আগুনের চিহ্ন মুছে নতুন রূপে ওয়াহেদ ম্যানশন, কিছুই জানে না রাজউক
২৯ এপ্রিল ২০২১ ২৩:১০
ঢাকা: চকবাজারের চুরিহাট্টা মোড়। রাজধানীর সবচেয়ে জনাকীর্ণ ও ব্যস্ততম মোড়গুলোর একটি। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ১০টা ২০ মিনিট। হঠাৎ বিকট শব্দ। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভয়াবহ বিস্ফোরণ। ভেঙে পড়লো দেয়াল। ভবনজুড়ে দাউ দাউ আগুন। প্রায় ৯ ঘণ্টার আগুনে হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন যেন মৃত্যুপুরী। আগুনে পোড়া মরদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে এখানে-ওখানে। গলিত-অর্ধগলিত, দগ্ধ-আর্ধদগ্ধ সব শরীর। গুনতে গুনতে মরদেহ স্পর্শ করে সত্তরের ঘর। নিমতলী ট্র্যাজেডির প্রায় ৯ পর ফের আরেক ট্র্যাজেডির সাক্ষী পুরান ঢাকা।
কারণটা একই— আবাসিক ভবনে কেমিক্যালের গোডাউন, দোকান। নিমতলী ট্র্যাজেডির পর একবার প্রশাসন-পুলিশ-স্থানীয় সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা একাট্টা হয়েছিল আবাসিক ভবনে কেমিক্যালের এমন উপস্থিতি রোধে। তাতে যে শেষ পর্যন্ত কাজ হয়নি— তারই প্রমাণ হয়ে ফিরে আসে চুরিহাট্টা ট্র্যাজেডি। আগুন কেড়ে নেয় ৭০ জনের প্রাণ। ফের নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি নিয়ে গঠন করা হয় বেশ কয়েকটি তদন্ত কমিটি। এসব কমিটি থেকে বিভিন্ন সুপারিশও উঠে আসে। কোনো কমিটি ফের আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণের পরামর্শ দেয়, কোনো কমিটি আগুনে পোড়া ওয়াহেদ ম্যানসন পরিত্যক্ত ঘোষণা করে ভেঙে ফেলার সুপারিশ তুলে ধরে। একইসঙ্গে ওয়াহেদ ম্যানশনের বিপরীত দিকের রাজ্জাক ম্যানশনও ভেঙে ফেলার পক্ষে মত দেয় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষসহ (রাজউক) সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
নাহ, শেষ পর্যন্ত তেমন কোনো সুপারিশই কাজে আসেনি। এই তো সেদিনও আরমানিটোলার হাজী মুসা ম্যানশনে আগুন লেগে প্রাণ গেল ছয় জনের। সেই ভবনেও ছিল কেমিক্যালের গোডাউন। আর ওয়াহেদ ম্যানশনও ভেঙে দেয়নি কোনো সংস্থা। শুধু তাই নয়, দুই বছর পেরিয়ে এসে সম্পূর্ণ নতুন রূপে ফের দাঁড়িয়ে গেছে ভবনটি। আগুনে পুড়ে যে ভবনটি পরিণত হয়েছিল পোড়োবাড়িতে, সব ধরনের বিধিনিষেধকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে সেই ভবনটিই আজ নতুন রূপ নিতে সম্পূর্ণ প্রস্তুত! আর এ বিষয়ে কিছুই জানে না ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা রাজউকও।
চুরিহাট্টার সেই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর হাজী ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক দুই ভাই হাসান ও সোহেলকে গ্রেফতার করে পুলিশ। রাজউক তখন ভবনটি ভেঙে ফেলার সুপারিশ করে। দুই ভাই যখন কারাগারে, তখন সেই ২০১৯ সালেরই সেপ্টেম্বর মাসে ওয়াহেদ ম্যানশন মেরামতের কাজ শুরু করেন সোহেলের শ্যালক রুবেল। বিষয়টি রাজউকের নজরে এলে একটি টিম গিয়ে অবশ্য কাজ বন্ধ করে দিয়ে এসেছিল। তবে ওই পর্যন্তই। এরপর ফের একটা সময়ে ওয়াহেদ ম্যানশন মেরামতের কাজ শুরু হয়। এর সংস্কার কাজও প্রায় শেষ। বলতে গেলে আগের কাঠামোর ওপর নতুন ভবনে পরিণত হতে যাচ্ছে এটি।
স্থানীয়রা বলছেন, পোড়োবাড়ি থেকে রাজপ্রাসাদ হচ্ছে ওয়াহেদ ম্যানশন। কোনো সুপারিশ, কোনো নিষেধাজ্ঞা কাজেই আসেনি। আবাসিক এলাকা থেকে কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার কার্যক্রমেও নেই কোনো গতি।
চুরিহাট্টার ওয়াহেদ ম্যানশনে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনটি সংস্কার কাজ প্রায় শেষের দিকে। নিচতলায় রয়েছে দোকান। কোনোটি মাসিক ৬ হাজার টাকা, কোনোটি ৭ হাজার টাকা, কোনোটি আবার ৮ হাজার টাকায় ভাড়াও দেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় তলার স্পেস ভাড়া দেওয়া হলেও এখনো কাজ শেষ করা হয়নি। তৃতীয়-চতুর্থ তলার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ শেষ। ওপরের এই দুই তলায় থাকছে আবাসিক ফ্ল্যাট।
