রানা প্লাজা ধস: ৮ বছরেও শেষ হয়নি তিন মামলার বিচার
২৪ এপ্রিল ২০২১ ১০:১৮
ঢাকা: আট বছর আগে আজকের দিনে ধসে পড়েছিল সাভারের রানা প্লাজা। বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা নিয়ে গড়ে ওঠা ভবনটিতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ সেই দুর্ঘটনায় হারিয়ে যায় এক হাজার ১৩৬টি তরতাজা প্রাণ। আহত হন আরও প্রায় দেড় হাজার মানুষ। এত প্রাণহানির পেছনে দায় যাদের, তাদের বিচার শেষ হয়নি আট বছরেও।
ভবন ধসে বিপুলসংখ্যক মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনায় ওই সময় মোট চারটি মামলা করা হয়। এর মধ্যে অবহেলার কারণে মৃত্যু উল্লেখ করে হত্যা মামলা দায়ের করে পুলিশ, ইমারত নির্মাণ আইন না মেনে ভবন নির্মাণ করায় একটি মামলা করে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এবং ভবন নির্মাণে দুর্নীতি ও সম্পদের তথ্য গোপন সংক্রান্ত দু’টি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
এর মধ্যে কেবল দুদকের দায়ের করা মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। এর বাইরে ভবন নির্মাণে দুর্নীতির মামলাটিও বিচার কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে। বাকি দু’টি মামলার কার্যক্রমই থমকে রয়েছে। মামলা দু’টিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু আসামিদের করা অবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকায় বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারছেন না বিচারিক আদালত।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা ও ইমারত আইনের মামলা দু’টি বিচারের জন্য প্রস্তুত হয় ২০১৬ সালে। একই বছরের ১৫ মার্চ মামলা দু’টি বিচার ও নিষ্পত্তির জন্য ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ এবং বিচারিক আদালতে পাঠানো হয়। একই বছরের ১৬ জুন ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ১৮ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন ঢাকার অতিরিক্ত মুখ্য বিচারিক হাকিম মুস্তাফিজুর রহমান। এরপর ১৮ জুলাই হত্যা মামলায় ভবন মালিক সোহেল রানাসহ ৪১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন তৎকালীন ঢাকার জেলা ও দায়রা জজ এসএম কুদ্দুস জামান।
তবে অভিযোগ গঠনের আদেশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে আট আসামি হাইকোর্টে আবেদন করেন। শুনানি শেষে প্রথমে আট জনের পক্ষেই স্থগিতাদেশ দেন আদালত। পরে ছয় জনের স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। বহাল থাকে সাভার পৌরসভার ওই সময়কার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ এবং কাউন্সিলর মোহাম্মদ আলী খানের পক্ষের স্থগিতাদেশ।
বর্তমানে রানা প্লাজা হত্যা মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য রয়েছে। কিন্তু আসামি মোহাম্মাদ আলী খান ও রেফায়েত উল্লাহর পক্ষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ থাকায় মামলার কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে, ২০১৫ সালের ১ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সহকারী পুলিশ সুপার বিজয় কৃষ্ণ কর হত্যা ও ইমারত নির্মাণ আইনের আলাদা দুই মামলায় ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।
ইমারত নির্মাণ আইনের অভিযুক্ত আসামিরা হলেন- ভবন মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আব্দুল খালেক ওরফে কুলু খালেক, মা মর্জিনা বেগম, সাভার পৌরসভার মেয়র রেফায়েত উল্লাহ, কাউন্সিলর মোহাম্মাদ আলী খান, উপ-সহকারী প্রকৌশলী রাকিবুল হাসান রাসেল, নিউওয়েব বাটন লিমিটেডের চেয়ারম্যান বজলুস সামাদ আদনান, সাইট ইঞ্জিনিয়ার মো. সারোয়ার কামাল, আমিনুল ইসলাম, নিউওয়েব স্টাইলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদুর রহমান তাপস, ইথার টেক্সটাইলের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান ওরফে আনিসুজ্জামান, সাভার পৌরসভার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা উত্তম কুমার রায়, প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম, গার্মেন্টস ব্যবসায়ী মাহবুবুল আলম, সাবেক সহকারী প্রকৌশলী মাহবুবুর রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ ফারজানা ইসলাম, নান্টু কন্ট্রাক্টার এবং রেজাউল ইসলাম।
দুই মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা, তার বাবা আবদুল খালেক ওরফে খালেক কুলুসহ ৫৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে আসামিদের মধ্যে ১৭ জনের নাম উভয় মামলার অভিযোগপত্রে উল্লেখ থাকায় ব্যক্তি হিসেবে আসামি ৪২ জন। এর মধ্যে হত্যা মামলায় ৪১ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ৫৯৪ জনকে। ইমারত নির্মাণ আইনের মামলায় ১৮ জনকে আসামি করা হয়েছে এবং সাক্ষী করা হয়েছে ১৩৫ জনকে।
অন্যদিকে নকশাবহির্ভূত ভবন নির্মাণের অভিযোগে ২০১৪ সালের ১৫ জুন সাভার থানায় ১৭ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে দুদক। মামলাটি চার্জশিটে ১২ আসামির কথা উল্লেখ করা হয়। সোহেল রানা ছাড়া অন্য ১১ জনই এখন জামিনে আছেন। এ মামলাটি বর্তমানে অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মারুফ চৌধুরীর আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়ে আদেশ দাখিলের জন্য তারিখ রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট আদালতের এডিশনাল পাবলিক প্রসিকিউটর মো. আনোয়ারুল কবীর জানান, মামলা দুইটি সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে এসে থমকে গেছে। আসামিপক্ষ স্থগিতাদেশ না যাওয়া পর্যন্ত মামলার কার্যক্রম স্থগিত থাকবে। এটা সম্পূর্ণ উচ্চ আদালতের বিষয়। আমাদের কাছে নির্দেশ আশা মাত্র সাক্ষ্যগ্রহণ নেওয়া শুরু করব। তবে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি ও উচ্চ আদালতে স্থগিতাদেশের জন্য মামলা দুইটির বিচার একটু বিলম্ব হয়েছে। আশা করছি, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার হলে আবারও মামলাটির বিচারকাজ শুরু হবে।
এ বিষয়ে কথা হয় আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আহাম্মদের সঙ্গে। তিনি বলেন, রানা গত ৮ বছর ধরে জেল হাজতে রয়েছে। দুই আসামির পক্ষে হাইকোর্টে স্থগিতদেশ থাকার কারণে মামলার কার্যক্রম এগোচ্ছে না। রাষ্ট্রপক্ষ চাইলে স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট করে মামলার কার্যক্রম শুরু করতে পারে। মামলার রায়ে যা হওয়ার তাই হবে। এভাবে বিনা বিচারের ৮ বছর জেলে থাকা মানবিক দিক থেকে অন্যায়। তাই রাষ্ট্রপক্ষ স্থগিতাদেশ কাটিয়ে দ্রুত বিচারের দিকে এগিয়ে যাওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, একমাত্র রানাই জেল হাজতে রয়েছে। বাকি সবাই জামিনে রয়েছেন। আশা করি রায়ে তিনি খালাস পাবেন, কারণ এটা একটা দুর্ঘটনা মাত্র।
এই তিন মামলার বাইরে রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগে দুদকের দায়ের করা মামলাটিই কেবল নিষ্পত্তি হয়েছে। এ মামলায় ২০১৭ সালের ২৯ আগস্ট সোহেল রানাকে তিন বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা এবং অনাদায়ে আরও তিন মাসের কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার বিশেষ জজ-৬-এর বিচারক।
সারাবাংলা/এআই/এসএসএ