করোনায় বেড়েছে অর্থসংকট, নারীর ঘরের কাজের চাপ হয়েছে দ্বিগুণ
২৪ এপ্রিল ২০২১ ১৭:৫৯
ঢাকা: করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর পর দেশে ২০২০ সালে ৪৮ দশমিক ৪৯ শতাংশ পরিবার থেকে অন্তত একজন কাজ হারিয়েছেন বা কাজ পাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। অন্যদিকে, শহরের ৭৩ দশমিক ৩ শতাংশ ও গ্রামের ৯২ দশমিক ৫ ভাগ মানুষ কাজ হারিয়ে অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছেন। এই সময়ে নারীর ঘরে কাজের পরিমাণ এতটাই বেড়েছে যে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৩ থেকে ৫ ঘণ্টার কাজ ৬/৭ বা ৮ ঘণ্টাতেও পৌঁছে গেছে। অর্থাৎ কোনো কোনো ক্ষেত্রে নারীকে আগের তুলনায় দ্বিগুণ কাজ করতে হয়েছে।
শনিবার (২৪ এপ্রিল) ‘বাংলাদেশে ২০২০-এ করোনা চলাকালে সংসারের সেবাকাজের দ্রুত বিশ্লেষণ’ শীর্ষক এক জরিপ ভার্চুয়ালি উপস্থাপনের সময় এসব তথ্য উঠে আসে। মহামারির সময়ে গ্রাম ও শহরের পরিবারগুলোতে কত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, দারিদ্র্যের হার কতটা বেড়েছে, নারীর আয় কতটা কমেছে, ঘরে নারী-পুরুষের কাজের আনুপাতিক হিসাব ইত্যাদি তুলে ধরার লক্ষ্যে জরিপটি চালানো হয়।
অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংস্থা, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), অক্সফাম ও মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন— এই পাঁচ সংস্থার সমন্বয়ে গঠিত ফোরাম ‘ফরমাল রিকগনিশন অব দ্য উইম্যান’স আনকাউন্টেড ওয়ার্ক’-এর উদ্যোগে জরিপটি করা হয়। এটি পরিচালনা ও তৈরি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মী।
জরিপে অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের ৭৬ শতাংশ বলেছেন, মহামারির সময় তাদের পরিবারের আয় কমে গেছে। ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা উপার্জনকারী ব্যক্তিদের মধ্যে শতকরা ৬৮ জনের আয় কমেছে। এর অর্থ এই মানুষগুলো দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছেন। ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা উপার্জনকারীদের ৭৩ শতাংশের আয়ও কমে গেছে। দেখা গেছে, কৃষিনির্ভর পরিবারগুলোর অবস্থা কিছুটা ভালো থাকলেও যারা অকৃষি কাজে যুক্ত, অর্থাৎ শ্রমজীবী, তাদের অবস্থা বেশি খারাপ।
জরিপে উঠে এসেছে, ৭৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ নারীপ্রধান পরিবার অর্থনৈতিক অনটনে পড়েছে। এদের মধ্যে অধিকাংশই অনানুষ্ঠনিক খাতের। নারীদের অনেকেই কাজ বা চাকরি হারিয়েছেন। পাশাপাশি বেড়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায় ঘরের কাজের চাপ। সার্বিক অর্থনৈতিক সংকটে এসব সেবা কাজকে আলোচনায় আনার কারণ, কারণ বাংলাদেশে কাজে নিযুক্ত মানুষের মধ্যে ৯১ দশমিক ৩ শতাংশ অনানুষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন। তাদের ৯৬ দশমিক ৭ শতাংশ নারী।
জরিপে আরও উঠে এসেছে, রান্না করা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও ধোয়ার কাজ গ্রামীণ নারীর মতো শহুরে নারীদেরও বেড়েছে। তবে তুলনামূলকভাবে এই কাজের চাপ বেড়েছে শহুরে নারীদের মধ্যে— এর পরিমাণ ১২৮ শতাংশ। শতকরা ৮৫ ভাগ কর্মজীবী নারী অমূল্যায়িত গৃহস্থালী কাজে অনেকটা সময় দিয়েছেন এবং সেটা ৪ ঘণ্টারও বেশি। শহরের নারী উত্তরদাতাদের কাছে গৃহস্থালী কাজের মধ্যে প্রথম দিকে আছে স্বামীর সেবা করা। এরপর আছে সন্তান ও পরিবারের অন্যদের দেখাশোনা করা।
জরিপের তথ্য অনুযায়ী, করোনার আগে গৃহিণীদের ৭১ দশমিক ৫ শতাংশ সাধারণত ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা সময় অমূল্যায়িত গৃহস্থালী কাজে ব্যয় করতেন। করোনাকালে এসে এদের ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশের কাজের সময় বেড়েছে। সেটি ৬/৭ ঘণ্টা থেকে শুরু করে ৮ ঘণ্টাতেও পৌঁছেছে কারও কারও ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ঘরের কাজে আগের তুলনায় অনেক নারীকেই দ্বিগুণ সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এই সময়ে ঘরের কাজে পুরুষের অংশগ্রহণও বেড়েছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় কমিটির সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমাদের দেখতে হবে এই অনানুষ্ঠানিক কাজকে আমরা কিভাবে জাতীয় ডেটাবেজে সন্নিবেশিত করতে পারি। আমরা নারীর এই শ্রমকে আসছে অর্থবছরের এসএনএ-তে যোগ করতে চাই্। নারী যে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষায় কাজ করছে, সেটারও মানিটারি ভ্যালু বের করতে হবে।’
এদিকে, করোনাকালে সন্তান যখন অনলাইনে ক্লাসে অংশ নিয়েছে তখন শহরের ৩৪ দশমিক ৪ শতাংশ মা সন্তানকে সহযোগিতা করেছেন, গ্রামে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ জন বাবা তাদের সন্তানদের টিভির মাধ্যমে পড়ালেখা করতে সাহায্য করেছেন বলেও উঠে এসেছে জরিপে।
২০২০ সালের নভেম্বরে করোনা সংক্রমণের মধ্যেই জরিপের কাজ শুরু হয়েছিল। জরিপ চলে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত। দেশের ৯টি জেলায় শহরের ও গ্রামের বিভিন্ন পেশা ও বয়সের মধ্যে জরিপটি চালানো হলেও জরিপের পরিপ্রেক্ষিতের কথা ভেবে নারী উত্তরদাতার সংখ্যা বেশি ধরা হয়েছে। উত্তরদাতাদের ৮৭ শতাংশ নারী, ১৩ শতাংশ পুরুষ, ১ শতাংশ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। তাদের মধ্যে ২১৯ জন গ্রামের, ২২৪ জন শহরের। জরিপে অংশ নেওয়া ৫৮ শতাংশের বয়স ৩১ থেকে ৪৫ বছরের মধ্যে। উত্তরদাতাদের মধ্যে ৪৭ শতাংশ গৃহিণী, বাকিরা অন্যান্য পেশায় যুক্ত।
অনুষ্ঠানে সংসদ বিশেষ অতিথি ছিলেন ইউএন উইম্যানের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ সোকো ইশিকাওয়া। জরিপের ওপর আলোচনা করেন সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন ও সরকারের অর্থ বিভাগের উপসচিব মেহেদী মাসুদুজ্জামান। আরও বক্তব্য রাখেন বিএনপিএসের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর, অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর সারাহ কবীর ও সার হল, উইম্যান এমপাওয়ারমেন্ট অ্যান্ড কেয়ার প্রোগ্রামের ম্যানেজার, অক্সফাম, গ্রেট ব্রিটেন। সভাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম।
সারাবাংলা/এসএসএস