করোনার ভয় ভেঙে মানুষের সেবায় হাত বাড়িয়েছে বৃহন্নলা
২৮ এপ্রিল ২০২১ ২০:৩১
ঢাকা: বিশ্বব্যাপী চলছে করোনা (কোভিড-১৯) মহামারি। বলতে গেলে করোনায় বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী। এর বাইরে নেই বাংলাদেশও। এই মহামারিতে অনেকেই অনেকভাবে মানুষের সেবায় এগিয়ে আসছেন। কেউ ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন, কেউ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করছেন বিনামূল্যে, কেউ আবার বাড়িয়ে দিয়েছেন সেবার হাত। তবে করোনা আক্রান্ত মানুষ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখার প্রবণতাও কম নয়। সুস্থতার জন্য কোভিড রোগী থেকে শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার পরামর্শ দেওয়া হলেও অনেক পরিবার আক্রান্ত সদস্যকেই দূরে ঠেলে দিচ্ছেন। করোনা আক্রান্ত বাবা-মাকে ফেলে যাওয়া অথবা মৃতদেহ সৎকারে অপারগতা প্রকাশের খবরও আমরা পাচ্ছি গণমাধ্যমে। এমনই নেতিবাচক খবরের ভিড়ে আশার আলো ছড়াচ্ছে বৃহন্নলা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক এই সংগঠনের সদস্যরা করোনা মাহামারিতে মানুষের প্রতি সেবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলো মহামারির ভয় তুচ্ছ করে করোনা আক্রান্ত রোগী ও তাদের স্বজনদের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের করোনা ইউনিটের সামনে ‘আমি স্বেচ্ছাসেবক, বলুন কী সাহায্য করতে পারি’— এরকম লেখা প্লাকার্ড হাতে অতন্দ্র প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। করোনা আক্রান্ত রোগী এলেই তাৎক্ষণিক সহায়তা দিচ্ছেন তারা। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এসব রোগীদের অ্যাম্বুলেন্স বা অন্যান্য যানবাহন থেকে নামানো, স্ট্রেচারে ওঠানো ও করোনা ওয়ার্ডে নিয়ে যাচ্ছেন এই মানুষগুলো। তৃতীয় লিঙ্গের এই মানুষগুলো সমাজে নানাবিধ বঞ্চনা ও অপমানের শিকার হন। স্বাভাবিক জীবনযাপনের ইচ্ছা থাকার পরও হন বঞ্চিত। ফলে বাধ্য হয়ে নামেন রাস্তায়। বাঁটতে হয় অন্যের ওপর নির্ভর করে। নিজেদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া সেসব বঞ্চনাকেই শক্তি হিসেবে নিয়েছেন বৃহন্নলার সদস্যরা। মানবতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন মুমূর্ষু মানুষের প্রতি।
স্বেচ্ছাসেবী মুনমুন জানান, তারা গতবছরও নানাভাবে করোনা মহামারি আক্রান্ত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েই যতটুকু পেরেছেন সাহায্য দিয়েছেন। সেসবের মধ্যে ছিল শিশুখাদ্য, অন্যান্য খাদ্যসামগ্রীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস। বৃহন্নলায় যুক্ত হওয়ার আগে আর দশজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের মতো তারাও রাস্তা বা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা তুলে চলতেন। এজন্য মানুষের কাছ থেকে যেমন অবহেলা পেয়েছেন আবার কিছু মানুষের ভালোবাসাও পেয়েছেন। তাই তারা দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে আজ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।
মুনমুন বলেন, ‘এখানে যারা আসেন তাদের মধ্যে কারও সঙ্গে হয়ত একজন অথবা দুজন স্বজন থাকে, আবার কারও থাকে না। সেসব মানুষের দিকে একটুখানি ভরসার হাত বাড়িয়ে দেওয়াই আমাদের উদ্দেশ্য। একা একা রোগী বা মৃতদেহ নামানো বা উঠানো অনেকের পক্ষেই সম্ভব না। তাই আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি। এছাড়াও ভর্তির ফরম কোথা থেকে, কীভাবে নিয়ে পূরণ করতে হবে সে ব্যপারে সাহায্য করি। কারও সঙ্গে লোক না থাকলে লিফট পর্যন্ত ব্যাগ বা প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও এগিয়ে দিই।’
মানুষের কাছ থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন?- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মানুষ আমাদের অনেক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করছে।’ এক রোগীর স্বজন তাদের ব্যাবহারে খুশি হয়ে নাকি বেশ কিছু টাকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তারা নেননি। এই স্বেচ্ছাসেবী বলেন, ‘আমাদের অবস্থার কথা ভেবে উনি ভালো মনে করেই টাকাটা সেধেছিলেন। কিন্তু আমরা টাকা কেন নেব? আমরা তো নিঃস্বার্থভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য এসেছি। এতেই আমাদের তৃপ্তি।’
সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠীকে স্বাভাবিক চোখে দেখা হয় না। জন্মের পর পরিবার তাদের ত্যাগ করে। জায়গা হয় না সাধারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে। তারা চেষ্টা করেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন না। এমনই একজন বৃহন্নলা শাহনাজ। ১৯৯৬ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছেন তিনি। এর পর এক প্রতিষ্ঠানের দয়াবান মালিক তাকে চাকরি দিয়েছিলেন। কিন্তু কিছুদিন চাকরি করার পর খেয়াল করলেন যে, সেখানকার সহকর্মীরা তাকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছে না। তিনি ডায়নিংয়ে খেতে গেলে কেউ কেউ উঠে যায় বা হাত দিয়ে ভাত ঢেকে ফেলে। এমনকি আশপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় নেতিবাচক মন্তব্যও করতেন কেউ কেউ। ফলে সেই চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন তিনি। পরে শাহবাগে এসে একজন গুরু মায়ের অধীনে থাকা শুরু করেন।
বৃহন্নলার সদস্যসের জীবনটা হয়তো আর দশটা হিজড়া জনগোষ্ঠীর মতোই কেটে যেত। কিন্তু শিক্ষার ছোঁয়ায় ধারালো আর মানবিক চিন্তার এই মানুষগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যোগ দেন বৃহন্নলা নামের এই সংগঠনে। ২০১৭ সালের নভেম্বর থেকে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। বর্তমানে পনেরো সদস্যের এই সংগঠনে ১০ জন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। শাহনাজ, মুনমুনদের মতো আরও পাঁচ থেকে ছয়জন পালাক্রমে প্রতিদিন এসে ঢাকা মেডিকেলের করোনা ইউনিটে সাধারণ মানুষের প্রতি সেবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
শাহনাজ জানান, তারা ক্ষুদ্র সামর্থ্য নিয়েই শারীরিকভাবে যতখানি করার তাই করছেন। সেইসঙ্গে অর্থকষ্টে আছেন এমন রোগীদের ছোটখাটো ওষুধ কিনে দেওয়া, তাদের আনা-নেওয়ার কাজও করেন। সারাদিনের জন্য ১৫০০ টাকায় একটি অটোরিকশা ভাড়া নিয়েছেন তারা। সেই অটোরিকোশার মাধ্যমেই করোনা আক্রান্ত রোগী ও রোগীর স্বজনদের আনা-নেওয়া করেন তারা। এসব কাজের জন্য রোগী বা কারও কাছ থেকেই কোনো টাকা নেন না তারা। এমনকি তারা নিজেদের ব্যবস্থাপনাতেই সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছেন। নিজেরাই স্যানিটাইজার, মাস্ক, ফেস শিল্ড, গ্লাভস, জ্যাকেট ইত্যাদি পরেন। অভাবগ্রস্তকে ওষুধ কিনে দেওয়াসহ এসব খরচের পুরোটাই আসে ডোনেশন থেকে। সেই ডোনেশনের পরিমাণও যে খুব বেশি, তা কিন্তু নয়। কিন্তু সেটুকু নিয়েই মানুষের পাশে দাঁড়িয়েই তৃপ্তি খুঁজে নিচ্ছেন অবহেলিত এই মানুষগুলো।
করোনা ইউনিটের রোগীদের পাঁশে দাঁড়াতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে প্রথমদিকে কোনো আনুষ্ঠানিক অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন হয়নি তাদের। তারা শুরুতে নিজেদের মতো কাজ শুরু করেছিলেন। কিন্তু এরই মধ্যে কিছু মিডিয়ায় খবর প্রচারিত হওয়ার পর ডাক পড়ে মেডিকেল কলেজ প্রশাসন থেকে। সেখানে প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়ে এখন মৌখিক অনুমতি নিয়েই কাজ করছেন তারা।
বৃহন্নলার এই মানবসেবা সম্পর্কে ঢাকা মেডিকেল কলেজের পরিচালজক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, ‘এই প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, তারা শিক্ষিত এবং সচেতন। সমাজের মানুষ তৃতীয় লিঙ্গ বা হিজরাদের যেভাবে দেখেন, এরা কিন্তু তেমন নয়। তাদের কাজ, কথা এবং কাগজপত্র দেখার পরেই আউটডোরে নিরাপত্তা বজায় রেখে কাজ করার অনুমতি দিয়েছি।’ তবে অনুমতি দিলেও বৃহন্নলার সদস্যদের কিছুটা পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নাজমুল হক বলেন, ‘আসলে সমাজের সবাই তো তাদের একই চোখে দেখবেন তা না। আমরা চাই না যে, তাদের কোনো আচরনে ভয় পেয়ে আমাদের এখানে রোগী আসা কমে যাক। এজন্যই তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। সবকিছু ভালো হলে ভবিষ্যতে তাদের জন্য কিছু করা সম্ভব হবে হয়তো।’
এই করোনা মহামারিতে যেখানে স্বজন পর্যন্ত হয়ে যাচ্ছে অচেনা, সেখানে নিজের জীবনের পরোয়া না করে মানুষ সেবাকে ব্রত হিসেবে নিয়ে এগিয়ে এসেছেন শাহনাজ, মুনমুনদের মতো বৃহন্নলারা। তাদের প্রত্যাশা, এই কাজের মাধ্যমে সমাজের সবাই তাদের স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে শিখুক। কারণ তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোও প্রকৃতির সন্তান। তাদেরও আছে স্বাভাবিকভাবে বাঁচার অধিকার, আছে ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার।
সারাবাংলা/আরএফ/পিটিএম