দেশকালের ‘আগ্নেয় জীবন’
২১ এপ্রিল ২০২১ ২০:০৩
১৯৮২ সালে বইমেলায় কিনেছিলাম একটি গদ্যগ্রন্থ। নাম: শব্দ আর সত্য। লেখক শঙ্খ ঘোষ। এই বইয়ের মধ্যে একটি প্রবন্ধে ছিল এই রকম কয়েকটি লাইন— “শব্দবাহুল্যের বাইরে দাঁড়িয়ে, ভুল আস্ফালনের বাইরে দাঁড়িয়ে সত্যিই যদি নিজেকে, নিজের ভিতর এবং বাহিরকে, আগ্নেয় জীবনযাপনের বিভীষিকার সামনে খুলে দিতে পারেন কবি, সেই হবে আজ তাঁর অস্তিত্বের পরম যোগ্যতা, তাঁর কবিতা।”
আমার বয়স তখন ২৭। এই লাইনগুলি সেই বয়স থেকে আমার কাছে হয়ে উঠল পথপ্রদর্শক এক দিকচিহ্ন। লেখার চেষ্টা করার সময়, আমি আজও গদ্য বা কবিতা যা-ই লিখি না কেন, উপরোক্ত লাইনগুলিকে অন্ধকারে জ্বলজ্বলে ধ্রুবতারার মতো অনুসরণ করে চলি। হ্যাঁ, অন্ধকার! লেখার আগে মনে হয় এক অন্ধকার প্রদেশের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। আজও আমি কবিতা কী করে লিখতে হয়, এমনকি গদ্যরচনাও আমাকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা শিখতে পারিনি। তাই ওই লাইনগুলির প্রতি অন্ধের যষ্টির মতো নির্ভর করে পথ চলতে চলতে এক সময় দেখি, লেখা কোনও একটি গন্তব্যে পৌঁছে থামল।
ওই বিশেষ কথাগুলি শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন ‘ক্ষুধার্ত’ সম্প্রদায়ভুক্ত কবিদের বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে। অথচ, আমার সারা জীবনে এক জনও হাংরি কবির সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হয়নি। যদিও তাঁদের সকলের লেখাই পড়েছি। লিখিত শব্দের মাধ্যমে ‘ক্ষুধার্ত’ কবিদের মনের সঙ্গে পরিচয়। তবু, ‘ক্ষুধার্ত’ গোষ্ঠীর শব্দশিল্পীদের প্রসঙ্গে বলা শঙ্খ ঘোষের কথাগুলি আমার শিক্ষক হয়ে উঠল।
ওই একই গ্রন্থে আরও একটি প্রবন্ধ পড়লাম, যার নাম ‘রুচির সমগ্রতা’। সেখানে এক জায়গায় পেলাম এই কথা: “এরকম অভিজ্ঞতাও আমাদের বিস্তর ঘটেছে যে বিষ্ণু দে-র ভক্ত সইতে পারেন না জীবনানন্দের রচনা, অথবা জীবনানন্দের অনুরাগী অগ্রাহ্য করেন সুধীন্দ্রনাথকে…।” এর পরেই পেলাম এই সব লাইন: “এক-হিসেবে, হয়তো এ-রকমই হবার কথা। রুচির এক-একটা বিশেষ আদল গড়ে ওঠে পাঠকের মনে, হয়তো কোনো সামার্থ্যবান কবিই তৈরি করে দেন সেই আদলটি, আর তার বাইরে ভিন্ন রুচির কবিতাকে নিজের মধ্যে নিতে পারা যেন অসম্ভব মনে হয় তখন। এক কবিকে মনে হতে থাকে আরেকজনের বিপরীত কিংবা বিরোধী, একজনের প্রতি আনুগত্যের সততায় অন্যজনকে লক্ষ করা তখন শক্ত হয়ে ওঠে।” এই লাইনগুলি পড়ার পর নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলাম। সত্যিই তো! আমারও তো হয় এ রকম! এই ২৭ বছর বয়সেই আমি দু’ভাগে ভাগ করে নিয়েছি আমার প্রিয় আর অপ্রিয় কবিদের। ঠিক কাজ করেছি কি?
এই ‘রুচির সমগ্রতা’ রচনাটি ধরে এগিয়ে চলতে চলতে জানতে পারলাম লেখকের একটি বিশেষ উপলব্ধি, যা আমি আগে বুঝিনি। কী বলছেন লেখক? বলছেন: “জীবনের কাছে অথবা কবিতার কাছে আমাদের অতিনির্মিত সচেতন দাবির ধরনটা খুব উচ্চারিত। আমরা চাই হৃদয় অথবা মেধা, জাদু অথবা যুক্তি, রহস্য অথবা স্বচ্ছতা, ব্যক্তি অথবা সমাজ, শমতা কিংবা ক্ষোভ, নম্যতা বা বিদ্রোহ, আসক্তি বা বিদ্রূপ। আমরা নির্বাচন করে নিই এর মধ্যে যে-কোনো এক দিক, মনে করতে থাকি সেইটেকেই জীবনের সম্পূর্ণতা…।”
এর ঠিক পরেই এ লেখায় এসে পড়ল নম্র ও মৃদু স্বরে বলা কঠোর একটি বাক্য। বাক্যটি এই রকম: “কিন্তু এতে কি ফাঁকি নেই মস্ত? মানুষের সহস্রধারা মনকে কি অত সহজেই বন্দী করা চলে নির্ধারিত এক কাঠামোর মধ্যে?” মুহূর্তে এক অপরাধবোধ এসে আচ্ছন্ন করল আমাকে। আমিও তো অমনই এক নির্ধারিত কাঠামোর ধরনকেই আমার পছন্দের কবিতা বলে মনে করে চলেছি!
