এবার বেশি দামে ধান-চাল কিনবে সরকার
২৫ এপ্রিল ২০২১ ২০:১৪
ঢাকা: বছরজুড়ে করোনাভাইরাসের প্রকোপ ও দফায় দফায় প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে গত বোরো ও আমন মৌসুমে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে কাঙ্ক্ষিত ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। দুর্যোগ সামলাতে চালের মজুতও তলানিতে। পরিস্থিতি বিবেচনায় খাদ্যশস্যের মজুত বাড়াতে এবার বেশি দামে মিলার ও কৃষকদের কাছ থেকে ধান-চাল কেনার চিন্তাভাবনা করছে সরকার। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার জানিয়েছেন, দু’একদিনের মধ্যেই এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসতে পারে।
জানা যায়, খাদ্যশস্যের মজুত বাড়ানোর ব্যাপারে সম্প্রতি একটি ভার্চুয়াল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারন কমিটি আয়োজিত ওই বৈঠকে, বোরো মৌসুমে স্থানীয় পরিবেশকদের কাছ থেকে সিদ্ধ ও আতপ চাল মিলিয়ে সাড়ে ১১ লাখ মেট্রিক টন চাল ও কৃষকদের কাছ থেকে সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিক টন ধান সংগ্রহের একটি প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, এবার প্রতি-কেজি সিদ্ধ চাল ৪০ টাকা, আতপ চাল ৩৯ টাকা এবং ২৮ টাকা প্রতি কেজি দরে ধান কেনার বিষয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ বাজার থেকে ১ লাখ টন গম কেনার বিষয়েও কথা হয়।
তিনি জানান, চলতি মাস থেকেই ধান-চাল কেনার কাজ শুরুর কথা রয়েছে। অর্থাৎ গত বছরের চেয়ে প্রতি কেজি সিদ্ধ চালে চার টাকা, আতপ চালে তিন টাকা এবং ধানে কেজি প্রতি এক থেকে দুই টাকা বাড়িয়ে সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করতে যাচ্ছে সরকার।
ওই বৈঠকে যুক্ত থেকে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারও বলেন, মজুত বাড়াতে এবার সংগ্রহ মূল্য বাড়ানোর চিন্তা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অটো মেজর অ্যান্ড হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী সারাবাংলাকে জানান, এখনো ধান পুরোপুরি সংগ্রহ করা হয়নি। ধান কাটা শেষ হলে বোঝা যাবে কৃষকদের কাছ থেকে আমরা কত টাকায় কিনতে পারবো। তবে সরকার যে দাম নির্ধারণ করে দেবে তার সঙ্গে বাজারের সমন্বয় না থাকলে, এবারও ধান, চাল সংগ্রহের উদ্যোগে আমরা যুক্ত হতে পারবো না। কারণ লোকসান দিয়ে কোনোভাবেই আমরা খাদ্যশস্য সংগ্রহ করে দিতে পারবো না।
সরকারের অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য সংগ্রহের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বোরো মৌসুমে প্রতি কেজি সিদ্ধ চাল ৩৬ টাকা, আতপ চাল ৩৫ টাকা এবং ধান প্রতি কেজি ২৬ টাকা দরে কেনার মূল্য নির্ধারণ করে দেয় খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারন কমিটি। মোট ১৯ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের লক্ষ্যে গত বছরের ২৬ এপ্রিল থেকে বোরো ধান সংগ্রহ আর ৭ মে থেকে চাল সংগ্রহ শুরু হয়। পনেরো দিন সময় বাড়িয়ে দিয়ে মাত্র ৯ লাখ ৪৩ হাজার ৯০২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য কিনতে পেরেছিল সরকার। যা নির্ধারিত পরিমাণের অর্ধেকও কম। একই ঘটনা ঘটেছে আমন সংগ্রহের ক্ষেত্রে। গত বছর আমন মৌসুমে প্রতি কেজি সিদ্ধ চাল ৩৭ টাকা, আতপ চাল ৩৬ টাকা কেজি এবং প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা দরে মোট সাড়ে আট লাখ টন খাদ্যশস্য সংগ্রহের টার্গেট নিয়ে গত ৭ নভেম্বর থেকে ধান এবং ১৫ নভেম্বর থেকে চাল কেনা শুরু করে। বেঁধে দেওয়া সময় পর্যন্ত চালের আকারে মাত্র ৮৩ হাজার ২০২ মেট্রিক টন সংগ্রহ করা গেছে
