করোনার ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া গেছে দেশে
৮ মে ২০২১ ১৫:১৪
ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে পরিচিত B.1.617 ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে দেশে। ভারত থেকে আসা দুই ব্যক্তির নমুনা সিকোয়েন্সিং করে পাওয়া গেছে এই ভ্যারিয়েন্ট। এছাড়া আরও কমপক্ষে চার জনের নমুনায় একই প্যাঙ্গো লাইনেজের ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেছে। এই চার জনও ভারত ফেরত হওয়ার তাদের নমুনাগুলোও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট বলেই আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের বৈশ্বিক অনলাইন ডাটাবেজ জিআইএসএইড-এ এসব জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য আপলোড করা হয়েছে। শনিবার (৮ মে) স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি হেলথ) অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলমও গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছে।
অধ্যাপক খুরশিদ বলেন, এই ভ্যারিয়েন্ট যেসব ব্যক্তির শরীরে পাওয়া গেছে, তারা ভারত থেকে ফিরেছেন।
জিআইএসএইড আপলোড করা জিনোম সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য বলছে, দেশে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের {G/452R.V3 (B.1.617+)} উপস্থিতি প্রথম পাওয়া যায় ২৯ এপ্রিল সংগ্রহ করা এক নমুনায়। ৪১ বছর বয়সী এই ব্যক্তি ভারতে গিয়ে কোভিড-১৯ সংক্রমিত হন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় থাকা এই ব্যক্তির নমুনা সংগ্রহ করে আর্মড ফোর্সেস ইনস্টিটিউট অন প্যাথলজি (এএফআইপি) থেকে। পরে স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও রোগ গবেষণা কেন্দ্র (আইইডিসিআর) থেকে এই নমুনা সিকোয়েন্সিং করে দেশের বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আইডিইএসএইচআই (আইদেশি)।
এরপর ২৮ এপ্রিল ভারত থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসা ২৩ বছর বয়সী এক ব্যক্তির নমুনা সিকোয়েন্সিং করেও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট {G/452R.V3 (B.1.617+)} পাওয়া যায়। খুলনার এই ব্যক্তির নমুনা যশোর থেকেই সংগ্রহ করা হয়। আইইডিসিআর থেকে এই নমুনাও সিকোয়েন্সিং করে আইদেশি।
আরও পড়ুন- ভারতে একদিনে মৃত্যু ছাড়াল ৪ হাজার, শনাক্ত ৪ লাখ
আরও নমুনায় ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতির আশঙ্কা
ওপরের দুইটি নমুনায় ভারতীয় করোনা ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি নিশ্চিত হলেও আরও বেশকিছু নমুনায় এই ভ্যারিয়েন্ট থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জিআইএসএইডে এরকম কমপক্ষে চারটি নমুনার সিকোয়েন্সিংয়ের তথ্য আপলোড করা হয়েছে।
গত ২৭ এপ্রিল ভারত থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসা ঢাকার ৭৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির নমুনা সিকোয়েন্সিং করে এটির প্যাঙ্গো লাইনেজে দেখা যায় B.1 (Version 2021-04-28)। একই প্যাঙ্গো লাইনেজ দেখা গেছে ২৮ এপ্রিল ভারত থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসা ৫৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির নমুনায়। তার বাড়ি ঝিনাইদহে। এছাড়া ২৮ এপ্রিল ভারত থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসা বরিশালের ৩৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তির নমুনাতেও দেখা গেছে একই লাইনেজ। ২৯ এপ্রিল ভারত থেকে সংক্রমণ নিয়ে আসা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা ৩৭ বছর বয়সী এক নারীর নমুনাতেও এই B.1 (Version 2021-04-28) লাইনেজ দেখা গেছে।
এই চারটি নমুনার প্রথমটি ঢাকা থেকে সংগ্রহ করে আইইডিসিআর। পরের দুইটি সংগ্রহ করা হয় যশোর থেকে। আর শেষেরটি ঢাকা থেকে সংগ্রহ করে এএফআইপি। পরে সবগুলো নমুনা আইইডিসিআর থেকে নিয়ে জিনোম সিকোয়েন্সিং করেছে আইদেশি।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, করোনা ভ্যারিয়েন্টের B.1 লাইনেজটি থেকেই যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট এসেছে। ভারতীর ভ্যারিয়েন্টও একই লাইনেজ থেকে উদ্ভূত। যেহেতু এই চার ব্যক্তি ভারত থেকে সংক্রমণ নিয়ে এসেছেন, তাদের নমুনার জিনোম সিকোয়েন্সিং থেকে পাওয়া লাইনেজটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন কর্মকর্তাও সারাবাংলাকে একই আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ভ্যারিয়েন্টগুলো ভারতীয় হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। সিকোয়েন্সিংয়ের আরও বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেলে সেটি সুনির্দিষ্টভাবে বলা যাবে। তবে তাদের ভাইরাসটি ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট হিসেবে ধরেই ব্যবস্থা নিতে হবে।
পরে এই ছয়টি নমুনা বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা বলেন, ছয়টি নমুনার মধ্যে দুইটিতে ভারতের ভ্যারিয়েন্ট দেখা গেছে। বাকি চারটি নমুনায় পাওয়া ভ্যারিয়েন্টও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের কাছাকাছি।
আরও পড়ুন- মহামারি পূর্ব দিকে এগোচ্ছে, ভারতের সতর্কবার্তা
ছড়াচ্ছে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট
ভারতের মহারাষ্ট্রসহ কিছু অঞ্চলে ডাবল মিউটেন্ট, ট্রিপল মিউটেন্ট (B.1.617+ S:V382L) এবং B.1.618 (বেঙ্গল ভ্যারিয়েন্ট) নামে পরিচিত ভ্যারিয়েন্টগুলোর দেখা পাওয়া গেছে। ভারতীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তাদের দেশে সংক্রমণ পশ্চিম থেকে পূর্বের রাজ্যগুলোর দিকে যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের পূর্ব পাশে বাংলাদেশের সীমান্ত থাকায় তাই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টের বাংলাদেশেও ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে, এপ্রিলের ২০ তারিখ পাওয়া যাওয়া ভারতের এই ভ্যারিয়েন্টকে এখনো ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবেই দেখছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। অর্থাৎ এই ভ্যারিয়েন্টের গতিপ্রকৃতি নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। তবে পাবলিক হেলথ ইংল্যান্ড এরই মধ্যে এই B.1.617 ভ্যারিয়েন্টকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’’ বলে ঘোষণা করেছে। এর অর্থ, এরই মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্টকে তারা জনস্বাস্থ্যের জন্য যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছে। তবে এই ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন কার্যকর ও রোগের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে বলেও জানানো হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নতুন এই ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট কতটা ক্ষতিকর বা এর বৈশিষ্ট্য কী, তা নিয়ে খোদ ভারতেই এখনো বিস্তারিত গবেষণা করা সম্ভব হয়নি। তাই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এখন পর্যন্ত এগুলোকে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব ইন্টারেস্ট’ হিসেবে পর্যবেক্ষণে রাখছে। তবে ভারতে সাম্প্রতিক সময়ে সংক্রমণের চিত্র বলছে, এটি মাত্রা ছাড়াচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে মৃত্যুও। সবশেষ ২৪ ঘণ্টাতেই দেশটিতে ৪ হাজারের বেশি মৃত্যুর রেকর্ড হয়েছে।
ভ্যারিয়েন্ট যাই হোক, স্বাস্থ্যবিধি মানতেই হবে
অন্যদিকে, বাংলাদেশে আগে থেকেই যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিলের ভ্যারিয়েন্টের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর সঙ্গে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট যুক্ত হলে তা সংক্রমণ পস্থিতির অবনতি ঘটাতে পারে।ফলে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণের কোনো বিকল্প নেই।
ভ্যাকসিন গ্রহণের পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধির বিষয়েও গুরুত্ব দিতে হবে উল্লেখ করে অণুজীববিজ্ঞানী ও চাইল্ড হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের (সিএইচআরএফ) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সমীর কুমার সাহা সারাবাংলাকে বলেন, যে ভ্যারিয়েন্টই আসুক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে আমরা কিছুটা হলেও শঙ্কামুক্ত থাকতে পারব। কারণ মাস্ক কিন্তু সব ভ্যারিয়েন্টকেই আটকাবে। আর তাই বলি ভ্যারিয়েন্ট যাই হোক না কেন, আমাদের একটু সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার, যেন আমরা মানুষকে সঠিক বার্তা দিতে পারি।
তিনি আরও বলেন, আমরা যত যাই বলি না কেন, মিউটেশন বা ভ্যারিয়েন্ট যেটাই আসুক না কেন— আমাদের কিন্তু স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতেই হবে। সবসময় মাস্ক পরে চলতে হবে। কারণ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ না করলে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবেই। একইসঙ্গে ভ্যাকসিনও নিতে হবে যেন সংক্রমণের পর স্বাস্থ্যঝুঁকির মাত্রা কমে আসে।
দেশে করোনাভাইরাসের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন ও গতিপ্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করছেন সৈয়দ মুক্তাদির আল সিয়াম। এই গবেষক সারাবাংলাকে বলেন, জিএসএআইডি থেকে প্রাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারত থেকে আসা দুই জনের শরীরে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত করা গেছে। আরও কয়েকজনের শরীরে পাওয়া গেছে প্রায় একই ধরনের ভাইরাস। তারা ভারত থেকে সংক্রমিত হয়েছেন বলে সেগুলোও ভারতীয় ভ্যারিয়েন্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু এখন প্রশ্ন হলো— এটি কি বাংলাদেশের কমিনিটিতে ছড়াচ্ছে?
এই গবেষক বলেন, সঠিকভাবে কোয়ারেনটাইন, আইসোলেশন ও কন্টাক্ট ট্রেসিং নিশ্চিত করতে পারলে যেকোনো ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণই ছড়ানো রোধ করা সম্ভব। পাশাপাশি যাদের মধ্যে এই ভ্যারিয়েন্ট পাওয়া যাবে, তাদের আশপাশের মানুষদের মধ্যে করোনা সংক্রমণ থাকলে জিনোম সিকোয়েন্সিং বেশি বেশি করতে হবে।
সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে সিয়াম বলেন, যুক্তরাজ্যের জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে এরই মধ্যে ভারতীয় ভ্যারিয়েন্টকে উদ্বেগের কারণ (ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন) হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তাই আমাদেরকে আরও বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। তবে আশার কথা হচ্ছে, এই ভ্যারিয়েন্টটি দ্রুত সংক্রমণশীল হলেও অনেক বেশি মারাত্মক— এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একইসঙ্গে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন এটির বিরুদ্ধে কাজ করতে পারে বলে জানা গেছে। ফলে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুঝুঁকি কমাতে ভ্যাকসিন সহায়ক হবে। তাই আমাদের উচিত সঠিকভাবে মাস্ক পরা, ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধোয়া এবং ভ্যাকসিন নেওয়া।
সারাবাংলা/এসবি/এএম/টিআর