নতুনভাবে নির্মিত ওয়াহেদ ম্যানশনে দোকান ভাড়া নিয়েছেন আব্দুল জলিল নামে একজন। ভবনটির সামনেই তার সঙ্গে দেখা। সারাবাংলাকে বললেন, ‘আমরা জীবিকার তাগিদে দোকান ভাড়া নিয়েছি। সবাই নিয়েছে, তাই আমিও নিয়েছি। আর এবার মালিক বলে দিয়েছে কে কিসের জন্য ভাড়া নিচ্ছেন, দোকান করবেন নাকি গোডাউন করবেন, কী ধরনের মালামাল রাখবেন— এসব তথ্য চুক্তিপত্রে উল্লেখ থাকতে হবে।’
পাশের রাজ্জাক ম্যানশনও সংস্কার করা হচ্ছে। তবে সেটি সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে নতুন করে নির্মাণ করেছেন বাড়ির মালিক। এই ভবনটির মতোই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ওয়াহেদ ম্যানশনও পরিত্যক্ত ঘোষণা করেছিল। তাহলে রাজ্জাক ম্যানশন সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলে সংস্কার করলেও ওয়াহেদ ম্যানশন আগের অবস্থা থেকেই কিভাবে সংস্কার করা হচ্ছে— এমন প্রশ্ন অনেকেরই।
আশপাশের কয়েকজন দোকানদার জানালেন, মালিকের কাছে নাকি ভবন সংস্কারের অনুমতিপত্র আছে। তাতে বলা আছে, এই ভবনই সংস্কার করা যাবে। যদিও এমন কোনো অনুমতিপত্র আদতেই আছে কি না, তা নিয়েও সন্দেহ পোষণ করছেন স্থানীয়রা।
স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কারের পেছনে রয়েছে ভবনটির মালিকদের প্রভাব। তারা পুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে ভবনটি না ভেঙেই সংস্কার করছেন— এমন অভিযোগও কারও কারও।
এ বিষয়ে জানতে ওয়াহেদ ম্যানশনের মালিক হাসান ও সোহেলের খোঁজে উর্দু রোডের ৩৯/২/সি বাড়িতে গেলে তাদের দেখা পাওয়া যায়নি। ওই বাড়িতে অবস্থানরত একজনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী আরও কয়েকটি বাড়িতে গিয়েও তাদের পাওয়া যায়নি। তবে হাসান ও সোহেল কারাগারে থাকা অবস্থায় সোহেলের শ্যালক যে রুবেল ভবনটি সংস্কারের কাজের দায়িত্বে ছিলেন, দেখা মেলে তার।
রুবেল সারাবাংলাকে বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কার হয়েছে, সেটা তো সবাই জানে। লুকানোর কী আছে এখানে? রাজউক বা সিটি করপোরেশন থেকে কিছু বলা হয়নি। বুয়েট বা অন্য কোথাও থেকেও নিষেধাজ্ঞার কোনো কাগজ দেওয়া হয়নি। সবাই প্রথমে মৌখিকভাবে নিষেধ করেছিল। আমরা ভবনটি সংস্কার করেছি। এবার নিয়ম মেনেই ভাড়া দেওয়া হবে। কেউ গোডাউন করবে কিংবা কেমিক্যাল রাখবে— এমনটি হতে দেওয়া হবে না।
জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হোসেন বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশন দেখলাম সংস্কার করা হয়েছে। তাদের কাছে নাকি কাগজপত্র আছে। আমরাও আর ঘাটাতে যাইনি। এটার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তো রয়েছেই।
ওয়াহেদ ম্যানশন সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের অথরাইজড অফিসার নুরুজ্জামান জহির সারাবাংলাকে বলেন, ‘ভবনটিতে কেমিক্যাল থাকায় আগুন লাগার পর বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। এ কারণে ভবনটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সবশেষ ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে একবার সংস্কারের উদ্যোগ নিলে আমরা গিয়ে কাজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন। এরপর তো গত বছর থেকে করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতির কারণে আর খোঁজ নেওয়া হয়নি। তারাও কোনো অনুমতি নেয়নি। আপনার মাধ্যমেই জানলাম যে ভবনটি সংস্কার করা হয়েছে। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’
সারাবাংলা/ইউজে/টিআর