Friday 22 Nov 2024
Sarabangla | Breaking News | Sports | Entertainment

‘লকডাউন’ থেকে বের হয়ে আসার পথ খুঁজছে সরকার

ঝর্ণা রায়, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
৮ মে ২০২১ ১৯:৩২

ফাইল ছবি

ঢাকা: করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সংক্রমণ রোধে এ পর্যন্ত যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে লকডাউন বা কঠোর বিধিনিষেধ সবচেয়ে বেশি কার্যকর বলে মনে করছে সরকার। একই পর্যবেক্ষণ বিশেষজ্ঞদেরও। কিন্তু দিনের পর দিন অফিস-আদালত বন্ধ রেখে এই উদ্যোগ অব্যাহত রাখা স্থায়ী সমাধান নয়— এমন অভিমতও তাদের। তাই অর্থনীতি সচল রেখেই করোনায় স্বাস্থ্য সুরক্ষা কীভাবে নিশ্চিত করা যায় সে পথ খুঁজছে সরকার।

স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা পেতে চলমান কঠোর বিধিনিষেধ থেকে ধাপে ধাপে বের হয়ে আসার উপায় খুঁজছে সরকার। সেক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ওপর। এই স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে প্রথমে গুরুত্ব দেওয়া হবে মাস্ক ব্যবহারে বাধ্য করা। এর পর শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলার পাশাপাশি ভ্যাকসিনেশন নিশ্চিত করা হবে। এছাড়া আরও কী কী উপায় থাকতে পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের কাছে মতামত চাওয়া হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

সূত্র জানায়, সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট দফতর/সংস্থা, মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের নিয়ে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে লকডাউন বা বিধিনিষেধের পক্ষে বিপক্ষে মতামত তুলে ধরা হয়। কেউ বলছেন বর্তমান পরিস্থিতিতে লকডাউন থাকা উচিত, আবার কেউ কেউ মতামত দিয়েছেন স্বাস্থ্যবিধি কার্যকর করার ওপরে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে সারাবাংলাকে বলেন, ‘এরই মধ্যে বিধিনিষেধ অনেক শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। মার্কেট, গণপরিবহন খুলে দেওয়া হয়েছে। ঈদের পর ধীরে ধীরে আরও শিথিল করা হবে। সরকার চায় সবকিছু বন্ধ না করতে। তবে এর জন্য সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। প্রয়োজনে যেসব স্থানে সংক্রমণ বেশি দেখা যাবে, কেবল সেসব স্থানেই বিধিনিষেধ আরোপ করা হবে।’

বিজ্ঞাপন

এদিকে লকডাউন থেকে বের হয়ে কীভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করা যায় সেবিষয়ে একটি কৌশল ঠিক করেছে করোনোভাইরাস প্রতিরোধে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি। দীর্ঘ মেয়াদী কৌশল হিসেবে দশটি সুপারিশ করেছে তারা। সেখানে মাস্ক ব্যবহার শতভাগ নিশ্চিত করা, অর্ধেক জনবল নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম পরিচালনা, অর্ধেক যাত্রী নিয়ে গণপরিবহন চালানো, খাবারের দোকান সারাদিনের জন্য খোলা না রাখা, জনসমাবেশ ও ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোতে জনসমাগম নিয়ন্ত্রণ করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা এবং বিনোদন ও পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ রাখার পাশাপাশি সব কাজে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সুপারিশ করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) সভাপতি অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান সারাবাংলাকে বলেন, ‘গত এক বছরে দুই দফা করোনা বিশ্ববাসীকে হুমকির মুখে দাঁড় করিয়েছে। বিভিন্ন দেশের দিকে তাকালে দেখা যায়, যেসব জায়গায় করোনার সংক্রমণ বেশি কেবল সেসব স্থানই অবরুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ওইসব স্থানে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। আমাদের এখানে যেটা হয়েছে সেটা হলো- যেখানে প্রয়োজন সেখানেও, আবার যেখানে প্রয়োজন নেই সেখানেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তার ওপরে একেক সময় একেকরকম নির্দেশনা। যে কারণে মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। কোনটা পালন করবে, কোনটা করবে না।‘

তিনি বলেন, ‘লকডাউনে সংক্রমণ কমেছে এটা সত্য। কিন্তু এটি কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। যে মানুষের কাছে জীবন-জীবিকা প্রধান তাকে তো লকডাউন দিয়ে বাধ্য করা যাবে না। তাই আমরা বলছি স্বাস্থ্যবিধি মানতে বাধ্য করা হোক। গণপরিবহন বন্ধ রাখার কারণে দেখা যাচ্ছে- সিএনজি, মাইক্রোবাসে ঠেসে মানুষ যাতায়াত করছে। এটা না করে গণপরিবহন চলতে দিয়ে কঠোর শর্তের মধ্যে রেখে আইনের প্রয়োগ এবং স্বাস্থ্যবিধি মানাতে বাধ্য করা যেত। আমরা সেসবই সরকারকে বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘কোন পথে এগোলে সংক্রমণের গতি কমে আসবে সে নিয়ে আলোচনা চলছে। তবে যারা এই বিধিনিষেধ বা নির্দেশনা দিচ্ছেন, তাদের ভেবে-চিন্তে আরও পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’

করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে গত ৫ এপ্রিল থেকে টানা কঠোর বিধিনিষেধ চলছে দেশে। চলবে আগামী ১৬ মে পর্যন্ত। মানুষের জীবিকার কথা চিন্তা করে এরই মধ্যে দোকান-পাট, শপিংমল খুলে দেওয়া হয়েছে। চলছে বিমান। গত ৬ মে থেকে সীমিত পরিসরে বাস চলাচলেও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। খুলবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও। এই পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাকেই গুরুত্ব দিতে দেখা যাচ্ছে সরকারকে।

জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন সম্প্রতি সারাবাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘মানুষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে সরকার সেদিকে বেশি গুরুত্ব দিতে চায়। সেজন্য মাস্কের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার এবং নো মাস্ক নো সার্ভিস উদ্যোগকে শতভাগ নিশ্চিত করতে হবে।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত গত সোমবার (৩ মে) মন্ত্রিসভা বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানিয়েছিলেন যে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চললে, মাস্ক ব্যবহার না করলে মার্কেট বন্ধ করে দেওয়া হবে। স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত করতে মার্কেটগুলোতে পুলিশ অভিযান চালাবে। ভ্রাম্যমাণ আদালত থাকবে এবং সেসব কার্যক্রম জোরালোভাবেই পরিচালিত হচ্ছে। আবার স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে জনসচতেনতা মূলক প্রচারণাও চালাচ্ছে সরকার। এজন্য যুক্ত করা হয়েছে তথ্য মন্ত্রণালয়কে। কাজ করছে তথ্য অধিদফতরও।

এ প্রসঙ্গে তথ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক সুরথ কুমার সরকার সারাবাংলাকে বলেন, ‘সরকারের নির্দেশনাগুলো যাতে মানুষ মেনে চলে সেজন্য গণমাধ্যমে প্রচার অব্যাহত রয়েছে।’ ১৬ মে’র পরে বিধিনিষেধ আবারও বাড়ানো হবে কি না? এর উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটা সংক্রমণের ওপরে নির্ভর করছে। সরকার সতর্কাবস্থানের পাশাপাশি প্রতিবেশি দেশ ভারতকে পর্যবেক্ষণ করছে। যাতে তাদের মতো পরিস্থিতি বাংলাদেশে না হয় সেই চিন্তা মাথায় রেখেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’ তবে বিধিনিষেধ আরও শিথিল হচ্ছে- এমন আভাস দিয়ে তিনি বলেন, ‘মানুষের জীবিকার বিষয়ও চিন্তা করতে হবে। যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না কেন, স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবেই মানতে হবে।’

দেশে এখন চলছে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। এরপর তৃতীয় ঢেউয়ের আশংকা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। উন্নত দেশগুলো তৃতীয় ঢেউ মোকাবিলা করছে। প্রতিবেশি দেশ ভারত করোনা মোকাবিলায় হিমশিম খাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতেও লকডাউনের উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। এসব বিষয় মাথায় রেখেই সর্তকতার সঙ্গে এগোচ্ছে সরকার।

এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালিক বলেছেন, ‘করোনা বুঝিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ছাড়া বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। প্রতিবেশি দেশ ভারতের অবস্থা বাংলাদেশে শুরু হলে পরিস্থিতি হবে ভয়াবহ। তাই আমরা খুব সর্তকর্তার সঙ্গে এগোচ্ছি। স্বাস্থ্য সুরক্ষার সঙ্গে কোনো আপস নেই। মানুষের বেপোরোয়া চলাফেরার কারণে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে। মানুষকে সর্তক থাকতে হবে। না হলে তৃতীয় ঢেউও আসতে পারে। তাই সচেতনতার বিকল্প নেই।’

উল্লেখ্য, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধে গত ৫ এপ্রিল সাতদিনের জন্য কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করে সরকার। কিন্তু সংক্রমণ বাড়তে থাকায় বিধিনিষেধে শিথিলতা এনে ধাপে ধাপে ১৬ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়। এর পরের পদক্ষেপ নির্ভর করছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বৃদ্ধি বা কমার ওপর— এমনই বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

সারাবাংলা/জেআর/পিটিএম

কঠোর বিধিনিষেধ পথ খুঁজছে লকডাউন সরকার স্বাস্থ্যবিধি

বিজ্ঞাপন

আরো

সম্পর্কিত খবর