হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত
২৫ এপ্রিল ২০২১ ২৩:৩৩
চট্টগ্রাম ব্যুরো: কওমি মাদরাসাভিত্তিক ‘অরাজনৈতিক’ সংগঠন হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের মাধ্যমে হেফাজতের কার্যক্রম ফের শুরু করা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির আমির জুনায়েদ বাবুনগরী।
রোববার (২৫ এপ্রিল) রাতে হেফাজত আমির হিসেবে দেওয়া সবশেষ ভিডিওবার্তায় বাবুনগরী কমিটি বিলুপ্তির এ ঘোষণা দেন। পরে ভিডিওবার্তাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হয়।
সংক্ষিপ্ত ভিডিওবার্তায় জুনায়েদ বাবুনগরী বলেন, ‘দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সবচেয়ে বড় অরাজনৈতিক সংগঠন, দ্বীনি সংগঠন, ইমান-আকিদার সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির কিছু গুরুত্বপূর্ণ সদস্যের পরামর্শক্রমে কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করা হলো। ইনশাল্লাহ আগামীতে আহ্বায়ক কমিটির মাধ্যমে আবার হেফাজতে ইসলামের কার্যক্রম শুরু হবে।’
বাংলাদেশের প্রাচীন ও সর্ববৃহৎ ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রামের আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসার মহাপরিচালক শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সূচনালগ্ন থেকে শফী সংগঠনটির আমির এবং জুনায়েদ বাবুনগরী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
২০১৩ সালে যুদ্ধারপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকারীদের নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হয় হেফাজত। এক পর্যায়ে ১৩ দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। ওই বছরের ৫ মে সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে। ঢাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার হন বাবুনগরী। পরে ছাড়া পেলেও তখন থেকেই তিনি প্রচণ্ডভাবে আওয়ামী লীগ ও সরকারবিরোধী ভূমিকা নেন।
তবে প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মহলে শাহ আহমদ শফীর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। এক পর্যায়ে শফীর সঙ্গে সরকারের বিভিন্ন মহলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। কওমি মাদরাসার ডিগ্রির সরকারি স্বীকৃতিও আসে। এভাবে শফীর নেতৃত্বে হেফাজতের একটি অংশ সরকারের বিরোধিতা থেকে সরে আসে। কিন্তু বাবুনগরীর নেতৃত্বাধীন অংশ তীব্রভাবে আওয়ামী লীগ সরকারবিরোধী এবং জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিতি পায়।
এ নিয়ে ২০২০ সালে হেফাজতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসে। এমনকি ওই বছরের সেপ্টেম্বরে হাটহাজারী মাদরাসার অভ্যন্তরে শফীর বিরুদ্ধে সহিংস ছাত্র বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভের মধ্যেই ১৮ সেপ্টেম্বর অসুস্থ হয়ে প্রায় শতবর্ষী শফী মারা যান। তার পরিবারের পক্ষ থেকে আদালতে মামলা দায়ের হয়। এতে শফীকে মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়। পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন সম্প্রতি তদন্ত করে বাবুনগরীসহ ৪২ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে।
এদিকে শফীর মৃত্যুর পর গত বছরের ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে ১৫১ সদস্যের হেফাজতের নতুন কমিটি হয়। এতে জুনায়েদ বাবুনগরীকে আমীর ও নূর হোসাইন কাসেমীকে মহাসচিব করা হয়। কাসেমী মারা যাবার পর সিনিয়র নায়েবে আমীর নুরুল ইসলামকে মহাসচিব করা হয়।
এই কমিটিতে থাকা হেফাজত নেতারা শুরু থেকেই বিভিন্ন ধর্মীয় সভায়, ওয়াজ মাহফিলে সরকার, মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করে বক্তব্য দিতে থাকেন।
এর পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের বিরোধিতা করে সহিংস পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফের আলোচনায় আসে হেফাজতে ইসলাম। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন ২৬ মার্চ থেকে শুরু করে ২৮ মার্চ পর্যন্ত রাজধানী ঢাকা, চট্টগ্রাম ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার ঘটনা ঘটে। পুলিশের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় দফায় দফায় সংঘর্ষে বেশ কয়েকজনের মৃত্যুও হয়। যদিও হেফাজত প্রধান বাবুনগরী একপর্যায়ে দাবি করেছিলেন, নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশে আগমন ঘিরে ২৬ মার্চ তাদের কোনো কর্মসূচি ছিল না।
২৬ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ পর্যন্ত হেফাজতের নাশকতা, ভাঙচুরের ঘটনায় বিভিন্ন জেলায় বেশকিছু মামলা হয়। এসব মামলায় গত কয়েকদিনে গ্রেফতার করা হয়েছে হেফাজতে ইসলামের অন্তত ডজনখানেক কেন্দ্রীয় নেতা।
এদিকে হেফাজতের সহিংসতার ঘটনার পর পরই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের রিসোর্টে নারী নিয়ে অবরুদ্ধ হন সংগঠনটির অন্যতম নেতা মামুনুল হক। এ ঘটনায় নতুন করে আলোচনায় আসেন তিনি। ওইদিন তাকে হেফাজতের স্থানীয় নেতাকর্মীরা রিসোর্ট ভেঙে ছিনিয়ে নিয়ে যায়। ঘটনার দিন সোনারগাঁও রয়েল রিসোর্টে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের আসামি করে তিনটি মামলা হয়। এর মধ্যে একটি মামলায় মামুনুল হক প্রধান আসামি। মামলা দায়েরের পর মামুনুল বেশ কিছুদিন পালিয়ে বেড়ালেও গত ১৮ এপ্রিল তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। মোহাম্মদপুর থানায় গত বছর দায়ের করা এক মামলায় বর্তমানে রিমান্ডে আছেন তিনি।
এছাড়া হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সহ-প্রচার সম্পাদক শরীফ উল্লাহকে গত ১৩ এপ্রিল গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। এর আগে ১১ এপ্রিল চট্টগ্রামের হাটহাজারী থেকে হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার করা হয়েছে হেফাজতের সহ অর্থ সম্পাদক ইলিয়াসকেও। এছাড়া হেফাজতে ইসলামের ঢাকা মহানগরীর সহ-সভাপতি জুবায়ের আহমদকে গত ১৬ এপ্রিল গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তিনি আমিনীর জামাতা।
২০ এপ্রিল হেফাজতে ইসলাম ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের যুগ্ম মহাসচিব কোরবান আলী কাসেমীকে গ্রেফতার করে ডিবি পুলিশ। আর ২৪ এপ্রিল সন্ধ্যায় গ্রেফতার করা হয় হেফাজতের নায়েবে আমির আহমদ আব্দুল কাদেরকে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বাবুনগরী বারবার গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে হেফাজতে ইসলাম সরকারবিরোধী নয় বলে প্রচার করেন। কয়েকদিন আগে হেফাজত নেতাদের একটি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখাও করেন। তবে হেফাজতের বিরুদ্ধে সরকারের অনড় অবস্থানের আভাস মিলেছে একের পর এক নেতাদের গ্রেফতার এবং মন্ত্রীদের কয়েজনের বক্তব্য-বিবৃতিতে।
এদিকে কেন্দ্রীয় নেতাদের একের পর এক গ্রেফতারের মধ্যেই হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্ত ঘোষণা করলেন বাবুনগরী। এতে করে ইসলাম ধর্মভিত্তিক দেশের বৃহত্তম সংগঠনটির কার্যক্রম স্থগিত হয়ে গেল।
সারাবাংলা/আরডি/পিটিএম