খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ঘরে-ঘরে যাচ্ছে পুলিশ
২২ এপ্রিল ২০২১ ২০:১০
চট্টগ্রাম ব্যুরো : এ এক বিশাল কর্মযজ্ঞ! প্রায় অর্ধশত পুলিশ সদস্য এ কর্মযজ্ঞে শামিল। আছেন ঊর্ধ্বতনরাও। কেউ চালের বস্তা ট্রাক থেকে নামাচ্ছেন। কেউ আবার চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী প্যাকেটে ভরছেন। দিনভর এ কর্মযজ্ঞের পর এই পুলিশ সদস্যরাই আবার মধ্যরাতে সে সব প্যাকেট নিয়ে পৌঁছে যাচ্ছেন ‘কঠোর লকডাউনে’ বিপর্যস্ত হয়ে পড়া মানুষের ঘরে-ঘরে।
নগরীর বন্দর রিপাবলিক ক্লাবের সুবিশাল হল রুমে এ কর্মযজ্ঞের উদ্যোক্তা চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান। সঙ্গে আছেন বন্দর জোনের অধীন বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গা ও কর্ণফুলী থানার পুলিশ সদস্যরা। করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের মুখে সরকারের ঘোষিত ‘লকডাউনের’ শুরু থেকেই এ কাজের সূচনা হয়েছে। সিএমপিতে বন্দর জোনের পক্ষ থেকেই প্রথম এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
গত ১৫ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়া এ মানবিক সহায়তার প্রথম ধাপ এরইমধ্যে শেষ হয়েছে। বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) থেকে শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ধাপের কার্যক্রম।
নগর পুলিশের উপ-কমিশনার (ডিসি-বন্দর) এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম ধাপে আমরা ৬ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া শেষ করেছি। দ্বিতীয় ধাপে আরও ৬ হাজার পরিবারকে আমরা এই সহায়তা দেব। লকডাউন অব্যাহত থাকলে আমরা পরবর্তীতেও এই মানবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখব বলে আশা করছি।’
সকালে বন্দর রিপাবলিক ক্লাবে গিয়ে দেখা যায়, ট্রাকে ভরে কুষ্টিয়া থেকে এসেছে চাল। সেই চাল ট্রাক থেকে নামিয়ে হল রুমে নিচ্ছেন পুলিশ সদস্যরা। হল রুম জুড়ে চাল, ডাল, আলু, পেঁয়াজের বস্তা, সাবান, সয়াবিন তেল-লবণের কার্টন থরে থরে সাজানো। সিএমপি লোগো সংবলিত আলাদা প্যাকেটে সেখান থেকে খাদ্যসামগ্রী নেওয়া হচ্ছে। প্রতি পরিবারের জন্য আলাদাভাবে প্যাকেট করা হচ্ছে।
নগর পুলিশের বন্দর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার অলক বিশ্বাস সারাবাংলাকে জানান, প্রতি প্যাকেটে আটটি করে আইটেম আছে। এগুলো হচ্ছে চাল, ডাল, পেঁয়াজ, আলু, লবণ, সয়াবিন তেল, ছোলা এবং সাবান। প্রতিটি প্যাকেটে যে পরিমাণ সামগ্রী দেওয়া হচ্ছে তাতে চারজনের একটি পরিবার অন্তত ১৫ থেকে ২০ দিন চলতে পারবে।
ডিসি এস এম মেহেদী হাসান জানিয়েছেন, প্রথম ধাপে সব পণ্য মিলিয়ে ১০০ মেট্রিকটন এরইমধ্যে বিলি হয়ে গেছে। এর মধ্যে চাল ৬০ টন, ডাল ও পিঁয়াজ ৬ টন করে এবং আলু আছে ১২ মেট্রিক টন। দ্বিতীয় ধাপের জন্য সংগ্রহ করা হয়েছে আরও ১০০ মেট্রিক টন পণ্য।
কারা পাচ্ছেন এ সহায়তা? নগর পুলিশের সহকারী কমিশনার (বন্দর জোন) কীর্তিমান চাকমা সারাবাংলাকে জানালেন, প্রত্যেক থানার আওতায় পুলিশ বিটের অফিসারদের মাধ্যমে অলিগলি, পাড়া-মহল্লা, কলোনিতে ঘুরে ঘুরে তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তালিকায় আছেন লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়া পরিবহন শ্রমিক, রিকশা চালক, সিএনজি অটোরিকশা চালক, দিনমজুর, বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার শ্রমিক, ভিক্ষুক, প্রতিবন্ধী, কর্মহীন গৃহিণীসহ হতদরিদ্ররা। প্রতি রাতে একেকটি থানার আওতায় অন্তত দেড়’শ পরিবারে পৌঁছানো হচ্ছে এ সহায়তা।প্রতিদিন মধ্যরাতে সংশ্লিষ্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) তত্ত্বাবধানে শুরু হয় মানুষের ঘরে ঘরে সহায়তা পৌঁছানোর কার্যক্রম। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে এ কার্যক্রম ঊর্ধ্বতনরাও। যে সব পুলিশ সদস্য সহায়তা নিয়ে যান, তাদের প্রতি কড়া নির্দেশ আছে কেউ যেন সাহায্যগ্রহীতার কোনো ছবি না তোলেন। এ সংক্রান্ত কোনো ছবি যাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা না হয়।