এদিকে গত বছরের দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে সরকারের যা মজুত ছিল তাও শেষের দিকে। সরকারের দৈনিক খাদ্যশস্য প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত সরকারি গুদামে মাত্র ৪ দশমিক ৬৮ লাখ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য মজুত রয়েছে। এরমধ্যে ৩ দশমিক ১০ মেট্রিক টন চাল, আর ১ লাখ ৫৮ মেট্রিক টন গম। জানা গেছে, খাদ্যের মজুত কমে যাওয়ায় সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচিগুলোতে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নগদ অর্থ দেওয়া হয়েছে। সূত্র বলছে, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ধান চাল সংগ্রহ না হওয়ায় মজুত কমে গেছে।
বছর জুড়েই বাজারে চালের দাম বাড়তি ছিল। গত বছর ধাপে ধাপে কেজি প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা প্রতি কেজিতে চালের দাম বেড়েছে। একদিকে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে সংগ্রহ কম হওয়া, মজুত কমে আসা এবং বাজারে চালের দাম বাড়তি থাকার প্রেক্ষাপটে গত অক্টোবরে চাল আমদানির অনুমতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সরকারি পর্যায়ে আমদানির পাশাপাশি এ কার্যক্রমে বেসরকারি ব্যবসায়ীদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। সে উদ্দেশ্যে গত ২৭ ডিসেম্বর বৈধ আমদানিকারকদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ ১০ জানুয়ারির মধ্যে খাদ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে বলা হয়। এরপর যাচাই বাছাই শেষে ৩শ’র বেশি আমদানিকারককে চাল সংগ্রহ করতে অনুমতি দেয় খাদ্য মন্ত্রণালয়। এদের অনেকে সঠিক সময়ে ঋণপত্র বা এলসি খুলতে না পারায় তাদের বরাদ্দ বাতিল করে দেওয়া হয়। আর যাদের বরাদ্দ অনুমতি বাতিল হয়নি তাদেরকে আগামী ৩০ এপ্রিলের মধ্যে আমদানি করে চাল বাজারজাত করতে বলা হয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে মোট ১৫ লাখ ৬০ হাজার ৮৬৩ মেট্রিক টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়। গত ২১ এপ্রিল পর্যন্ত ৯ লাখ ৫৪ হাজার ৪৪৪ মেট্রিক টন চাল আমদানির এলসি খোলা হয়। যা এখন পর্যন্ত মাত্র ৬ লাখ ৫৩ হাজার ৯০১ মেট্রিক টন চাল তারা বাজারজাত করতে পেরেছে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক খাদ্য সচিব আব্দুল লতিফ মণ্ডল সারাবাংলাকে বলেন, এবার মজুত যে পর্যায়ে নেমে আসছে তা গত ১৩ /১৪ বছর আগে নেমেছিল। যখন দেশে ঘূর্ণিঝড় সিডর হানা দেয়। যদিও গত বছর করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতি এবং কয়েকদফা প্রাকৃতিক দুর্যোগে মজুতের ওপরে চাপ পড়েছে। তবে খাদ্য সংকট হবে এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখন নেই। তিনি বলেন, গত বছর যখন বোরো সংগ্রহ হয়নি তখনি সরকারের উচিত ছিল আমদানি করে মজুত বাড়ানো। কিন্তু যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো ততক্ষণে বেশ দেরি হয়ে গেছে। কারণ তখন আন্তর্জাতিক বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে।
সারাবাংলা/জেআর/এএম