ঢাকা: স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে বাংলাদেশ। লক্ষ্য এখান থেকে আরও দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে যুক্ত হওয়া। সেটি সম্ভব করতে হলে দেশের তরুণ প্রজন্মকে স্বপ্ন দেখাতে হবে বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) পরিচালক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। এই স্বপ্নকে তিনি বলছেন ‘বাংলাদেশ ড্রিম’।
তার অভিমত, এই ‘বাংলাদেশ ড্রিম’ তৈরি করে তরুণদের আকৃষ্ট করা গেলে তারা নিজেদের গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশ গড়ার কাজে মনোযোগী হতে পারে। তাতে মেধা পাচারের প্রবণতা কমলে সেই মেধা দেশের কাজেই লাগবে। আর এসব সম্ভব করতে হলে চারটি বিষয়ে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে— অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদন।
সারাবাংলার সঙ্গে একান্ত আলাপে এসব কথা বলেন ঢাবি অধ্যাপত ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি মনে করেন, এখন থেকেই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে রূপরেখা তৈরি করে কাজ শুরু করতে পারলে ২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশে রূপান্তরের লক্ষ্য অর্জন মোটেও কঠিন হবে না।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের যে অর্থনৈতিক অগ্রগতি, তার কারণেই বাংলাদেশে বিশ্বে গুরুত্ব পাচ্ছে। এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে পারলে আমাদের গুরুত্ব আরও বাড়বে। সেজন্য আমাদেরকে ‘বাংলাদেশ ড্রিম’ তৈরি করতে হবে। এর মূল কথা হলো তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে হবে।
এখনকার তরুণদের বড় একটি অংশেরই লক্ষ্য উচ্চ শিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাওয়া। অনেকের জন্যই ইউরোপ-আমেরিকার দেশে যাওয়াটা স্বপ্নের সমতুল্য। এ লক্ষ্য যাদের পূরণ হয়, অর্থাৎ উচ্চ শিক্ষার জন্য যারা দেশের বাইরে যান, তাদের বড় একটি অংশই আর শেষ পর্যন্ত দেশে ফিরে আসেন না। ফলে তার মেধা, তার দক্ষতাটি প্রত্যক্ষভাবে দেশের কোনো কাজেই লাগে না।
ড. ইমতিয়াজ মনে করছেন, বাংলাদেশকেই এমনভাবে রূপান্তরিত করতে হবে, যেন তরুণদের দেশের বাইরে যাওয়ার যে স্বপ্ন, সেই জায়গাটি দখল করে নেয় বাংলাদেশই। অর্থাৎ দেশকে ঘিরেই যেন আবর্তিত হয় তার স্বপ্ন। দেশেই উচ্চ শিক্ষা নিয়ে নিজেকে গড়া এবং এরপর দেশের জন্য কাজ করা— এমন স্বপ্ন তরুণদের মধ্যে তৈরি হওয়ার উপযোগী পরিবেশ গড়ার তাগিদ দিচ্ছেন সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের এই পরিচালক। আর সেটিকেই তিনি বলছেন ‘বাংলাদেশ ড্রিম’। সেটি বাস্তবায়েনের জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও বিনোদন— এই চারটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে হবে বলে মত তার।
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ বলেন, অবকাঠামো উন্নয়নে ক্ষেত্রে এমন যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে যেন চট্টগ্রাম থেকে আধা ঘণ্টার মধ্যে কেউ ঢাকায় এসে তার কাজটি করে আবার আধা ঘণ্টার মধ্যে ফিরে যেতে পারে। এর প্রধান লক্ষ্য হলো ঢাকার ওপর থেকে চাপ কমানো। ঢাকার ওপর চাপ কমলে ঢাকায় সেবার মানও বাড়বে। তাছাড়া উন্নত অবকাঠামো সহজেই মানুষকে আকৃষ্ট করে। ফলে অবকাঠামো উন্নয়নে সাফল্য দেখাতে পারলে তরুণ প্রজন্মের বিদেশমুখী প্রবণতা কমবে। তারা দেশেই থাকবে, দেশের জন্য কাজ করবে। তরুণরাই তখন দেশ গড়বে।
শিক্ষার জন্য তহবিল গড়ার আহ্বান জানিয়ে অধ্যাপক ইমতিয়াজ বলেন, গৎ বাঁধা শিক্ষা নয়, প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি বিভাগে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বিদেশি পণ্ডিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়ে আসতে হবে। উচ্চ শিক্ষার মান যেখানে ভালো, সেখানকার সঙ্গে শিক্ষা বিনিময়ের ব্যবস্থা করতে হবে। তবেই শিক্ষার মান বাড়বে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষায় আমরা কতটা পিছিয়ে রয়েছি, করোনাভাইরাস সংক্রমণ সেটি আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ। তিনি করোনা মোকাবিলায় পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত ও স্মার্ট হাসপাতালগুলো ফেল করেছে। অথচ ভিয়েতনাম ও চীনের হাসপাতালগুলো ঠিকই করোনা নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পেরেছে। আর তারা সেটি করতে পেরেছে কারণ জনস্বাস্থ্যকে তারা ততটা গুরুত্ব দিয়েছে। আমাদেরও জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে না পারলে আমার অনেক পিছিয়ে যাব।
এসব কিছুর সঙ্গে বিনোদনকেও অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করেন ড. ইমতিয়াজ। তিনি বলেন, এসবের সঙ্গে বিনোদনের সুযোগ রাখতে হবে। কারণ সুস্থ বিনোদনই মানুষকে চাঙ্গা করতে পারেন। বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকলে মানুষকে দিয়ে কেবল কাজ করানো, সেটি কঠিন। এটা না হলে তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগানো যাবে না।
আর যা কিছুই করা হোক না কেন, তরুণদের মধ্যে স্বপ্ন ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টিতে গুরুত্ব আরোপ করছেন ড. ইমতিয়াজ আজমেদ। তিনি বলেন, তরুণদের স্বপ্ন দেখাতে না পারলে কখনোই উন্নত হওয়া যাবে না। আবার স্বপ্ন দেখানোর পাশাপাশি সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথও থাকতে হবে। এমনটা করতে পারলেই তরুণরা আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা যাওয়ার স্বপ্নে ঘুরপাক খাবে না। বরং তখন অন্য দেশের তরুণরা এই দেশে আসার স্বপ্ন বুনবে। আর আমাদের প্রকৃত উন্নয়ন ঘটবে তখনই।