‘বুকের ভেতরে বাংলাদেশ, ওখানেই বাস করি’
২১ এপ্রিল ২০২১ ২১:৩৪
‘ও, শঙ্খ ঘোষ? ফোনে পাবে না… পেলেও কথা বলবেন না। আর সাংবাদিক শুনলে তো আরো না।’ কলকাতায় যাকেই বলছিলাম কবিদের কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে দেখা করব, সবাই ওই একই কথা বলে ভয় দেখালো। আসলে এই ভোটের বাজারে হার্ডকোর পলিটিক্স, অমিত শাহ, নরেন্দ্র মোদির প্রেস কনফারেন্স ছেড়ে, রাহুল গান্ধির টুইটে মোদিকে নিয়ে ঠাট্টা-মশকরার গল্প ছেড়ে, মমতার ডেসপারেট মন্তব্য নিয়ে লেবু কচলানোর ক্লিশে রেস থেকে আমাকে একটু বিশ্রাম দিতে চেয়েছিল আমার প্রিয় এক কবি বন্ধু। কাজ থেকে তুলে নিয়ে আরেকটু বেশি কাজে ঢুকিয়ে দিতে গিয়ে নিজেই অনেকখানি রিচার্জড করে দিল। ‘তুমি চেষ্টা কর… কথা বলে দেখ… উনি রাজি হলে তোমার… পলিটিক্সের সঙ্গে খুব, খুবই রিলেট করেন সাদামাটা জীবনের এই কবিদের কবি। তিনি কলকাতার একটি পত্রিকায় একটি লাইন বলেছেন বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙ্গা নিয়ে, ‘আর কত অনাচার দেখার জন্য বেঁচে থাকব?’ কবি শঙ্খ ঘোষ অনেকদিন পর এমন একটি লাইন বলেছেন, এটাই অনেক টিভি চ্যানেলের হেডলাইন। আর কথা না বলতে চাইলে, নব্বই বছর বয়সী এই লিভিং কবিতীর্থ ছুঁয়ে আস!’
কবি বন্ধুর কথা মনে ধরল। পলিটিক্স, আবার মোটাদাগের পলিটিক্সও না। ২০২০ সালে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী উদযাপন শুরু হয়ে গেছে কলকাতায়। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের নাইটহুড উপাধি বর্জনের একশ বছর, এসব প্রতিবাদের মাইলফলক ঘটনার সাথে ‘বাবরের প্রার্থনার’ কবির সেই লাইন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। যেকোনো অসহ্য সময়ের শৈল্পিক প্রকাশে কেউ না কেউ তো স্মরণ করেই।
কলটা ধরবেন না- এমন ধারণা নিয়েই ফোনে কল করলাম। কবি ধরলেন। ক্ষীণ কণ্ঠ। বুঝে নিলাম ঠিকানাটা। উল্টোডাঙ্গার ঈশ্বরচন্দ্র নিবাস। কবির ঘরে আমরা ঢুকতে ঢুকতে আরেকজন বেরুচ্ছিলেন। তিনি, কমনসেন্স দিয়ে চিনে নিলেন। ‘বাংলাদেশ থেকে এসেছেন? আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন দাদা। এইমাত্র বাংলাদেশের বাকরখানি নিয়ে কথা বলছিলাম তো!’ একটু সাহস পেলাম ভদ্রলোকের কথায়। ‘দাদা অপেক্ষা করছিলেন…’
প্রথম দেখার আড়ষ্ট ভদ্রতা ভেঙে বসতে একটু সময় নিলাম। হাতের ইশারায় শঙ্খ ঘোষ তার বা পাশে ডিভানটিতে বসতে বললেন। বসলাম। কিন্তু
কী বলব? কী দিয়ে শুরু করব? ভুলে গেলাম। কবির চোখ ভালো। নব্বইয়ের চোখের ভাঁজ আরেকটু কুচঁকে গেল। মিটিমিটি হাসছেন। চাঁদপুর মনে পড়ে ১৯৩২ সালে বাংলাদেশের চাঁদপুরে জন্ম নেওয়া, এ সময়ের কবিদের কবির সামনে নীরবতা ভাঙার প্রথম বাক্য আমার।
অনেকটা বিড়বিড় আওয়াজে কবি কী যেন বলছেন। বোঝার জন্য শঙ্খের মুখে সমুদ্রের আওয়াজ শোনার মতো করে, বুকের কাছে কান পাতলাম। ভাগ্যিস! দূরত্বের আওয়াজ নেই। বুকে মাথা রাখার কাছাকাছি তাই ঘেঁষা গেলো। কানের ওপর নিঃশ্বাস- প্রশ্বাসটাও পাচ্ছিলাম।
কবি বলছেন, ‘চাঁদপুর মনে পড়বে না কেন? চাঁদপুর মনে পড়ে, পাকশী মনে পড়ে, পাকশী চেন?’ আমি আর সহকর্মী আশিক অপু- দুজনেই বললাম, ‘পাবনা, ঈশ্বরদী, পাকশি কাগজের কল, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ।’ শঙ্খ ঘোষ উচ্চারণটা মুখে তুলে নিয়ে, আমাদের দুজনকেই পাখির মতো শেখান, ‘হার্ডিঞ্জ নয়, হার্ডিন। দেন কিছুটা ব্যাখ্যাও। হার্ডিন নামে এক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার… তারপর নানান গল্প। সবটা শোনা যায়নি। বোঝাও না।
এই স্ফুট-অস্ফুটের মধ্যে বরিশালের বানারীপাড়া, বাবার বাড়ি, পূজোর সময় একমাস কাটানো, বাবা মনীন্দ্র কুমার ঘোষের শিক্ষকতার সুবাদে পাকশীর স্কুল জীবন, ইলিশ মাছ, বরিশালের ইস্টিমার, বাংলাদেশের রান্নার স্বাদ, কবির জন্য নদী, কবিতার জন্য নদী, রবীন্দ্রনাথের কবিত্বে পদ্মা- সে অনেক অনেক গল্প।
বাংলাদেশে ১৯৭৫ এর মার্চে টেলিভিশনে একটা অনুষ্ঠান করেছিলেন। কবি শামসুর রাহমান আর শহীদ কাদরীর সাথে। ক্যামেরার সামনে আড়ষ্টতা তখন থেকেই টের পান। ছবি তুললে, টিভির সামনে গেলে কেমন জানি মন খারাপ থাকে। এসব বলতে বলতে কবি আমার কাছে জানতে চান, ‘তুমি কি ফোনে বলেছিলে, তুমি টেলিভিশনে কাজ কর?’ ‘নাহ! আমি কেবল বলেছি, আমি সাংবাদিক।’ শঙ্খ ঘোষ বললেন, ‘ভালো করেছো। টেলিভিশন শুনলে ভয় পেতাম। আসতে দিতাম কি না…!’ ‘এখন কি ভয় লাগছে? এখনতো জেনে গেছেন।’ স্মিত হাসি শঙ্খ ঘোষের মুখে। ‘নাহ। কিন্তু বাংলাদেশের কথার ফাঁকে ফাঁকে বিদ্যাসাগরের কথা জিজ্ঞেস করছিলে যখন, তখন মনে হচ্ছিল রিপোর্টারের সঙ্গে কথা বলছি।’ হুম। আমি মাথা নাড়ি। ‘আপনার খাবার টেবিলের সামনেই তো আবক্ষমূর্তি। বিদ্যাসাগর।’ এবার একটু যেন বেশিই খুশি হলেন। কবির জবাব, ‘নাহ, ওটা আমার বাবা। যিনি বিদ্যাসাগরকে নিজের রোল মডেল মেনেছিলেন। চলনে-বলনে সবসময় তাকেই ধ্যান করতেন। রবি ঠাকুর আর অশ্বিনী কুমার দত্তও বাবার জীবনের প্রভাব গুরু।‘ আর চিত্তপ্রিয় ঘোষ? মানে কবি হয়ে উঠতে চাওয়াদের বাতিঘর, শঙ্খ ঘোষের প্রভাব গুরু? প্রশ্ন শুনে মৃদু হাসি কবির ঠোঁটে।
বানারীপাড়ার নদীটার নাম জানো? শঙ্খ ঘোষের চোখে নদীর সাদা জলের ঝিলিক। আমি খারাপ ছাত্রীর মেমোরিবক্স হাতড়াচ্ছি। বইয়ের সারি সারি সেলফ, যেটুকু দেয়াল তার ফাঁকে যামিনী রায় বাঁধানো। রিয়েল।
মেমোরিবক্সে কীতর্নখোলা, কীর্তিনাশা, ধানসিঁড়ি, আগুনমুখা, পদ্মা নানান নামের চালাচালির মূর্খ চেহারাটা পড়তে দেরি হলো না বোধের কবির। যামিনী রায়ের পাশে দেয়ালে আরেকটা ছবি। আস্তে হাত উঁচিয়ে জানতে চাইলেন, বলতো ওটা কি?
