করোনায় আয়-রোজগার হারিয়ে অনটনে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা
১৮ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৩০
চট্টগ্রাম ব্যুরো: করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের মধ্যে সরকারের ঘোষিত ‘কঠোর লকডাউনে’ অভাব-অনটনে দিন পার করছেন চট্টগ্রামের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষরা। সমাজের সুবিধাভোগীদের কাছ থেকে চেয়ে-চিন্তে যাদের পেট চলে, করোনার থাবায় তাদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে আছে। এ অবস্থায় সরকারের কাছে রেশন সুবিধা দাবি করেছেন তারা।
রোববার (১৮ এপ্রিল) চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসন তৃতীয় লিঙ্গের ২২০ জন মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে। সেই ত্রাণ নিতে এসে নিজেদের কষ্টের দিনযাপনের কথা বলেছেন তাদের কয়েকজন।
নগরীর পাহাড়তলী থানার সাগরিকা এলাকায় বিটাক বাজারে একটি কলোনিতে থাকেন তৃতীয় লিঙ্গের পায়েল। সাগরিকা এলাকায় বিভিন্ন অফিসে ও বাসাবাড়িতে হাত পেতে এতদিন নিজের ভরণ-পোষণ করতেন। কিন্তু করোনার কারণে গত বছর থেকে আয়-রোজগার সীমিত হয়ে এসেছে। এখন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দু’বেলা ভাতও জুটছে না বলে জানান তিনি।
পায়েল সারাবাংলাকে বলেন, ‘কলোনিতে আমরা ১৯ জন একসাথে থাকি। আমি একটি মেয়ে দত্তক নিয়েছি। তার বয়স আট বছর। আগে সারাদিন ভিক্ষা করে চার-পাঁচশ টাকা পেতাম। সপ্তায় ২-৩ দিন বের হতাম। আমি এবং আমার মেয়ের দিন কোনোমতে কেটে যেত। এখন তো ৬ হাজার টাকা বাসা ভাড়া দিতে গিয়ে দুইবেলা ভাতও খেতে পারছি না। কোনোদিন একবেলা খাই। কোনোদিন কারও কাছ থেকে চেয়ে ভাত এনে মা-মেয়ে দুজন ভাগ করে খাই।’
মোহরা এলাকায় থাকেন তৃতীয় লিঙ্গের জোহরা। তিনি সারাবাংলাকে বলেন, ‘গতবছর করোনা শুরুর পর আমরা একদম বেকার হয়ে যাই। প্রায় ছয়মাস আয়-রোজগার ছিল না। বাসা ভাড়া জমে গিয়েছিল। গত নভেম্বর-ডিসেম্বর থেকে আবার ভিক্ষা শুরু করি। মার্চ থেকে আবারও সমস্যা শুরু হয়েছে। বাসাবাড়িতে-অফিসে গেলে করোনার কারণে ঢুকতে দেয় না। বলতে গেলে এখন আমাদের হাত একেবারে খালি।’
কাজমুখী না হয়ে ভিক্ষাবৃত্তিতে কেন? জানতে চাইলে তৃতীয় লিঙ্গের জেরিন বলেন, ‘ভিক্ষা করা এটা আমাদের কালচার হয়ে গেছে। হিজড়া সম্প্রদায়ের পূর্বপুরুষরা এভাবেই পেট চালাতেন, আমরাও করছি। আর আমাদের তো কেউ চাকরি দেয় না। যেসব হিউম্যান রাইটস আছে, সেগুলো তো আমাদের জন্য না। সেগুলো থেকে আমরা বঞ্চিত। ভিক্ষা করা ছাড়া আমাদের পেট চলবে কিভাবে?’
তারা জানিয়েছেন, কঠোর লকডাউনের অন্তত দেড়মাস আগে থেকেই তৃতীয় লিঙ্গের অধিকাংশ মানুষের আয় বন্ধ হয়ে গেছে। চট্টগ্রামের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের মধ্যে অধিকাংশ ভিক্ষাবৃত্তিতে জড়িত হলেও কেউ কেউ পান-সিগারেট বিক্রি, কমিউনিটি পুলিশিংয়ের আওতায় বিভিন্ন স্পটে, যাবনাহন নিয়ন্ত্রণসহ ছোটখাট কাজ করেন। কিন্তু লকডাউনের কারণে তাদের সেই রোজগারও বন্ধ।
এদিকে রোববার চট্টগ্রাম নগরীর জিমনেশিয়াম হলে তৃতীয় লিঙ্গের ২২০ জনের মাঝে ১৪ কেজি করে প্রত্যেককে ত্রাণ দেওয়া হয়েছে। প্রতি প্যাকেট ত্রাণের মধ্যে ছিল ৮ কেজি চাল, ১ কেজি ডাল, ১ কেজি চিড়া, ২ কেজি আলু, ১ কেজি চিনি, ১টি সেমাই ও ১০০ গ্রাম চা পাতা।
চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রহমান এ সময় সাংবাদিকদের বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ যারা আছে, তারা হাত পেতে জীবনধারণ করে। কিন্তু করোনার কারণে এখন তাদের তো সেই সুযোগ খুব বেশি নেই। সেজন্য আমরা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিয়েছেন তাদের পাশে দাঁড়াতে। আমরা তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। তাদের কর্মসংস্থানের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর পাশাপাশি তারা যাতে লকডাউনের মধ্যে কষ্টে না থাকেন, সেই ব্যবস্থাও আমরা করছি।’
জেলা প্রশাসক জানান, লকডাউনের কারণে কষ্টে পড়া নরসুন্দর, মুচি, পরিবহন শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে ত্রাণ দেওয়া হবে। ২০ হাজার প্যাকেট ত্রাণ মজুদ আছে। কেউ যদি ত্রাণ না পান, জেলা প্রশাসকের মোবাইলে এসএমএস দেওয়ার অনুরোধ করেছেন তিনি। পাশাপাশি ধনাঢ্য ব্যক্তিদেরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
তবে তৃতীয় লিঙ্গের জেরিন সরকারের কাছে রেশন কার্ডের দাবি করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের যদি রেশন কার্ড দেওয়া হয়, আমরা যদি মাসে একদিন সরকারের নির্ধারিত জায়গা বা জেলা প্রশাসন থেকে সেই কার্ড দেখিয়ে ত্রাণ আনতে পারি, তাহলে আমাদের কষ্ট কমবে।’
ত্রাণ বিতরণ অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) সুমনী আক্তার, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এস এম জাকারিয়া, নাজমুল আহসান, মাসুদ কামাল, সমাজসেবা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক শহীদুল ইসলাম, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আশরাফুল হাসান, আলী আহসান, উমর ফারুক, মাসুদ রানা ও মিজানুর রহমান, জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা সজীব চক্রবর্তী ও নবজাগরণ হিজড়া শ্রমজীবী সমবায় সমিতির সভাপতি ফাল্গুনী হিজড়া ছিলেন।
স্বেচ্ছাসেবক টিম সিপিপি, বেটার ফিউচার বাংলাদেশ, পুর্বাশার আলো, রেড ক্রিসেন্ট, তৃণমুল নাট্যদল, সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশন ও নির্বাণ ক্লাব তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের ত্রাণ বিতরণে সহযোগিতা দিয়েছে বলে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম