হাটহাজারীতে তাণ্ডব: বাবুনগরীর বিরুদ্ধে ২ মামলা
২৬ এপ্রিল ২০২১ ১৮:২৭
চট্টগ্রাম ব্যুরো: একমাস আগে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনের প্রতিবাদে সহিংস তাণ্ডবের ঘটনায় চট্টগ্রামের হাটহাজারী থানায় আরও তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে দু’টি মামলায় হেফাজতে ইসলামের সদ্য সাবেক আমির জুনায়েদ বাবুনগরীকে আসামি করা হয়েছে। মামলায় আসামির তালিকায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীদের নামও এসেছে।
গত বৃহস্পতিবার (২২ এপ্রিল) তিন পুলিশ সদস্য বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় পৃথকভাবে মামলা তিনটি দায়ের করেছেন। চার দিন পর সোমবার পুলিশ মামলার বিষয়ে তথ্য প্রকাশ করেছে।
চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার এস এম রশিদুল হক সারাবাংলাকে বলেন, ‘হাটহাজারী থানায় তিনটি মামলা দায়ের হয়েছে। দুইটিতে বাবুনগরী সাহেবকে প্রধান আসামি করা হয়েছে। আরেকটিতে ভিন্ন আসামি। গত ২৬ মার্চ হাটহাজারীতে যে ঘটনা হয়েছে, সেই ঘটনায় মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে।’
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গত ২৬ মার্চ বাংলাদেশ সফরে আসেন নরেন্দ্র মোদি। এর প্রতিবাদে ওই দিন দুপুরে হেফাজতে ইসলামের মূল ঘাঁটি হাটহাজারীর আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলুম মইনুল ইসলাম মাদরাসা থেকে মিছিল বের হয়। মিছিলকারীরা হাটহাজারী থানা, ভূমি অফিস ও সরকারি ডাকবাংলোর ভেতরে ঢুকে তাণ্ডব চালান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে পুলিশ গুলি ছুঁড়লে মাদরাসার তিন ছাত্রসহ চার জন নিহত হন। এ ঘটনার পর ছাত্ররা মাদরাসার মূল ফটকের সামনে অবস্থান নিয়ে ইটের দেওয়াল তুলে দিয়ে তিন দিন ধরে সড়ক অবরোধ করে রাখে। হতাহতের প্রতিবাদে ২৮ মার্চ সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে হেফাজতে ইসলাম। ধারাবাহিক কর্মসূচির পর রোববার রাতে হেফাজতের কর্মীরা সড়ক ছেড়ে গেলে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
জানা গেছে, হেফাজতের তাণ্ডবের সময় ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত জেলা পুলিশের বিশেষ শাখার কনস্টেবল মো. সোলায়মানকে তুলে নিয়ে মাদরাসার ভেতর তিন দিন ধরে অবরুদ্ধ করে রাখেন সংগঠনটির নেতাকর্মীরা। কনস্টেবল সোলয়মান একটি মামলা দায়ের করেছেন, যাতে হেফাজতের জুনায়েদ বাবুনগরী, মীর ইদ্রিস, নাছির উদ্দিন, জাকারিয়া নোমান, আহসান উল্লাহসহ ১৬ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিভিন্ন স্পটে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় আরও দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা দায়ের করেছেন হাটহাজারী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) আমির হোসেন। এ মামলায় হেফাজত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরী, জাকারিয়া নোমান, উপজেলা জামায়াতের আমিরসহ ৭৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতনামা আড়াই থেকে তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে।
হাটহাজারী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হারুন অর রশিদ বাদী হয়ে আরেকটি মামলা দায়ের করেছেন। এতে বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য মীর হেলাল উদ্দিন, চট্টগ্রাম উত্তর জেলা যুবদলের সহ সভাপতি সৈয়দ ইকবালসহ ৫৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ২৫০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এ নিয়ে চট্টগ্রামে হেফাজতের তাণ্ডবের ঘটনায় মোট ১০টি মামলা দায়ের হলো। এর মধ্যে ৯টি মামলা চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে এবং আরেকটি মামলা পটিয়া থানায় আক্রমণের ঘটনায় দায়ের হয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিন থেকে প্রায় সপ্তাহ ধরে দেশের বিভিন্নস্থানে তাণ্ডবের ঘটনায় এরই মধ্যে হেফাজতের ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক, সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদীসহ কয়েকজন শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে জুনায়েদ বাবুনগরী বারবার গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে ‘হেফাজতে ইসলাম সরকারবিরোধী নয়’ বলে প্রচার করেন। কয়েকদিন আগে হেফাজত নেতাদের একটি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখাও করেন। তবে হেফাজতের বিরুদ্ধে প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছে।
এ অবস্থায় রোববার (২৫ এপ্রিল) রাত ১১টার দিকে আকস্মিকভাবে জুনায়েদ বাবুনগরী ফেসবুকে ভিডিওবার্তার মাধ্যমে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় কমিটি বিলুপ্তির ঘোষণা দেন। আবার এ ঘোষণার রেশ না কাটতেই রাত সাড়ে ৩টার দিকে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের ফেসবুক পেজ থেকে তিন সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কথা প্রচার করা হয়। পরে আরও দু’জনকে সদস্য হিসেবে সংযুক্ত করার কথাও জানানো হয়।
প্রবীণ ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে ২০১০ সালে হেফাজতে ইসলামের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সূচনালগ্ন থেকে শফী সংগঠনটির আমির ও জুনায়েদ বাবুনগরী মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
২০১৩ সালে যুদ্ধারপরাধীদের বিচারের দাবিতে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনকারীদের নাস্তিক-মুরতাদ আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সরব হয় হেফাজত। একপর্যায়ে ১৩ দফা নিয়ে আন্দোলন শুরু করে। ওই বছরের ৫ মে সারাদেশ থেকে ঢাকা অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে। ঢাকায় রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মধ্য দিয়ে সংগঠনটি সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার হন বাবুনগরী। পরে ছাড়া পেলেও তখন থেকেই তিনি প্রচণ্ডভাবে আওয়ামী লীগ ও সরকার বিরোধী ভূমিকা নেন। জামায়াতের ঘনিষ্ঠ হিসেবেও পরিচিতি আছে বাবুনগরীর।
গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর আহমদ শফী মারা যান। ১৫ নভেম্বর হাটহাজারী মাদরাসায় এক প্রতিনিধি সম্মেলনের মাধ্যমে নিজেকে আমির ঘোষণা করে হেফাজতে ইসলামের চূড়ান্ত নেতৃত্বে আসেন জুনায়েদ বাবুনগরী।
সারাবাংলা/আরডি/টিআর