Saturday 23 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

করোনায় সর্বোচ্চ সংক্রমণ-মৃত্যুর মাস এপ্রিল, সুস্থতাতেও এগিয়ে

সৈকত ভৌমিক, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
১ মে ২০২১ ১৪:২৩

ঢাকা: দেশে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। এরপর পেরিয়ে গেছে ১৩ মাস। এপ্রিল মাসের শেষ দিন পর্যন্ত কেটে গেছে ৪১৯ দিন। এর মধ্যে করোনা সংক্রমণের গ্রাফ উঠেছে-নেমেছে। তবে সংক্রমণের একবছর পার হওয়ার পর এপ্রিল মাসে এসেই দেখা গেছে একমাসে সর্বোচ্চসংখ্যক সংক্রমণ। এই সংখ্যা এর আগের যে মাসে সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল, তার তুলনায় প্রায় দেড় গুণ। অন্যদিকে একমাসে করোনা সংক্রমণ নিয়ে সর্বোচ্চ মৃত্যুও ঘটেছে এপ্রিলেই, যা এর আগের একমাসে সর্বোচ্চ মৃত্যুর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ! এই এপ্রিল মাসেই অবশ্য কোভিড-১৯ সংক্রমিত রোগীর সুস্থ হয়ে ওঠার সংখ্যাও সর্বোচ্চ।

বিজ্ঞাপন

শুক্রবার (৩০ এপ্রিল) স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে পাঠানো নিয়মিত বিজ্ঞপ্তির তথ্য বলছে, আগের ২৪ ঘণ্টায় কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন ৫৭ জন। এই সময়ে ২১ হাজার ৪৬টি নমুনা পরীক্ষা করে দুই হাজার ১৭৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। একইসঙ্গে এই সময়ে দেশে সুস্থ হয়েছে চার হাজার ৩২৫ জন।

এই তথ্য অনুযায়ী দেশে এখন পর্যন্ত মোট ৫৪ লাখ ৬৯ হাজার ৭০৪টি নমুনা পরীক্ষা করে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ১৩২ জনের মাঝে। এর মধ্যে কোভিড সংক্রমণ নিয়ে মারা গেছেন ১১ হাজার ৪৫০ জন। এখন পর্যন্ত দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়েছে ৬ লাখ ৮১ হাজার ৪২৬ জন।

ভয়ংকর এপ্রিল মাস

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরে দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক হিসেবে আগের সব সর্বোচ্চ পরিসংখ্যান ছাড়িয়ে গেছে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে। দেশে জানুয়ারিতে ২১ হাজার ও ফেব্রুয়ারিতে ১১ হাজারের ঘরে নেমে আসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ। তবে মার্চে সংক্রমণ শনাক্ত হয় ৬৫ হাজারের বেশি। কেবল সংক্রমণ নয়, সংক্রমণের হারও জানুয়ারিতে ৫ শতাংশ ও ফেব্রুয়ারিতে ২ শতাংশের নেমে এসেছিল। তবে মার্চে ফের সংক্রমণের হার পেরিয়ে যায় ১০ শতাংশ। কিন্তু এপ্রিল মাসে এসে সব রেকর্ড ভেঙে যায়। সংক্রমণ লাখের ঘর পেরিয়ে প্রায় দেড় লাখে পৌঁছায়। মৃত্যু পেরিয়ে যায় দুই হাজার। এর আগে কোনো মাসেই এত বেশি করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর সাক্ষী হয়নি বাংলাদেশ।

এপ্রিলের প্রথম ১০ দিনেই ভেঙে যায় অনেক রেকর্ড

এপ্রিলের ১০ দিনের মধ্যে প্রথম পাঁচ দিনেই সংক্রমণ ছিল সাত হাজারের বেশি। ছয় হাজারের বেশি সংক্রমণ ছিল তিন দিন। বাকি দুই দিন সংক্রমণ ছিল পাঁচ হাজারের বেশি। সব মিলিয়ে এপ্রিলের ১০ দিনে সারাদেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে ৬৭ হাজার ৬৪২ জনের মাঝে। এই ১০ দিনের সংক্রমণ গোটা মার্চের চেয়ে আড়াই হাজার বেশি। আর এই ১০ দিনের হিসাব নিয়েই মাস হিসেবে সর্বোচ্চ সংক্রমণের তালিকায় চতুর্থ স্থানে উঠে গিয়েছিল এপ্রিল।

বিজ্ঞাপন

এই ১০ দিনে মোট নমুনা পরীক্ষা হয় তিন লাখ দুই হাজার ৯১৩টি। সে হিসাবে ১০ দিনে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল ২২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। সংক্রমণের এই হারও গোটা মার্চের সংক্রমণের হারের দ্বিগুণেরও বেশি। শুধু তাই নয়, সংক্রমণের হারের দিক থেকে এপ্রিলের এই ১০ দিনের চেয়ে এগিয়ে ছিল কেবল জুলাই মাস। ওই মাসে নমুনা পরীক্ষার বিপরীতে সংক্রমণের হার ছিল ২২ দশমিক ৬৩ শতাংশ।

এদিকে, এই ১০ দিনে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু হয় ৬১৫ জনের, যেখানে মার্চে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা যান ৬৩৮ জন। অর্থাৎ এই ১০ দিনেই করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু গোটা মার্চ মাসকেই প্রায় ছুঁয়ে ফেলে। আর এই ১০ দিনে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে ২৯ হাজার ৯৭৯ জন।

মৃত্যু বেড়েছে এপ্রিলের মধ্যবর্তী ১০ দিনে

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পরে ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যুবরণের তথ্য পাওয়া যায়। পরবর্তীতে মাসিক হিসেবে দেশে সর্বোচ্চ পরিমাণ মৃত্যুর পরিসংখ্যান পাওয়া যায় ২০২০ সালের জুলাই মাসে। এই মাসে দেশে ১ হাজার ২৬৪ জন মারা যায়। তবে এপ্রিলের কেবল ১১ থেকে ২০ তারিখের ১০ দিনেই করোনা সংক্রণ নিয়ে মারা গেছেন ৯২৭। ১০ দিনে এত বেশি মৃত্যু আর কখনো দেশে ঘটেনি। আর এই ১০ দিনসহ এপ্রিলের প্রথম ২০ দিনে মৃত্যু পেরিয়ে যায় দেড় হাজার, যা গত বছরের জুলাইয়ের চেয়ে অনেক বেশি।

১১ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত দেশে ২ লাখ ৪৭ হাজার ৭০৮টি নমুনা পরীক্ষা করে ৪৮ হাজার ৮৪৩ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই ১০ দিনে দেশে কোভিড সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠে ৫৫ হাজার ৭৩৩ জন।

বিধিনিষেধের সুফলে এপ্রিলের শেষ ১০ দিন

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে কয়েক দফায় বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বন্ধ করা হয় গণপরিবহন। নিত্যপণ্যের দোকান ছাড়া অন্যান্য দোকানপাট ও শপিং মল বন্ধ থাকে কিছুদিন। মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে চালানো হয় অভিযান। এর প্রভাব পড়ে সংক্রমণে।

২১ এপ্রিল থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত পরিসংখ্যানে দেখা যায়, এই ১০ দিনে দেশে দুই লাখ ৪৮ হাজার ৫১৯টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩১ হাজার ৩৫২ জনের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই ১০ দিনে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মৃত্যু ঘটে ৮৬২ জনের, যা এই মাসের দ্বিতীয় ১০ দিনের তুলানয় কম। এই ১০ দিনে দেশে ৫৩ হাজার ৩১৫ জন সুস্থ হয়ে ওঠে। এর মাঝে ২২ এপ্রিল দেশে ৭ হাজার ২২২ জন কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন, যা দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এক দিনে সর্বোচ্চ সুস্থতার পরিসংখ্যান।

সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষার মাস এপ্রিল

দেশে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ নমুনা পরীক্ষা শুরু করা হয়।  মার্চ মাসে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্তের পর ২০২০ সালে সর্বোচ্চ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছিল ‍জুন মাসে— ৪ লাখ ৬০ হাজার ৫৩০টি। এ বছরের মার্চে সেই রেকর্ড ভেঙে নমুনা পরীক্ষা হয় ৬ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯টি। আর সদ্য চলে যাওয়া এপ্রিলে দেশে ৭ লাখ ৯৯ হাজার ১৪০টি নমুনা পরীক্ষা হয়, যা বাংলাদেশের কোভিড-১৯ সংক্রমণ পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ।

সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্তের মাস এপ্রিল

দেশে ২০২১ সালের এপ্রিল মাসে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৮৩৭ জনের মাঝে কোভিড-১৯ সংক্রমণ শনাক্ত হয়। এই সংখ্যা  ২০২১ সালের মার্চ মাসের শনাক্তের সংখ্যার (৬৫,০৭৯) চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। আর এই এপ্রিল মাসের আগে ২০২০ সালের জুন মাসে দেশে সর্বোচ্চ ৯৮ হাজার ৩৩০ জনের মাঝে সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল। তৃতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছিল গত বছরের জুলাইয়ে— ৯২ হাজার ১৭৮।