‘নদীর বুকের তলের ওপর আঁকা জলের দাগ’। আমার প্রম্পট উত্তরে তাঁর মুগ্ধতার চাহনি। ‘বাহ’। ছবিটার কাছে গিয়ে এবার শঙ্খ ঘোষ জানতে চাইলেন একেবারে শিশুর মতো। ‘ঢেউয়ের দাগগুলো কেমন দেখাচ্ছে?’ সাদাকালোয় ফ্রেমবন্দী নদীর বুকে ঢেউয়ের দাগতো আমার কাছে নারীর ফিগার মনে হচ্ছে। তারাশঙ্করের গোয়ালীনি ঠাকুর ঝির ফিগার। চমৎকার হাসি শঙ্খ ঘোষের। আমার এই বুদ্ধিটা তার আরও বেশি পছন্দ হয়েছে। ততক্ষণে কথা বলছিলাম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। বয়সের দুর্বলতার প্রতি শ্রদ্ধার ছলে, কবির বাম হাতটা ধরেই ছিলাম। স্পর্শ! নদীর বুকে জলের দাগ। শুনে আমার হাতটা আরেকটু তার বুকের কাছে চেপে নিলেন। কবির স্বগতোক্তি- কবিতার জন্য নদী, কবির জন্য নদী। নদী ছাড়া কবি পূর্ণ হয় না। আমার নদীটা বানারিপাড়ায়। আমার নদীর নাম ‘সন্ধ্যা’।
অটোগ্রাফের জন্য খাতাটা বাড়িয়ে কলমটা আঙ্গুলে বাঁধিয়ে দিলাম। কবি অসহায় ভঙ্গিতে বললেন, ‘প্রকাশের দুটি শক্তিই আমার অচল, কথা বলতে পারি না, লিখতেও না।’ তবে যে এই এক ঘণ্টা এতসব কথা! আমিতো সব শুনলাম, বুঝলাম। আড্ডাও তো হলো, শুধু আওয়াজটা কম। কবি বললেন, ‘হয়তো তুমি বাংলাদেশ বলে কান পেতেছো’।
বাংলাদেশ অনেক মিস করেন? চোখে মুখে হাসি। নিজের ডান হাতটা বুকের বামপাশে ধীর গতিতে নিয়ে বললেন, ‘বুকের ভেতরেই বাংলাদেশ, ওখানেই তো বাস করি!’
মুন্নী সাহা: প্রধান নির্বাহী সম্পাদক, এটিএন নিউজ
[এই লেখাটি ২০১৯ সালের ১৮ মে সারাবাংলায় প্রকাশ হয়। কবি শঙ্খ ঘোষের মহাপ্রয়াণে আজ আবার লেখাটি পাঠকদের জন্য পুনঃপ্রকাশ করা হলো]
সারাবাংলা/পিটিএম
ওখানেই বাস করি কবি শঙ্খ ঘোষ বুকের ভেতরে বাংলাদেশ মুন্নী সাহা