Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

মহামারিতে গর্ভধারণ হলে চিকিৎসার প্রস্তুতি রাখবেন যেভাবে

শাহীনূর সরকার
২১ এপ্রিল ২০২১ ১১:০৫

৯ মাসের অন্তঃসত্ত্বা সায়মা শারমিন। প্রসবের তারিখ যতই এগিয়ে আসছে, দুশ্চিন্তা যেন ঘিরে ধরছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঝুঁকি, মহামারিতে হাসপাতালগুলোতে চাপ, নিজের গর্ভকালীন জটিলতা— সবকিছু মিলিয়ে কঠিন সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন ৩১ বছর বয়সী শারমিন।

সারাবাংলাকে শারমিন বলেন, ‘করোনা মহামারি ও লকডাউনের কারণে নিজের ও গর্ভের শিশু নিয়ে সবসময় দুশ্চিন্তায় থাকি। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল ও চিকিৎসকের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে রেখেছি। তবে করোনার কারণে সবকিছুই এখন অনিশ্চিত।’

বিজ্ঞাপন

দেশে করোনার সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে, তাতে গর্ভবতী নারী বা অন্তঃসত্ত্বাদের চিকিৎসাসেবা নিয়ে সায়মার মতো অনেকের মধ্যেই দুশ্চিন্তা কাজ করছে। যারা গর্ভধারণের পর প্রথম পর্যায়ে আছেন, তারা থেকে শুরু করে প্রসবের সময় এগিয়ে আসা প্রায় সবারই চিন্তা এখন একটিই— হাসপাতালের নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও প্রসবকালীন সেবা কিভাবে পাবেন। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, দুশ্চিন্তা না করে সঠিক পরিকল্পনা ও সচেতনভাবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে মহামারিতেও সংক্রমণ এড়িয়ে সুস্থ সন্তান জন্মদান সম্ভব। আবার গর্ভধারণের পর করোনা সংক্রমিত হলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা দিতে পারলে অনেক জটিলতাই এড়ানো সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সার্বক্ষণিক চিকিৎসকের পরামর্শে থাকতে হবে।

জানতে চাইলে আনোয়ার খান মডার্ন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. শারমিন আব্বাসি সারাবাংলাকে বলেন, ‘এখন অন্তঃসত্ত্বা নারীদের অনেকের মধ্যেই করোনার সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে। গর্ভধারণের পর এমনিতেই রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে। তাই এই সময়ে করোনায় আক্রান্ত হলে ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে খুব বেশি জটিল লক্ষণ দেখা না গেলে অনেকেই চিকিৎসকের কাছে যেতে চান না। লক্ষণগুলো অনেক বেশি মারাত্মক হওয়ার পর আমাদের কাছে আসছেন। এতে করে কিন্তু আমাদের সেবা দেওয়ার সুযোগ কমে যায়। তাতে প্রসূতি ও সন্তান— দু’জনেরই জীবন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে যায়।’

বিজ্ঞাপন

গর্ভবতী নারীরা করোনায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে এবং হাসপাতালে যেতে যেন কোনোভাবেই দেরি না হয়, সেদিকে জোর দিচ্ছেন ডা. শারমিন আব্বাসি। এ ক্ষেত্রে পরিবারের সবাই করোনা আক্রান্ত হলেও অবশ্যই গর্ভবতী নারীর দিকেই মনোযোগ বেশি দিতে হবে বলেও পরার্মশ তার। ডা. আব্বাসি বলেন, ‘প্রসূতি করোনায় আক্রান্ত হলে তার চিকিৎসা কোথায় হবে, তা পরিবারকে জেনে রাখতে হেবে। অর্থাৎ যেখানে গর্ভবতী মা ও করোনা— দু’টোরই চিকিৎসা হয়, সেরকম হাসপাতালগুলোর ঠিকানা জেনে রাখতে হবে।’

স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, গর্ভবতী অবস্থায় যদি কারও কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়, তাদের জন্য সরকারি কোভিড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। শুধু তাই নয়, এসব সরকারি হাসপাতালে করোনায় আক্রান্ত সন্তানসম্ভবাদের অগ্রাধিকারও দেওয়া হচ্ছে। সরকারি হাসপাতালগুলোর অ কর্তৃপক্ষও একই কথা বলছে।

স্বাস্থ্য অধিদফতরের হাসপাতাল শাখার পরিচালক ডা. ফরিদ হোসেন মিঞা সারাবাংলাকে বলেন, ‘ঢাকা মেডিকেল কলেজ, মুগদা মেডিকেল কলেজ, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও মাতুয়াইল শিশু মাতৃসদন হাসপাতালের কোভিড পজিটিভ গর্ভবতী নারীদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। এসব হাসপাতালে নির্দেশনা দেওয়া আছে, যদি গর্ভবতী নারীদের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পাওয়া যায়, তাহলে তাদের অগ্রাধিকারভিত্তিতে চিকিৎসা দিতে হবে।’