সর্বোচ্চ মৃত্যুর মাস এপ্রিল

দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হয়ে প্রথম মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায় গত বছরের ১৮ মার্চ। এরপর ২০২০ সালে দেশে একমাসে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২৬৪ জন মারা যান জুলাই মাসে। গত এপ্রিল মাসে সেই মৃত্যুর সংখ্যা ছিল জুলাইয়ের প্রায় দ্বিগুণ। এই মাসে দেশে করোনা সংক্রমণ নিয়ে মারা যান ২ হাজার ৪০৪ জন।

সর্বোচ্চসংখ্যক রোগী সুস্থ হওয়ার মাসও এপ্রিল

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে দেশে কোভিড-১৯ সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ২৭ জন, যা দেশে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে একমাসে সর্বোচ্চ সুস্থতার পরিসংখ্যান। এর আগে দেশে ২০২০ সালের জুলাই মাসে দেশে ৭৫ হাজার ৫০৯ জন কোভিড সংক্রমণ থেকে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন।

বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন

দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি নিয়ে উদ্বেগ আগে থেকেই জানিয়ে আসছিলেন স্বাস্থ্য খাতের বিশেষজ্ঞরা। বারবারই তারা স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণের তাগিদ দিয়ে আসছিলেন। বর্তমানে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে সরকার বিভিন্ন ধরনের বিধিনিষেধ আরোপ করলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ ঠেকাতে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা প্রণয়ন প্রয়োজন। একইসঙ্গে গণপরিবহন খুলে দিলে পরিস্থিতি খারাপ হওয়া আশঙ্কাও করছেন বিশেষজ্ঞরা।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) কার্যকরী সদস্য ডা. মোশতাক হোসেন সারাবাংলাকে বলেন, উৎস ও উৎপত্তিস্থলগুলো বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব হয়ে যেতে পারে। বর্তমানে সরকার এক সপ্তাহের জন্য কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছে। সেগুলোর ফল আমরা বর্তমানে দেখছি।  বর্তমানে শনাক্তের হার কমে আসছে। এপ্রিল মাসের শুরুর দিক বিবেচনা করলে এটি কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। তবে এর কারণে রিল্যাক্স হওয়া যাবে না।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আরও বলেন, মৃত্যুর সংখ্যা কিন্তু এখনো যে খুব কমে গেছে, তা বলা যাবে না। তবে এই পরিস্থিতিতে বলা যায়— আমাদের সামনের দিনগুলোতে সতর্কতার সঙ্গে এগুতে হবে। মাস্ক পরার বিষয়ে জোর দিতে হবে। গণপরিবহন যদি খুলে দেওয়া হয়, তবে সেখানে অর্ধেক যাত্রী পরিবহন ও স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করার বিষয়টির দেখতে হবে। একইসঙ্গে পিকনিক স্পট থেকে শুরু করে বিয়েশাদির অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে ভাবতে হবে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত না করা গেলে এগুলো বন্ধ রাখাই শ্রেয়।

কোভিড-১৯ মোকাবিলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম সারাবাংলাকে বলেন, গণমাধ্যমে খবর দেখছি, শনাক্তের হার কমছে। কিন্তু এতে রিল্যাক্স হওয়ার কিছু নেই। স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে— এ বিষয়টি সবার মাঝে ছড়ানো প্রয়োজন। কেনো এটি মানতে হবে, সেটিও জনগণকে বোঝাতে হবে। তারপর প্রয়োজন হবে এসব নির্দেশনা ও স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে অনুসরণ হচ্ছে কি না, তার কঠোর মনিটরিং। এগুলোর কোনো একটি জায়গায় শূন্যতা তৈরি হলে লকডাউন বলি আর যাই বলি না কেন, কোনো কাজে আসবে না।

স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের গুরুত্ব তুলে ধরে ভাইরোলজিস্ট ডা. নজরুল আরও বলেন, আমরা বারবারই বলছি— স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের বিকল্প নেই। মাস্ক পরতে হবে, সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে, জনসমাগম করা যাবে না। এগুলো ঠিকমতো অনুসরণ করলেই কিন্তু করোনার সংক্রমণ ব্যাপকভাবে প্রতিরোধ করা সক্ষম। তাই এ বিষয়ে অবহেলা করা যাবে না।

সারাবাংলা/এসবি/টিআর

করোনা সংক্রমণ করোনায় মৃত্যু

বিজ্ঞাপন

সিইসি ও ৪ কমিশনারের শপথ আজ
২৪ নভেম্বর ২০২৪ ০১:৩৩

আরো

সম্পর্কিত খবর