ডিসি এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যাদের সহায়তা দিচ্ছি তাদের অনেকেই হতদরিদ্র, আবার অনেকে লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়া। যত দরিদ্রই হোক, প্রত্যেকের আত্মসম্মান আছে। তাদের সহায়তা দিয়ে আবার সেই ছবি প্রচার করে আমরা আত্মসম্মানে আঘাত দিতে চাই না।’
ইপিজেড থানার ওসি উৎপল বড়ুয়া সারাবাংলাকে বলেন, ‘সহায়তা পেয়ে অনেক পরিবারে আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। কয়েকদিন আগে আমার এলাকায় একটি কলোনিতে এক বাসার লোকজন আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেন। তারা বলেছেন, আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের অনেকের ভাতও জুটছে না নিয়মিত। পুলিশের আগে কেউ তাদের সাহায্য করেনি। মানুষের জন্য কিছু করতে পেরে আমাদের নিজেদের কাছেও ভালো লাগছে।’
বন্দর থানার ওসি নিজাম উদ্দিন সারাবাংলাকে বলেন, ‘আমরা যে তালিকা করেছি, সেখানে সবার পূর্ণাঙ্গ ঠিকানা, মোবাইল নম্বর লেখা আছে। সেই অনুযায়ী আমাদের থানার বিভিন্ন টিম পৌঁছে যাচ্ছে তাদের ঘরে সহায়তা সামগ্রী নিয়ে। পবিত্র রমজান মাসে এ সহায়তা পেয়ে তাদের মধ্যে যে আবেগ, গরিব মানুষগুলোর যে অনুভূতি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’
বিপুল পরিমাণ এ খাদ্যসহায়তার খরচের যোগান কোত্থেকে আসছে, জানতে চাইলে ডিসি এস এম মেহেদী হাসান সারাবাংলাকে বলেন, ‘প্রথমে আমরা বন্দর জোনের অফিসার এবং পুলিশ সদস্যরা মিলে একটি তহবিল গঠন করে খাদ্যসামগ্রী কেনা শুরু করে দিই। এরপর বিভিন্ন জায়গা থেকে, এমনকি চট্টগ্রামের বাইরে থেকেও বিত্তবানরা, ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে শুরু করেন সহযোগিতা দিতে। সবাই তো দান-খয়রাত করেন, সেটা এবার আমাদের মাধ্যমে করছেন অনেকে।’
তবে কারও কাছ থেকে নগদ টাকা গ্রহণ করা হচ্ছে না জানিয়ে পুলিশ কর্মকর্তা মেহেদী বলেন, ‘অনেকে টাকা দিতে চাচ্ছেন, আমরা নিচ্ছি না। নগদ টাকা নিলে বদনাম হয়। আমরা বদনামের ভাগিদার হতে চাই না। আমরা পণ্য কিনছি, বিলটা পাঠিয়ে দিচ্ছি, যিনি দিতে আগ্রহী, সেই সহৃদয় ব্যক্তির কাছে। তিনি বিল পরিশোধ করছেন। কুষ্টিয়া থেকে চাল এনেছি দুই দফা, আমরা নিজেরা কোনো টাকা লেনদেন করিনি। এভাবে আমরা আশা করছি, দেশের বিত্তবানরা দরিদ্র মানুষকে সহায়তায় এগিয়ে আসবেন। তাদের সহায়তায় আমরা মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমি বন্দর কর্তৃপক্ষকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তাদের তাদের ক্লাবটি বিনা ভাড়ায় আমাদের ব্যবহার করতে দিয়েছেন।’
সিএমপির বন্দর বিভাগের উপ-কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান এর আগে দক্ষিণ বিভাগে দায়িত্ব পালন করেছেন। গতবছর করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর একইভাবে দক্ষিণ বিভাগের চার থানার অধীনে প্রায় ২৫ হাজার পরিবারকে মানবিক সহায়তা দিয়েছিল পুলিশ।
সে সময় দক্ষিণ জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনারের দায়িত্ব পালন করা শাহ মো. আব্দুর রউফ সারাবাংলাকে বলেন, ‘ডিসি মেহেদী হাসান স্যারের নেতৃত্বে গত বছর আমরা প্রায় ২৫ হাজার পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দিয়েছিলাম। সে সময় শুধু হতদরিদ্র নয়, কর্মহীন হয়ে পড়া বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষকে আমর সহায়তা দিয়েছিলাম। প্রায় এক লাখ মানুষ আমাদের এ সহায়তা পেয়েছিল।’
সারাবাংলা/আরডি/একে