তবে গর্ভাবস্থায় যেন করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধ করা যায়, সেদিকেই জোর দিতে বলছেন ডা. শারমিন আব্বাসি। তিনি বলেন, পৃথিবীজুড়ে গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত গর্ভবতী নারীর শারীরিক জটিলতা বেড়ে গেলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। প্রিম্যাচিউরড বেবি জন্মের হার বেড়ে যায়। তাই যাদের ঘরে করোনার সংক্রমণ পাওয়া যাচ্ছে, সেখানকার গর্ভবতী নারীদের জন্য আলাদা সুরক্ষা প্রাচীর গড়ে তুলতে হবে।

সন্তান জন্মদানের পর করোনা পজিটিভ হলে যা করবেন

সন্তান জন্মদানের পর কোনো প্রসূতি করোনায় আক্রান্ত হলেও তিনি বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারবেন। সেক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে।

ডা. শারমিন আব্বাসি বলেন, ‘মা মুখে মাস্ক পরে, হাত ধুয়ে এবং একটি পরিষ্কার কাপড় পরে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াবেন। যদি মা সঠিকভাবে বুকের দুধ খাওয়াতে না পারেন, তাহলে অন্য কারও সহায়তা নিয়ে মায়ের বুকের দুধ বাটি চামচ দিয়ে বাচ্চাকে খাওয়াবেন।’ বুকের দুধের মাধ্যমে নবজাতকের করোনায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই বলেও জানান তিনি।

সদ্য গর্ভধারণকারীদের করণীয়

যারা সবেমাত্র গর্ভধারণ করেছেন, তারা এখন আর আগের মতো নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে যেতে পারছেন না। এ বিষয়ে ডা. শারমিন আব্বাসি বলেন, ‘অন্তঃসত্ত্বা নারীরা টেলিমেডিসিন সেবা নিতে পারেন। তবে কারও বিপদচিহ্ন, যেমন— অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, মাথাব্যাথা, প্রেশার বেড়ে যাওয়া, পানি ভেঙে যাওয়া, লেবার পেইন দেখা গেলে অবশ্যই হাসপাতালে যেতে হবে।’ এছাড়া বাসায় ওয়েট মেশিন, প্রেশার মেশিন ও গ্লুকোমিটার দিয়ে নিয়মিত গর্ভবতী নারীর ওজন, রক্তচাপ, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা পর্যবেক্ষণসহ অন্যান্য শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। বলেন, এক্ষেত্রে পরিবারের সবাই মিলে গর্ভবতীর পাশে থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

তবে নিয়মিত হাসপাতালে যেতে না পারলেও নির্দিষ্ট কিছু গুরুত্বপূর্ণ আল্ট্রাসাউন্ড অবশ্যই করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। যেমন, গর্ভের শিশুর জন্মগত কোনো ত্রুটি আছে কি না, তা দেখার জন্য ২২ থেকে ২৪ সপ্তাহে অ্যানোমালি স্ক্যান অবশ্যই করতে হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

মহামারিতে হাসপাতালগুলোতে চাপ থাকায় অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জরুরি সেবার জন্য বাসার আশপাশের চার-পাঁচটি হাসপাতালের ঠিকানা, ফোন নম্বর ও সেখানকার ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে রাখার প্রতি জোর দিয়েছেন ডা. আব্বাসি।

গর্ভকালীন ভ্যাকসিন

কেউ করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের প্রথম ডোজ নেওয়ার পর গর্ভধারণ করেছেন। তারা এই ভ্যাকসিনের দ্বিতীয় ডোজ নেবেন কি না, তা নিয়ে অনেকেরই সংশয় আছে। তাদের দ্বিতীয় ডোজের ভ্যাকসিনও নিয়ে নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ডা. শারমিন আব্বাসি।

তবে প্রথম ডোজের ভ্যাকসিন নেওয়ার আগেই গর্ভধারণ করে ফেললে ভ্যাকসিন নেওয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। একইসঙ্গে যারা সন্তান জন্ম দিয়েছেন এবং সন্তানকে বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন, তাদেরও করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন নিতে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে।

মহামারির সময়ে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ

করোনা মহামারির এই সময়ে অপরিকল্পিত গর্ভধারণও ঘটছে অনেকের ক্ষেত্রে। তাদের অনেকেই নিকটস্থ ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কিনে নিজেরাই গর্ভপাত করাচ্ছেন। কিন্তু এসব ওষুধ খাওয়ার পর মারাত্মক পেটে ব্যাথা, রক্তপাতসহ নানা সমস্যা নিয়ে অনেককেই আবার হাসপাতালে আসছেন। বর্তমান সময়ে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ হলে তবে করণীয় কী?

ডা. শারমিন আব্বাসি বলেন, ‘মহামারিতে এমনিতেই হাসপাতালে রোগীদের অনেক চাপ। এখন যাদের ডেলিভারি টাইম, তাদেরও চাপ আছে হাসপাতালে। সেখানে অপরিকল্পিত গর্ভধারণ ও গর্ভপাতজনিত রোগীদের জন্য হাসপাতালগুলোতে আরও বেশি রোগী বেড়ে যাচ্ছে।’ মহামারির এই সময়ে তাই অপরিকল্পিত গর্ভধারণ যেন না হয়, সেটি নিশ্চিত করতে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি অনুসরণের আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

সারাবাংলা/এসএসএস

অন্তঃসত্ত্বা করোনা গর্ভকালীন করোনা

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর