসার সাবেক সহসভাপতি রুহুল আমিন, মহিউদ্দিন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম।
পরে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদন) হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আসে। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক (মামলার যাবতীয় নথি) ছাপানো শেষ করা হয়েছিল। শুনানির জন্য মামলাটি প্রধান বিচারপতি বরাবর উপস্থাপন করা হয়। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি। আবার আসামিপক্ষ বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন। এরই মধ্যে করোনা মহামারির কারণে মামলার যাবতীয় কার্যক্রম থেমে যায়।
এ বিষয়ে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী শাহজাহান সাজু সারাবাংলাকে বলেন, ‘নুসরাত জাহান রাফি হত্যায় ২০১৯ সালের ২৪ অক্টেবর ১৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেয় বিচারিক আদালত। সেইসঙ্গে প্রত্যেককে এক লাখ টাকা জরিমানা করে আদালত। পরে আসামিদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। এরপর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক ছাপানো শেষে মামলার আপিল শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি। কিন্তু করোনার মহামারির কারণে আর আপিল শুনানি শুরু হয়নি।’
তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখা থেকে আমাদের জানানো হয়েছে যে, করোনাকালে ভার্চুয়াল আদালতে এই ডেথ রেফারেন্স শুনানি হবে না। হাইকোর্টে নিয়মিত আদালত চালু হলে মামলার শুনানি শুরু হবে।’
আইনজীবী শাহজাহান সাজু আরও বলেন, ‘বিচাররিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেছে আসামিপক্ষ। ওই আপিলেও আমরা পক্ষভুক্ত হতে আবেদন করেছি। আমরা আশা করছি বিচারিক আদালতের মতো হাইকোর্টেও মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকবে।’
এদিকে গত মার্চে করোনার সংক্রমণ হঠাৎ বেড়ে যাওয়ায় গত ৫ এপ্রিল থেকে করোনা সীমিত পরিসরে আদালত চালু রাখতে বিজ্ঞপ্তি জারি করে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এ সময় হাইকোর্টে চারটি ও আপিল বিভাগে একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ডেথ রেফারেন্সের মামলা শুনানির জন্য কোনো বেঞ্চ নেই।
এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি রুহুল আমিনের আইনজীবী কামরুল হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেছি। হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল আবেদন দুটিই একসঙ্গে শুনানি হবে। এখনো হাইকোর্টে শুনানি শুরু হয়নি। জানতে পেরেছি নিয়মিত আদালত চালু হলে ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি শুরু হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা মনে করি, এই মামলায় হাইকোর্টের রায়ে আসামিরা খালাস পাবেন। কারণ এই ঘটনার যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ নেই। চিকিৎসকের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন, সাক্ষী এবং তদন্তকারী কর্মকর্তার রিপোর্টের কোনোটিতে কেউই হত্যাকাণ্ডের কথা প্রমাণ করতে পারেনি। তাই আমরা মনে করি, আসামিরা হাইকোর্টে খালাস পাবেন। সেজন্য মামলাটির দ্রুত শুনানি শুরু করা প্রয়োজন।’
সারাবাংলা/কেআইএফ/পিটিএম