শঙ্খ ঘোষ ভারতে জন্ম নেওয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিদের এক জন। যথার্থ অনুবাদের অভাবে তাঁর কবিতার শ্রেষ্ঠত্ব সমগ্র বিশ্বে প্রচারিত হয়নি। আর এক সপ্তাহ পরে তিনি ৯০ বছরে পদার্পণ করবেন। ৮০ উত্তীর্ণ বয়সের পরও প্রায় প্রত্যেক বইমেলায় একটি করে নতুন কাব্যগ্রন্থ বেরিয়ে চলেছে তাঁর। আজ অন্য একটি দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করব শঙ্খ ঘোষ বিষয়ে। সম্প্রতি কবি সম্মেলন পত্রিকায় তাঁর একটি গদ্য ছাপা হয়েছে, যার তলায় মুদ্রিত— শ্রুতিলিখন: কৃতজ্ঞতা: স্নেহাশিস পাত্র। শ্রুতিলিখন? কেন? কিছু দিন আগে তরুণ এক কবিতালেখক ফেসবুকে নিজের ওয়াল-এ পোস্ট করেছিলেন এই সংবাদ যে, শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতা সেই তরুণ ডিক্টেশন নিয়ে কপি করে দিয়েছেন। মনে পড়ল আমার, শঙ্খ ঘোষ তাঁর গদ্যগ্রন্থের একাদশ খণ্ড এক জনকে উপহার দিয়েছেন, যেখানে উপহারপ্রাপ্ত ব্যক্তির নামের আদ্যক্ষরটি শুধু লেখা কম্পিত হস্তাক্ষরে, তার ঠিক নীচেই ওই কাঁপা হাতেই লেখা তালব্য শ বর্ণটি। অর্থাৎ নিজের নামটিও আর শঙ্খ ঘোষ পুরোটা স্বাক্ষর করে উঠতে পারছেন না। এর মধ্যে আমরা খবর পাচ্ছি একাধিক বার হাসপাতালে যেতে হয়েছে এই কবিকে।
তা হলে কী দাঁড়াল? মুখে মুখে বলে লেখানো, কলম ধরতে হাত কাঁপা, প্রায়ই হাসপাতাল যাত্রা— অর্থাৎ বয়সোচিত বার্ধক্য, জরা, রুগ্ণতা তাঁর জীবনকে জড়িয়ে ধরেছে। এই তো? কিন্তু অতিশয় বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী এই কবি। শঙ্খ ঘোষের শেষ কয়েক বছরে বেরোনো চার-পাঁচটি কবিতার বই আমার হাতে এখন। কোথাও বার্ধক্য বা জরা অথবা রোগজীর্ণতার চিহ্নমাত্র নেই তাঁর কবিতায়! তাঁর কবিতা চলেছে দু’টি পথে। এক, সমাজের যাবতীয় অসাম্য ও অত্যাচারের বিরোধিতা করছে সেই কবিতা। অন্য দিকে, মনের অবচেতনের অতলে নেমে তুলে আনছে রহস্যময় লেখনস্রোত। এমনকি, প্রেমের কবিতাও দেখা দিচ্ছে স্নিগ্ধ মধুরতা নিয়ে।
সমস্ত জীবন যাঁর সৃষ্টিকর্মের উপর কাজ করেছেন শঙ্খ ঘোষ, লিখেছেন এ আমির আবরণ, নির্মাণ আর সৃষ্টি-র মতো মহৎ গ্রন্থাবলি— সেই রবীন্দ্রনাথও তাঁর বইয়ের নাম দিতে বাধ্য হয়েছিলেন রোগশয্যায় বা আরোগ্য। অর্থাৎ, জরা ও রোগের আক্রমণকে নিজ কবিতায় স্বীকার করে নিয়েছিলেন আমাদের ভাষার সর্বোচ্চ এই কবিপুরুষও।
শঙ্খ ঘোষকে এইখানে আমাদের প্রণাম করতেই হয় যখন দেখি, তিনি তাঁর মনের প্রতিরক্ষাব্যূহকে এমন অটুট রেখেছেন, যেখানে বার্ধক্য ও দেহের অক্ষমতা সম্পূর্ণ রূপে পরাজিত হচ্ছে। এদের তিনি তাঁর কবিতায় প্রবেশাধিকার দিচ্ছেন না। জরা তাঁর দেহকে আক্রমণ করতে চায় ঠিকই, কিন্তু তাঁর কবিত্বের কাছে এসে পিছু হটতে বাধ্য হয়।
নিজের জীবনের বদলে, বরং কোথাও কোথাও দেশকালের আগ্নেয়-জীবনকে খুলে ধরেছে তাঁর সাম্প্রতিক কাব্য। চিরদিনই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অন্যায় প্রয়োগের বিভীষিকাকে প্রকাশ্যে এনেছে তাঁর লেখা। তিনি কাউকে ভয় পাননি, আজ জরাকেই বা ভয় পাবেন কেন? এই ভাবেও, এ-গদ্যের প্রথমে উদ্ধৃত লাইনগুলির সঙ্গে তাঁর কবিধর্ম মিশে যায়।
[কবি শঙ্খ ঘোষের ৯০তম জন্মদিন ছিল এ বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি। তার ৯০ বছরে পদার্পণ উপলক্ষে এক সপ্তাহ আগে ৩০ জানুয়ারি ভারতের দৈনিক ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকায় লেখাটি প্রকাশিত হয়। জয় গোস্বামী এই লেখায় নিজের জীবনে শঙ্খ ঘোষের বিভিন্ন রচনার উপস্থিতির কথা তুলে ধরেছেন। এখানে মূল লেখার বানানরীতি অক্ষুণ্ন রাখা হয়েছে।]
সারাবাংলা/পিটিএম